২১ দিনে তিন বাঙালির ভূস্বর্গ জয়, দু'চাকায় ইতিহাস লিখলেন চন্দনরা

জুল ভার্ন লিখেছিলেন 'অ্যারাউনড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ'। আশি দিনে পৃথিবীর এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধের দ্রাঘিমারেখা ছুঁয়ে সত্যিই ফিরে আসা চলে কিনা, বলা যায় না। কিন্তু ২১ দিনে স্রেফ সাইকেলেই যে ভূস্বর্গের সীমান্ত ছুঁয়ে আসা সম্ভব, তা প্রমাণ করে দিলেন কলকাতার থ্রি মাস্কেটইয়ার্স, চন্দন বিশ্বাস, রাহুল হালদার এবং অভীক মণ্ডল।

তেহজিবের মুলুক কাশ্মীর। তার ইতিহাসের দেওয়ালে দেওয়ালে সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের 'কাশ্মীরিয়ত'। আর এই 'কাশ্মীরিয়ত'-এর আহ্বানেই ৩ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে সাইকেলে চেপে রওনা দিয়েছিলেন তিন বন্ধু। পথে ছিল নানান বাধা বিপত্তি। তাদের কোনোটা প্রাকৃতিক, কোনোটা আবার প্রশাসনিক। কিন্তু পথ চলার গল্পকে আর কে কবে দমিয়ে রাখতে পেরেছে? সে তো বহতা জলপ্রপাতের মতো। সেই বহতা স্রোতের সাঁতারু হয়ে  প্রায় হাজার কিলোমিটার পথ সাইকেলে চেপে অতিক্রম করলেন সোনারপুরের রাহুল, অভীক এবং হৃদয়পুরের চন্দন।

মহামারীর প্রকোপে ভ্রমণশিল্প বিপর্যস্ত। দু'দুটো লকডাউনের ধাক্কায় বিধ্বস্ত অবস্থা দেশবাসীর। কাজেই, নিয়ন্ত্রণবিধি একটু শিথিল সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা পেয়ে বসল কলকাতার তিন যুবককে। বিমান নয়, বাইক-চারচাকাও নয়, নিছক প্যাডেলে ভর করে তাঁরা এগিয়ে চললেন গুরেজ উপত্যকা থেকে কুপওয়ারা। তারপর লোলাব, বাঙ্গাস, গুলমার্গ, পেহেলগাঁও কাজিগুন্দ হয়ে অমৃতসরের ওয়াগা সীমান্তে পৌঁছে ২১ দিনের অভিযানে  ইতি টানলেন অভিযানে।

পথে কী ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তাঁরা? চন্দনের মতে, "আমাদের এই উইন্টার এক্সপিডিশনটার আইডিয়াটা কিন্তু খুব একটা নর্মাল নয়। একদম টপ উইন্টার সিজনে বরফের অঞ্চলে এ ধরনের সাইকেল এক্সপিডিশন এর আগে হয়েছে কিনা আমায় জানা নেই। সমস্যার কথা আগে থেকে কিছুটা চিন্তা করেই গেছিলাম, কারণ আমাদের আইটিনিরারির অনেকটাই ছিল 'এল ও সি' রিজিয়ন। এবার এ সমস্ত এলাকায় সিকিউরিটির ব্যপার তো কিছুটা থাকেই। যেমন ধরা যাক গুরেজ ভ্যালিতে আমরা ঠিক করে যেতেই পারিনি। সাইকেলের বদলে গাড়ি নিয়ে গেলে হয়ত আমাদের ওখানে যেতে দেওয়া হত।"

আতিথেয়তার জন্য প্রসিদ্ধ কাশ্মীরের মানুষজন। নানান সংস্কৃতির মিশেলে যে বাস্তুতন্ত্র সেখানে গড়ে উঠেছে, তাকেই এক কথায় বলা হয় 'কাশ্মীরিয়ত'। কেমনভাবে তাঁরা অভ্যর্থনা জানালেন তিন বাঙালি যুবক কে? চন্দন বলছেন, "স্থানীয়দের আতিথেয়তার কোনো তুলনাই হয় না। আমরা যে জায়গাগুলোয় গেছিলাম সেগুলো তো একদম ইন্টিরিয়র, ট্যুরিস্টরা সাধারনত যায় না। কিন্তু সেখানেও কাশ্মীরের মানুষজনদের যে অভিবাদন আমরা পেয়েছি সেটা ভাষায় প্রকাশ করাই খুব কঠিন।" এমনকী, রাস্তায় প্রায় পাঁচ মিনিট পরপরই কেউ না কেউ তাদের সাইকেল দাঁড় করিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করছে, হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে আপেল, এ অভিজ্ঞতাও তাঁদের হয়েছে।

এবার কাশ্মীর, সামনের বার হয়ত 'অন্য কোথা, অন্য কোনও খানে'। সাইকেলের অ্যাডভেঞ্চার চলতেই থাকবে। আলভারেজরা থামে না। নানা বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে তারা মৃত্যুকে ছুঁড়ে দেয় বোহেমিয়ান, বাঁকা হাসি। এই বোহেমিয়ান স্বপ্নেই বুক বাঁধছেন  অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় তিন বাঙালি। ওমিক্রনের ধাক্কায় কঠোর নিয়ন্ত্রণবিধির পথে হাঁটছে দেশ। কিন্তু আমরা জানি অতিমারী একদিন ফুরোবে। আশার আলো জাগিয়ে কেটে যাবে বিপদ। আর ঠিক তখনই হয়ত দু'চাকার বাহনে ভর করে বেরিয়ে পড়বে চন্দন, রাহুল এবং অভীক। ফের ছুঁয়ে আসবে কোনও কল্পরাজ্যের সীমান্ত। ততদিন অপেক্ষা রইল।

More Articles