প্রতি ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ভারতে! প্রতি চার মিনিটে একটি মৃত্যু!

কোভিড পরিস্থিতিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুশোক এখনও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। বহু ভারতীয় পরিবারেই করোনা ভাইরাসের মারণ সংক্রমণ পরিজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনা যদি মড়কের আকার নেয়, তার থেকে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে!

২০২০ সালের মার্চে করোনা ভারতে হামলা চালানোর আগে থেকেই ফি-বছর অন্তত দেড় লক্ষ মানুষ পথ দুর্ঘটনার বলি হচ্ছেন। কিন্তু পথ দুর্ঘটনা, তার কার্যকারণ এদেশে তেমন চর্চিত বিষয় নয়। পথচারী থেকে শুরু করে যানবাহন চালক পথ দুর্ঘটনার ভয়াবহতা প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী নীতিন গড়করির একটি মন্তব্য এখানে স্মরণীয়। এই দেশে লাগাতারভাবে ঘটে চলা পথ দুর্ঘটনাগুলিকে 'করোনা অতিমারির থেকেও ভয়াবহ' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন গড়করি।

সরকারি হিসেব অনুসারে প্রতিবছর ভারতে অন্ততপক্ষে সাড়ে ৪ লক্ষ পথ দুর্ঘটনা ঘটছে। সারা পৃথিবীতে মোট যত সংখ্যক যানবাহন রয়েছে এদেশে তার মধ্যে মোটে ১ শতাংশ যানবাহন রয়েছে। অথচ সারা পৃথিবীতে যত সংখ্যক মানুষের পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়, এর ভিতর ১১ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনাই ঘটছে ভারতে।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পেশ করা তথ্যানুসারে, পথ দুর্ঘটনায় মৃত এবং আহতের সংখ্যার নিরিখে ভারতই বিশ্বের মধ্যে প্ৰথম স্থানাধিকারী দেশ।

পথ দুর্ঘটনা সম্পর্কে এই পরিসংখ্যান যে অত্যন্ত উদ্বেগজনক, তা বলাবাহুল্য। ভারতের রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় ৫৩টি পথ দুর্ঘটনা ঘটছে। আর প্রতি ৪ মিনিটে পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন একজন ভারতীয় নাগরিক।

পথ দুর্ঘটনা নৈমিত্তিকভাবে ঘটেই চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার এবং দেশের রাজ্য সরকারগুলি নানাবিধ সতর্কতা ও সচেতনতামূলক প্রচার চালানো সত্ত্বেও। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পেশ করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী,  ৪৩.৬ শতাংশ ক্ষেত্রে দুচাকার চালকরা দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন। এছাড়া ১৩.২ শতাংশ ক্ষেত্রে চারচাকা গাড়ি, ১২.৮ শতাংশ ক্ষেত্রে ট্রাক এবং ৩.১ শতাংশ ক্ষেত্রে যাত্রীবাহী বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে্।

বিভিন্ন সমীক্ষায় এও ধরা পড়েছে, গত এক দশকে ভারতে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে মোট ১৩ লক্ষ মানুষের। চোখ কপালে তোলার মতো এই দুর্ঘটনাগুলিতে আহত মানুষের সংখ্যাও। সবমিলিয়ে সেটা ৫০ লক্ষ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে ভারতের পথ দুর্ঘটনা নিয়ে পৃথকভাবে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। এরপর যে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে তাতেও ধরা পড়েছে উদ্বেগজনক তথ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ২০০৯ সাল থেকে পথ দুর্ঘটনায় প্রতি বছর যত সংখ্যক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, তাতে প্রথম স্থানে আমাদের দেশ ভারত। গোটা পৃথিবীতে পথ দুর্ঘটনায় প্রতি ১১জনের মৃত্যুর নিরিখে ভারতে মৃত একজন। এর অন্যতম কারণ ভারতে হু-হু করে বাড়ছে গাড়িঘোড়ার সংখ্যা। অথচ গাড়িঘোড়া চালানোর সময়ে পথ নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিধিগুলি অগ্রাহ্য করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন-৩৪ শতাংশ হারে ডিএ অন্তত ১ কোটি ১৫ লক্ষকে, হাতে পাবেন ঠিক কত টাকা!

পথ দুর্ঘটনায় মৃতদের মধ্যে ৭৬.২ শতাংশের বয়স ১৮ বছর থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে বলে জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা।

পথ দুর্ঘটনা নিয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্কও পৃথক সমীক্ষা চালিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যে তথ্য উঠে এসেছে ওই রিপোর্টে তা খানিকটা অবাক করার মতোই। বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, ভারত এবং বিশ্বের যে সমস্ত দেশের মানুষের রোজগার কম সেই দেশগুলিতে বার্ষিক পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা উন্নত দেশগুলির তুলনায় ৩ গুণ বেশি। এক্ষেত্রেও মূল কারণ পথ নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতার একান্ত অভাব।

এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী নীতিন গড়করি যদিও দাবি করছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে পথ দুর্ঘটনার জেরে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ শতাংশ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই দাবির কোনও সারবত্তা নেই তাও বলা যেতে পারে। কারণ প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্তেই মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনার বলি হচ্ছেন মানুষজন।

দেশের যে তিনটি রাজ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ পথ দুর্ঘটনার বলি হচ্ছেন সেই রাজ্যগুলির মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানাধিকারী রাজ্য যথাক্রমে তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরপ্রদেশ।

সবচেয়ে করুণ পরিস্থিতি এদেশের গ্রামীণ এলাকাগুলিতে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষা এবং সরকারের পেশ করা তথ্যেও এই ছবি ধরা পড়েছে। কিন্তু কেন শহরাঞ্চলের তুলনায় ভারতের গ্রামীণ এলাকায় পথ দুর্ঘটনার আধিক্য, এই প্রশ্নও স্বাভাবিক।

এদেশের গ্রামীণ এলাকার হাইওয়েগুলিতে অনবরত ঘটছে দুর্ঘটনা। একাধিক বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষালব্ধ তথ্যানুসারে, এর অন্যতম কারণগুলি হল গ্রামীণ এলাকাগুলির হাইওয়ে দিয়ে গাড়িঘোড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেলাগাম গতিতে চলাচল করছে। এছাড়া গ্রামবাসীরা পথ নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়-আশয়গুলি নিয়েও শহুরে এলাকার বাসিন্দাদের মতো ততটা ওয়াকিবহাল নন। ফলে গ্রামবাসীরা দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন অসতর্কতার কারণেই।

কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ এবং মহাসড়ক মন্ত্রকও একই কথা জানিয়েছে। এই মন্ত্রক এসম্পর্কে যে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গিয়েছে, সারা দেশে মোট যত সংখ্যক পথ দুর্ঘটনা ঘটছে এক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে ৬৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই পথ দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী স্টিয়ারিংয়ে বসে বেপরোয়া গতিতে গাড়িঘোড়া চালানোটা। এছাড়া আরেকটি কারণ হল এদেশের রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা। অন্তত ১৮ শতাংশ ক্ষেত্রে এও পথ দুর্ঘটনার অন্যতম মূল কারণ।

এদেশে পথ দুর্ঘটনায় প্রতি বছর লক্ষাধিক নাগরিকের মৃত্যু রুখতে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সরকারগুলির হাতে পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশও নেই। এর ফলেও পথ নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধিগুলি অবলীলায় অগ্রাহ্য করছেন চালকদের মধ্যে অনেকেই।

প্রকৃত সমস্যা হল সর্ষের মধ্যেই আছে ভূত। ট্র্যাফিক পুলিশের হাতে যান শাসনের গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত থাকলেও অনেকক্ষেত্রেই আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করার পরিবর্তে বেআইনিভাবে টাকাপয়সা লেনদেনের মাধ্যমে পথ নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইন-কানুনের রেয়াত না করে ওঁরা অভিযুক্তদের সাত খুন সাফ করে দিচ্ছেন। এও নতুন কোনও ঘটনা নয়। অনিয়মটাই অনেকের গা সওয়া হয়ে গিয়েছে।

দীর্ঘদিন যাবৎ জাতীয় স্তরে পথ নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে 'সেভ এ লাইভ ফাউন্ডেশন', 'অ্যারাইভ সেফ', 'ট্র্যাক্স'-সহ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবীদের মতে, পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্যে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনা করতে হবে। কেবলমাত্র আইন-কানুন কঠোর করে অভীষ্টলাভ হবে না। সবার আগে দরকার সচেতনতার প্রসার ঘটানো।

স্বেচ্ছাসেবীদের মতে, এই কাজের শুরুয়াত হতে পারে প্রাথমিক স্তর থেকে স্কুল পড়ুয়াদের পথ নিরাপত্তা নিয়ম-কানুনগুলি সম্পর্কে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া হলে। নিরাপত্তা সম্পর্কিত সাধারণ নিয়ম-কানুনগুলি সিলেবাসের অন্তর্গত করা উচিত।

কর্মব্যস্ত মানুষকে আপন ঘরের চৌহদ্দির বাইরে পা রাখতেই হয়। কিন্তু পথেই  দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণহানি অথবা গুরুতরভাবে আহত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে সাধারণত তা গোটা পরিবারকেই বিপদে ফেলে।

কারণ এদেশের অধিকাংশ পরিবারই দরিদ্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র মানুষের দেশে পথ দুর্ঘটনাকে 'পথের অভিশাপ'-এর সঙ্গে তুলনা করলে তা সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না।

More Articles