কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহার মোদির ভুয়ো 'গ্যারান্টি'-র জবাব দিতে পারবে?

Congress Nyay Patra: ২০১৮ সালে মোদি বলেছিলেন, দেশের সমস্ত ঘরে আলো পৌঁছে দেবেন। ২০২৪ সালের আগে ফোর্বস সংস্থার একটি রিপোর্ট বলছে, এখনও ৩১ লক্ষ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি

নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়ে গেছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেছে প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতি আবার যে সে প্রতিশ্রুতি নয়, একেবারে খোদ
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি - ‘মোদি কি গ্যারান্টি’। দেশের প্রধানমন্ত্রীর নিজেই নিজেকে শংসাপত্র দেওয়ার নজির, শুধু এই দেশের পঁচাত্তর বছরে কেন, সারা পৃথিবীর ইতিহাসে আছে কিনা সন্দেহ! নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্র, বারাণসীতে গিয়ে মোদি বললেন, ‘মোদির গ্যারান্টি সুপারহিট’। আরেক জায়গায় বললেন, ‘মোদির গ্যারান্টি, মোদির কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায়ের ফল’। ত্রিচুরে, এক ১৯ মিনিটের জনসভায়, তাঁর গলাতেই ১৮ বার, ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ শব্দবন্ধ শোনা গেল। আরেক জায়গায় তিনি বললেন, অন্যদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতির বদলে, তাঁর ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ আশার কথা বলে।

যদি একটু তলিয়ে দেখা যায়, তাহলে জানা যাবে, গত ১০ বছরে, এইরকম হরেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, হরেক প্রকল্পের কথা বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এখনও অবধি হিসেব করে দেখা গেছে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাদে প্রায় ১৪২ টি প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই প্রকল্পগুলো কী অবস্থায় আছে, তার কোনও হিসেব তিনি না নিলেও, নাগরিকদের সুবিধার্থে সেই সংক্রান্ত হিসেব কিঞ্চিৎ দেওয়া উচিত। প্রতিদিন তিনি একের পর এক প্রকল্পকে সামনে রেখে শুধু নিজের প্রচার করে গেছেন। দশ বছর পরে, নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে বলেন তিনি ২০৪৭ সাল অবধি এইরকম প্রচার করে যাবেন। তা ভালো। কিন্তু তিনি দেশের মানুষদের জন্য করলেনটা কী? নজর দেওয়া যাক প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন করা কয়েকটি প্রকল্পের দিকে, যা নিয়ে একসময় প্রচুর
শোরগোল পড়েছিল প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যমে। কী অবস্থায় বর্তমানে আছে এই প্রকল্পগুলো?

আরও পড়ুন- বিজেপির উপর গোঁসা করেই তৃণমূলে! ‘বহিরাগত’ শত্রুঘ্ন এবারও জিতবেন?

১। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই শুরু হয়েছিল, ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প। উদ্বোধনের সময়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, এটা তাঁর জীবনের স্বপ্ন ছিল যে তিনি ‘মা গঙ্গা’-কে কলুষমুক্ত করবেন, পরিশ্রুত করবেন। এই বাবদ অর্থও মঞ্জুর করা হয়েছিল, ২০ হাজার কোটি টাকা। তারপর ২০১৯ সালে যখন নরেন্দ্র মোদি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি বারাণসী থেকেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘মা গঙ্গা’ তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন এবং সেই টানেই তিনি ওই আসন থেকে নির্বাচনে লড়তে চান। বেশিরভাগ গণমাধ্যমই প্রশ্ন করেনি, গঙ্গাকে পরিশ্রুত করার প্রকল্পের কী হলো? ২০২১ সালে তথ্য জানার অধিকার আইনে জানা গেল, ২০২১ সাল অবধি মাত্র ২০ শতাংশ কাজ হয়েছে। বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদেরা বললেন, গঙ্গাদূষণ যেভাবে রোজ বাড়ছে, তাতে ২০২৬ সালে আরও ৭০০০ লক্ষ লিটার বর্জ্য গঙ্গাতে মিশবে। প্রশ্ন হলো, এই যে এত প্রচার করে গঙ্গার শোধনের গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল তার কী হবে?

২। ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করলেন, সারা দেশে ১০০টি স্মার্ট শহর তৈরি করা হবে। আমেরিকা, ফ্রান্স, চিন সমস্ত দেশ থেকে প্রায় ৪ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ আসার কথাও ঘোষিত হলো। রোজ খবর বেরোতে শুরু করল, আইবিএম, থালেস, সিস্কো সহ নানা বহুজাতিক সংস্থা এই প্রকল্পে উৎসাহ দেখিয়েছে। আসলে এই সংস্থাগুলির উদ্দেশ্য ছিল, কম দামে জমি এবং অন্যান্য পরিকাঠামো হাতিয়ে নেওয়া। রোজ সংবাদপত্রে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, এশিয়ান
ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের সহায়তা সংক্রান্ত খবর বেরোল ঠিকই। কিন্তু শহর স্মার্ট হল কই? কিছু শহরে কিছু ক্যামেরা এবং কিছু এলইডি ল্যাম্প লাগানোর পরেই সেই স্মার্ট সিটির গ্যারান্টির খবর আর পাওয়া যাচ্ছে না।

৩। এবার আসা যাক বহু প্রতীক্ষিত বুলেট ট্রেন প্রকল্পের কথায়। মুম্বই-আহমেদাবাদ বুলেট ট্রেন প্রকল্পের উদ্বোধন হয়েছিল ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। খরচ ধার্য হয়েছিল ১ লক্ষ ৮ হাজার কোটি টাকা। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভূমিপূজাও হয়েছিল। জাপানের সঙ্গে প্রযুক্তিগত সমন্বয়ে এই ট্রেন চলবে ঘোষণা করে বলা হয়, ২০২২ সালের ১৫ অগাস্টের মধ্যে এই ট্রেন চালু হয়ে যাবে। অবস্থা এতই খারাপ যে এখন বলা হচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রা পিছিয়ে ২০২৭ সাল করা হল। যে খরচ ধার্য হয়েছিল, তা ৩ বছর পিছনোর ফলে, বেড়ে হবে ২ লক্ষ কোটি টাকা। বুলেট ট্রেন চালানো যাচ্ছে না দেখে শুরু করে দেওয়া হল বন্দে ভারত ট্রেন। নিন্দুকেরা এবং সমালোচকেরা বলে থাকেন, শতাব্দী, রাজধানী এবং দুরন্ত এক্সপ্রেসের একটু খোলনলচে বদলে, কম দূরত্বে এবং সময়ের এদিক ওদিক করে চালানো পুরনো ট্রেনগুলোকেই নরেন্দ্র মোদি ‘বন্দে ভারত’ নাম দিয়েছেন এবং সেগুলোর উদ্বোধনে নিজের নাম জড়িয়ে, নিজের প্রচার করেছেন। সাধারণ মানুষ কোনও প্রশ্ন না করে নির্দ্বিধায় নাকের বদলে নরুণকে মেনেও নিয়েছে।

৪। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে মোদি বলেছিলেন, দেশের সমস্ত ঘরে আলো পৌঁছে দেবেন। ২০২৪ সালের আগে ফোর্বস সংস্থার একটি রিপোর্ট বলছে, এখনও ৩১ লক্ষ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। মোদি আরও বলেছিলেন, দেশের মানুষের ঘরে ঘরে জল পৌঁছে দেবেন। শুধুমাত্র বাংলার বিভিন্ন গ্রামের খবর নিলেই দেখা যাবে, বহু মানুষের বাড়িতেই কল লেগেছে, জলের পাইপও বসেছে কিন্তু এখনও জলের উৎস অর্থাৎ জলের ট্যাঙ্ক বা জলাধারই তৈরি হয়নি। মোদি বলেছিলেন, দেশের ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দিচ্ছেন তিনি। কিছুদিন আগেই দেখা গেছে বিহারের একটি গ্রামে আটা, চিনি এবং ডাল দেওয়ার জন্য, গ্রামের মানুষদের ডেকেছিলেন এক রেশন ডিলার। শেষমেশ সেই গ্রামবাসীদের হাতে নরেন্দ্র মোদির ছবি দেওয়া খালি বস্তা ধরিয়ে দেওয়া হয়।

৫। মোদি গ্যারান্টি দিয়েছিলেন ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে। বলেছিলেন আগামী ছয় বছরে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেবেন। ২০২২ সালে দেখা গেল, মাত্র ২ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। ইদানীং তিনি আর এই গ্যারান্টির কথা তোলেন না। কিন্তু গণতান্ত্রিক যে কোনও আন্দোলনকে বন্ধ করতে তিনি সততই সজাগ। কৃষক আন্দোলন রুখতে তিনি যা যা করেছেন তা নিঃসন্দেহে উল্লেখের দাবি রাখে। নির্বাচনী প্রচারে এসে এখন তিনি বলছেন, গত ১০ বছরে যা হয়েছে, তা শুধুমাত্র ট্রেলার মাত্র, আগামীতে আসল সিনেমা আসতে চলেছে। কৃষক আন্দোলনের প্ররিপ্রেক্ষিতে এই কথা যে যথেষ্ট ভীতি সঞ্চারের 'গ্যারান্টি' দিচ্ছে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

আরও পড়ুন- আরএসএস, বিজেপি নেতা, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর হাতে ৬২% সৈনিক স্কুল তুলে দিল বিজেপি!

ভারতবর্ষে নির্বাচনী প্রচার গত কয়েকবছরে বেশ অনেকটা বদলেছে। কিছুদিন আগেও ভারতের বিভিন্ন জ্বলন্ত সমস্যাকে তুলে ধরা হতো নির্বাচনী প্রচারে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, সমস্যার কথা অনেকে পিছনে, সামনে থাকছে কেবলই নেতার মুখ। অন্যদিকে বামপন্থী দল এবং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যখন সমস্যা এবং তার সমাধানের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন তাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হচ্ছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে। বলা হচ্ছে, এই নির্বাচনী ইস্তেহারে নাকি মুসলিম লীগের স্ট্যাম্প আছে। অর্থাৎ কংগ্রেসের ন্যায়পত্র বা বামপন্থীদের ঘোষণাপত্রের প্রশ্নগুলিকে গুরুত্বহীন করে দিতে চাইছেন অযৌক্তিকভাবে। এক ঝলক দেখলে মনে হবে, ন্যায়পত্র বোধহয় কোনও বামপন্থী দলের নির্বাচনী ঘোষণাপত্র। বলা হয়েছে, দেশের প্রতিটি শিশুকে বিনামূল্যে দ্বাদশ শ্রেণি অবধি বাধ্যতামূলক শিক্ষার বন্দোবস্ত করা হবে। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো যাতে অস্বাভাবিক বেতন না নিতে পারে, তার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হবে। বিদ্যালয়ে কোনও চুক্তিভিত্তিক কর্মী থাকবেন না, যাঁরা থাকবেন তাঁরা সকলেই হবেন স্থায়ী কর্মী। শহরে চাকরির নিশ্চয়তা গ্যারান্টি প্রকল্প থাকবে, গিগ শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক এবং বাড়ির পরিচারিকাদের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। স্নাতক হওয়া ২৫ বছরের নীচে যে কোনও
যুবকের জন্য কারখানায় এক বছরের শিক্ষানবিশ থাকার বন্দোবস্ত করা হবে। সরকারি চাকরিতে মহিলাদের জন্য পঞ্চাশ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। আশা এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী সংখ্যা এবং তাঁদের বেতন বৃদ্ধি করার চেষ্টা হবে। বিনামূল্যে সবার চিকিৎসার জন্য, সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে তোলা, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা এবং তাঁদের বেতন বাড়ানোর দিকে নজর দেবে কংগ্রেস।

সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার অধিকার এবং তাঁদের সুরক্ষা দেওয়ার আইন আনা হবে। নোটবন্দি, রাফাল, পেগাসাস এবং নির্বাচনী বন্ড নিয়ে তদন্ত কমিশন গড়ার কথাও রয়েছে ন্যায়পত্রে। শুধু তাই নয়, বলা হয়েছে আপাতত ইভিএমে নির্বাচন হলেও, ইভিএম এবং ভিভিপ্যাটের সমস্ত স্লিপগুলোকে গুনে তবে ফল প্রকাশ করা হবে ভবিষ্যতের নির্বাচনে। এক দেশ এক নির্বাচন প্রকল্প বাতিল করা হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আরও উন্নত করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম শরিক কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এই রকম নির্বাচনী ঘোষণাপত্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং অসমের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, এই ঘোষণাপত্র নাকি পাকিস্তানের জন্য তৈরি হয়েছে, এই ঘোষণাপত্রের মধ্যে দিয়ে নাকি বিভাজন তৈরি হবে। কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের এই ন্যায়পত্র নিয়ে তাঁরা আট কোটি পরিবারের কাছে সশরীরে পৌঁছবে। প্রধানমন্ত্রীর ফাঁপা এবং ফাঁকা গ্যারান্টির বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবেই ইন্ডিয়া জোট যদি রাস্তায় নামতে পারত, মোদি-শাহের হাতে গণতন্ত্রকে কবর চাপা পড়া থেকে বাঁচানো যেতই।

More Articles