৭৫ বছরে একটি মাত্র আইন, ‘অমৃতকালে’ও পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে পরাধীনতার বেড়ি

সময় এগিয়েছে, নিজের দেশে তত বেশি করে দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে গিয়েছে মজুর/শ্রমিক শ্রেণি। মুক্তিসুধা কী বস্তু জানেনই না তাঁরা, বরং নিজের লোকেদের হাতেই বঞ্চিত রয়ে গিয়েছে।

‘চাষী মজুর দীন দরিদ্র সবাই মোদের ভাই,
একস্বরে বলব মোরা স্বাধীনতা চাই’॥

দিন ক্ষণ, শুভ মুহূর্ত নিয়ে তখনও কথাবার্তা চলছিল। মৃত্যুশয্য়ায় তা কানে গিয়ে থাকবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ১৫ অগাস্টের সূর্যোদয় দেখে যেতে পারেননি সুকান্ত ভট্টাচার্য়। নইলে ‘ভবিষ্যতে’র স্বপ্ন থেকে এই লাইন দু’টি বাদ দিতেন। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি বলে জীবনের ঠিক কোন পর্যায়ে কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন জানার উপায় নেই। কাকতালীয় ভাবে তাঁর মৃত্যু এবং ব্রিটিশ বিদায়ের মধ্যে ফারাক তিন মাস। তার পর ৭৭ বছর কেটে গেলেও, আজও ছিন্ন করা যায়নি ভেদের গ্রন্থি। বরং যত সময় এগিয়েছে, নিজের দেশে তত বেশি করে দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে গিয়েছে মজুর/শ্রমিক শ্রেণি। মুক্তিসুধা কী বস্তু জানেনই না তাঁরা, বরং নিজের লোকেদের হাতেই বঞ্চিত রয়ে গিয়েছে।

অভিধান বলছে, দৈহিক শ্রমের বিনিময়ে জীবন নির্ধারণ করেন যাঁরা, তাঁরাই শ্রমিক। কিন্তু স্বাধীন ভারতে শ্রমিক শ্রেণি আবার ভিন্ন পর্যায় সারণীতে ভাগ হয়ে গিয়েছে, যার সর্বনিম্নে রয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকের দল। তার মধ্যেও আবার ভাগ রয়েছে। রাজমিস্ত্রি, খাদান কর্মী, কারখানা শ্রমিক, আয়ের নিরিখে পরস্পরের থেকে আলাদা করা হয়েছে। তবে এঁদের প্রত্যেকের জীবনচরিত প্রায় এক। নিম্নবিত্ত পরিবার, ঠান্ডা ঘরে বসে ভাঙিয়ে খাওয়ার মতো বিদ্যে নেই পেটে, অল্প বয়সে কাঁধের উপর সংসারের দায়।কাছেপিঠে কাজ একটা জুটিয়ে ফেলা যায় বটে, কিন্তু তা দিয়ে একবেলার ভাত জোগাড়ই দুষ্কর। অগত্যা পাড়া-পড়শি, পরিচিতদের কাছে শুরু হয় অনুসন্ধান। বাইরে কাজে গিয়ে পাকা ছাদ তুলেছেন, মাটির উঠোন বাঁধিয়েছেন, এমন লোকের খোঁজ পড়ে। আবার শুধু সন্ধান মিললেই তো হল না, তার মন পাওয়াও জরুরি। তাতে চলে যায় কয়েক মাস। তার পর কোনও সন্ধেয় থার্ড ক্লাস টিকিটে ট্রেনে উঠে পড়া।

গ্রামের দিকে বা মফস্বলে বিশেষত, এক ঘর ছাড়া ছাড়াই বাইরে কাজ করতে যাওয়া ছেলের খোঁজ মেলে। কয়েক বছর আগে পর্যন্তও এই বাইরে কাজে যাওয়া ছেলের কথা বলতে গিয়ে বুক ভরে উঠত বাড়ির লোকজনের। কিন্তু গত দু’বছরে তা পাল্টে গিয়েছে দীর্ঘশ্বাস এবং অনুতাপে। কারণ করোনা না এলে, দেশে লকডাউন না হলে, বাড়ির বাইরে, কাছের মানুষের থেকে দূরে, জীবন এত মূল্যহীন তা হয়ত বোঝাই যেত না। এলিয়ে পড়া ঘুমন্ত শিশু সমেত চাকা লাগানো স্যুটকেস টানতে টানতে, মাথায় পুঁটলি চাপানো স্বামীর পিছু পিছু হাঁটতে দেখা গিয়েছে মহিলাদের। সন্তানকে কাঁধে তুলে ন্যুব্জ শরীরে টেনে এগোতে দেখা গিয়েছে বাবাকে। আবার রেললাইনে জিরিয়ে নিয়ে গিয়ে মালগাড়ির চাকায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া দেহের ছবিও উঠে এসেছে। পাশে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে সস্তার চটি, আর পোড়া রুটি।

হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও খবরে সেই দৃশ্য দেখে শিউড়ে উঠেছিলেন সাধারণ মানুষ। পরিশ্রান্ত মুখগুলি দেখে প্রশ্ন জেগেছিল, কী এমন টাকা দেয় যে এত দূরে যাওয়া! কাছেপিঠে যা পাওয়া যায় ভাল, আর বাইরে গিয়ে কাজ নেই বলে বাড়ির ছেলেকে নিদানও দিয়ে ফেলেছিলেন অনেকে। কিন্তু অভাবের জ্বালা কঁহাতক সওয়া যায়! তাই ডেল্টা, আলফা, ওমিক্রন পেরিয়ে ফের শুরু হয় বাইরে যাওয়া। তবে করোনার আগে এবং পরে সবই আগের মতো রয়েছে। মাস গেলে বাড়িতে টাকা পাঠানোর দায় রয়েছে। একচিলতে ঘরে ১০ জন মিলে মিলে মাথা গুঁজে থাকা, শুকনো রুটি ও গলাভাতে নামমাত্র পেট ভরানো, সবকিছু চলছে আগের মতোই। খবরে দেখা ভয়াবহ দৃশ্য আর তেমন নাড়া দেয় না কাউকে। বরং স্বাধীনতার অমৃতকালে কত কোটি পতাকা উড়ল, তার খোঁজ রাখায় আগ্রহ বেশি।

সরকারি হিসেব অনুযায়ী, লকডাউনে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাড়ি ফেরেন ১ কোটি ৪ লক্ষ মানুষ। এর মধ্যে ৩২ লক্ষ ৪৯ হাজার মানুষ উত্তরপ্রদেশ ফিরেছেন। বিহার ফিরেছে ১৫ লক্ষ মানুষ। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বা যাত্রাপথে অসুস্থ হয়ে কত জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, গত দু’বছরেও তার উত্তর মেলেনি। বরং সংসদে দাঁড়িয়ে নির্বিকার চিত্তে সরকার যে জবাব দেয়, তার মর্মার্থ হল, এক জায়গায় থেকে অন্যত্র পরিযায়ী শ্রমিকদের আনাগোনা লেগেই থাকে বছরভর। আজ এক জায়গায়, তো কাল অন্য জায়গায়। তাই এত সংখ্যক মানুষের হিসেব রাখা সম্ভব নয়। আচমকা লকডাউনে কত জন কাজ হারিয়েছেন, তার হিসেবও রাখেনি সরকার।

আরও পড়ুন-আইনি স্বীকৃতি মিলেছে, ‘ছক্কা’ ডাকা বন্ধ হবে কবে?

তবে সংসদে হিসেব না দিলেও, সমাজকর্মী শেখর গৌড় তথ্য জানার আইনে আবেদন করলে রেলওয়ে বোর্ডের তরফে জানানো হয়, ২০২০-র জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ট্রেনে চাপা পড়ে ৮ হাজার ৭৩৩ জন প্রাণ হারান, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন পরিযায়ী শ্রমিক। আগে থেকে কিছু না জানিয়ে লকডাউন ঘোষণা করাতেই দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে উদ্যত হন। তাই বিশৃঙ্খলার যে ছবি উঠে আসে, তার জন্য বিরোধীদের দায়ী করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভাড়ার টাকা হাতে ধরিয়ে বিরোধী শিবিরের নেতারা কিছু জায়গায় পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফিরতে উস্কানি জুগিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। কিন্তু লকডাউনে কারখানা, শিল্প, নির্মাণ, খাদান, সব যখন বন্ধ, সেখানে বাড়ি না ফিরলে দিন আনি দিন খাই মানুষগুলি বিনা রোজগারে দু’বেলা পেট চালাতেন কী করে, তার উত্তর দেননি তিনি।

পরিস্থিতি সামাল দিতে এর পর কয়েক মাস বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার প্রকল্প চালায় কেন্দ্র। দেশে তো বটেই, তা নিয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়েও প্রচার চলে বিস্তর। কিন্তু সেই নিয়েও ভূরি ভূরি অভিযোগ সামনে এসেছে। রাজ্য সরকারগুলিকে না জানিয়ে প্রকল্পের বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একাধিক রাজ্যকে বর্ধিত বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ যেমন উঠেছে, তেমনই ভোটমুখী রাজ্যগুলিতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর হয়েছে সুকৌশলে। তার জেরে বেশ কিছু রাজ্যকে নিজের টাকায় বিনামূল্যে রেশন প্রকল্প চালিয়ে যেতে হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও এই দায় ঠেলাঠেলি চোখে পড়েছে। বিভিন্ন রাজ্যের সরকারের ব্যর্থতার জন্যই দলে দলে মানুষকে অন্যত্র কাজের সন্ধানে যেতে হয়েছে বলে কেন্দ্রের তরফে অভিযোগ তোলা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়িয়ে কেন্দ্রকেই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ করতে হবে বলে পাল্টা জবাব দেয় রাজ্যগুলি।

এর পরই কেন্দ্রের তরফে ই-শ্রম পোর্টালের ঘোষণা করা হয়। অসংগঠত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করতে বলা হয় তাতে, যা আসলে একটি ডেটাবেস। তার আওতায় ই-শ্রম কার্জ, সামাজিক নিরাপত্তা এবং মাথাপিছু ২ লক্ষ টাকার দুর্ঘটনা বিমা দেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনে অর্থসাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। এর মধ্যে কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ১৪ কোটি ৭০ লক্ষের বেশি। গৃহ সহায়ক অথবা সহায়িকার কাজের জন্য নাম নথিভুক্ত করেছেন ২ লক্ষ ৭৭ হাজারের বেশি মানুষ। নির্মাণক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত ২ কোটি ৫৬ হাজারের বেশি মানুষ নাম নথিভুক্ত করেছেন। সবথেকে বেশি সংখ্যক নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে উত্তরপ্রদেশ থেকে, প্রায় ৮ কোটি ২৯ লক্ষ। দ্বিতীয় স্থানে বিহার, প্রায় ২ কোটি ৮৪ লক্ষ এবং তৃতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। প্রায় ২ কোটি ৫৬ লক্ষ মানুষ নাম নথিভুক্ত করেছেন ই-শ্রম পোর্টালে। নাম নথিভুক্ত করিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে ৪৭.১৬ শতাংশ পুরুষ। মহিলা ৫২.৮৩ শতাংশ।

কিন্তু একদিকে ই-পোর্টালে শ্রমিক শ্রেণিকে সামাজিক নিরাপত্তার আশ্বাস দিলেও, একশো দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ লাগাতার কমিয়ে চলেছে সরকার। ফলে কাজের সুযোগ কমছে। তাতে রোজগারের সন্ধানে ভিন্ রাজ্যে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না শ্রমিক শ্রেণির কাছে। এ বছরের বাজেটে ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ৭৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র, যা ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে যতটা অনুমান করা হচ্ছিল, তার চেয়ে ২৫.৫১ শতাংশ কম। করোনা কালে, পরিযায়ী শ্রমিক সঙ্কটের সময়ও ১০০ দিনের কাজে কেন্দ্রের বরাদ্দ ছিল ৭৩ হাজার কোটি টাকাই। শেষ মেশ যদিও সব মিলিয়ে ৯৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হয় কেন্দ্রের। অথচ ২০২০-’২১ অর্থবর্ষে ১০০ দিনের কাজে বরাদ্দ টাকার পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ১১ হাজার ১৭০ কোটি টাকা।

একই সঙ্গে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগও উঠেছে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। নিয়ম অনুযায়ী, আবেদন জানানোর ১৫ দিনের মধ্যে কাজ পাওয়ার কথা। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বেকারত্ব ভাতা দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাজেটে ঘাটতি দেখিয়ে তা দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ। সেই নিয়ে দিল্লি-সহ একাধিক রাজ্যে বিক্ষোভেও নামেন সাধারণ মানুষ। মামলা পৌঁছয় আদালতেও। শুধু তাই নয়, প্রকল্পের আওতায় কাজ পাচ্ছেন যাঁরা, তাদের মজুরি দিতেও সরকারের তরফে ঢিলেমি হচ্ছে বলেও ভূরি ভূরি অভিযোগ সামনে এসেছে। সেই নিয়ে অতি সম্প্রতিই দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১০০ দিনের প্রকল্পেই শুধু কেন্দ্রীয় সরকার ৬ হাজার ৫৬১ কোটির বেশি টাকা বাকি রেখেছেন বলে জানান তিনি।

এর ফলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ, যাঁরা ১০০ দিনের কাজের উপরই নির্ভরশীল, তাঁদের পাওনা মেটানো যাচ্ছে না বলে জানান। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে দেখা যায়, গত অর্থবর্ষে ১০০ দিনের প্রকল্পে ২ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা মজুরি বাবদ বাকি রেখেছে কেন্দ্র। ১০০ দিনের প্রকল্পের বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া, মজুরি বাকি রাখার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। একদিকে খুচরো মূল্যবৃদ্ধি যখন চরমে, উৎপাদন কমেছে বহুলাংশে, দৈনিক কাজ জুটিয়ে উঠতে পারছেন না শ্রমিকরা। ফলে লকডাউনে বাড়ি ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকরা ফের ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

করোনা কালে পরিযায়ী শ্রমিকদের যে দুর্দশার ছবি উঠে এসেছে, তা যদিও কাম্য ছিল না। কারণ ভিন্ রাজ্যে কাজে যাওয়া মানুষকে নিরাপত্তা প্রদানে দেশে আগে থেকেই বেশ কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে। ১৯৭৯ সালে ‘ইন্টার স্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়র্কমেন (রেগুলেশন অফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট কন্ডিশনস অফ সার্ভিস) অ্যাক্ট পাস হয়। কোনও সংস্থায় ভিন্ রাজ্য থেকে আসা কর্মীর সংখ্যা পাঁচ বা তার বেশি হলে ওই আইন প্রযোজ্য ছিল। সাম্প্রতিক কালে ‘অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়র্কিং কন্ডিশনস কোডের ২০২০’-র অন্তর্ভুক্ত করা হয় ওই আইনকে। ‘অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়র্কিং কন্ডিশনস কোডের ২০২০’ যদিও এখনও পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। কিন্তু তাতে ভিন্ রাজ্য থেকে আসা কর্মীর ন্যূনতম পাঁচ থেকে বাড়িয়ে ১০ জন বা তার বেশি করে দেওয়ার কথা বলা রয়েছে। সংসদের দুই কক্ষে পাসের পর, রাষ্ট্রপতির সিলমোহরও পড়ে গিয়েছে। ফলে ভিন্ রাজ্য থেকে কর্মী নিয়োগ কমিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা। তাতে পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কমছে। আবার অর্থনৈতিক সঙ্কটের জেরে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে কোথাও স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য চাকরি সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে, কোথাও আবার তার প্রস্তাব জমা পড়েছে। নিজেদের রাজ্যের মানুষের জন্য বেসরকারি ক্ষেত্রেই ৭৫ শতাংশ চাকরি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে হরিয়ানা।

২০১৩ সালে ইউনেস্কো এবং ইউনিসেফ-এর রিপোর্টে ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় সুষ্ঠ প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সঠিক আইনি পরিকাঠামো থাকা প্রয়োজন বলে জানায় তারা। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা এবং শ্রম সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রকল্প এখনও পর্যন্ত কেরলই ঠিকঠাক কার্যকর করতে পেরেছে এবং দিল্লিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা সবচেয়ে হতাশাজনক বলে ২০২০-র একটি সমীক্ষায় ধরা পড়ে। তবে এ নিয়ে কেন্দ্রের তরফে কোনও উদ্যোগই চোখে পড়েনি। পরিযায়ী শ্রমিকের সঠিক সংখ্যা জানতে শেষ বার ২০০৭-’০৮ সালে সমীক্ষা হয়। কমপক্ষে ছ’মাস কোনও জায়গায় রয়েছেন যাঁরা, তাঁদের নিয়েই করা হয় ওই সমীক্ষা। তাতে ২৯ শতাংশ মানুষই পরিযায়ী শ্রমিক ছিলেন।

২০১১ সালে কর্মসূত্রে এক রাজ্য থেকে অন্যত্র যাওয়ার বিশদ তথ্য সংগ্রহ করা হলেও, ২০২০ সালের তার আংশিক প্রকাশ করা হয়। আর ওই বছরই সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে কেন্দ্র জানায়, লকডাউনে দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার জেরে কতজন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, কতজন কাজ হারিয়েছেন, সেই সংক্রান্ত কোনও তথ্য নেই তাদের কাছে।তাই ওই বছর ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের একটি রিপোর্টে বলা হয়, ‘জাতীয় এবং আঞ্চলিক স্তরে ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকরা নগণ্য এবং অস্বীকৃতই রয়ে গিয়েছেন। প্রশাসনের সব স্তরে নির্ভরযোগ্য তথ্য এবং পরিসংখ্যান থাকলে, তবেই সরকারি এবং কর্মীদের মধ্যে সংযোগ গড়ে তোলা সম্ভব। সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং নীতি আয়োগের তরফেও তথ্য এবং পরিসংখ্যানের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
শুধু ভিন্ রাজ্যে কাজের সন্ধানে যাওয়া মানুষই নন, কাজের সন্ধানে নিজের রাজ্যেই ইতিউতি ছুটে চলা পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তার উপরও জোর দেওয়ার সময় এসেছে। কারণ ২০২১ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস জানায়, ২০২০-’২১ অর্থবর্ষে কর্মসূত্রে নিজের রাজ্যের ইতিউতিই স্থানান্তরণ চোখে পড়েছে ৮৭.৫ শতাংশ। সেই তুলনায় ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেন ১১.৮ শতাংশ মানুষ। দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা রাখতে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু স্বাধীনতার পর এ যাবৎ তাঁদের নিরাপত্তার জন্য ১৯৭৯ সালে একটি মাত্র আইনই তৈরি হয়েছে। পরিযান শব্দের অর্থই চলনশীলতা, স্থানান্তরণ। অর্থাৎ পুঁজি তাঁদের খোঁজে আসবে না, বরং পরিযায়ী শ্রমিকই পুঁজির কাছে এসে পৌঁছবে। অথচ তাঁদেরই রোজগার সুনিশ্চিত নয়, দীর্ঘমেয়াদি কাজের নিরাপত্তা নেই, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধা, প্রাপ্য ছুটি, সবকিছু থেকে বঞ্চিত তাঁরা। তাই স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উদ্‌যাপন যতই ঝলমলে হোক না কেন, সরকার এবং কর্পোরেট সংস্থার বোঝাপড়ার জাঁতাকলে আজও পিষ্ট হয়ে চলেছেন দেশের একটা বড় অংশের মানুষ।

More Articles