অর্ধশতাব্দী ধরে রেডিয়োতে চলছে যে রাগ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান

একটা সময় ভারতের জনজীবনে একটি বড় অংশ দখল করে থাকতো অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো। সকালে দেবকী নন্দন পাণ্ডের গুরুগম্ভীর গলায় সংবাদপাঠ কানে নিয়ে অফিসের জন্য তৈরি হওয়া হোক, কিংবা হাওয়া মহল শুনতে শুনতে নৈশভোজ, অল ইন্ডিয়া রেডিয়‌ো ছিল সত্তর কিংবা আশির দশকের বিনোদনের একমাত্র দিশারী। বিবিধ ভারতীতে সম্প্রচারিত সংগীত সরিতাও এরকমই একটি শো ছিল যেটা একটা সময় প্রত্যেক ভারতীয়কে মশগুল করে রাখতো ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজিকের জাদুতে। প্রতিদিন সকাল ৭.৩০ টা থেকে ৭.৪৫টা পর্যন্ত সম্প্রচারিত এই গানের অনুষ্ঠান একটা সময়ে হয়ে উঠেছিল অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর সবথেকে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের মধ্যে একটি।

সঞ্চালক কাবান মির্জার দৃপ্ত কণ্ঠে 'সঙ্গীত সরিতা'-র মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। তারপরেই বেজে ওঠে গজরাত বর্সাত সাওয়ান গানের থেকে নেওয়া রাগা মলহারের একটি নোট। ১৫ মিনিটের এই গানের অনুষ্ঠানটি অনেকের কাছে ভারতীয় ক্লাসিকাল মিউজিকের একটি ডেইলি ক্যাপসুলের মতই। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বিবিধ ভারতীতে সম্প্রচারিত এই গানের অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের জন্য থাকে ভারতীয় রাগ সংগীতের মূর্ছনা, রাগাশ্রয়ী গানের স্বনামধন্য শিল্পীদের সাথে হালকা কথোপকথন, অসাধারণ সঞ্চালনা এবং সর্বোপরি সিনেমায় ব্যবহৃত রাগ সংগীতের কিছু ঝলক যা আপনাকে ভারতীয় সংগীতের মণি-মানিক্যের সাগরে নিমজ্জিত করতে সক্ষম।

এই শো নিয়ে অনেকের মনেই রয়ে গেছে অনেক নস্টালজিক কাহিনী। শিবকুমার শর্মার সন্তুরের প্রত্যেকটি নোট এখনো অনেকের মনে একইরকম নবীন। গিরিজা দেবীর তার গুরুকে নিয়ে বলা কথাগুলি এখনো অনেকের মনে আছে। ৭০ কিংবা ৮০র দশকের মানুষদের জন্য এই সংগীত সরিতা ছিল প্রত্যেকদিনের রুটিনের একটি অংশ। প্রত্যেক ভক্তের এই সংগীত সরিতা নিয়ে আলাদা আলাদা স্মৃতি রয়েছে। প্রখ্যাত তবলাবাদক বালকৃষ্ণ আইয়ারের কথায়, "আমি প্রত্যেকদিন সকালে ৭.৩০ এর আগে কলেজের জন্য তৈরি হয়ে যেতাম। তারপর ৭.৪৫ টা পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানটি দেখেই সাইকেলে চড়ে দিতাম দৌড়। সকাল ৮টার ক্লাসটা করার জন্য আমাকে প্রচন্ড করে সাইকেল চালাতে হতো, হয়তো কয়েকদিন এমনও হয়েছে আমি যেতে পারিনি সময়ে। কিন্তু তবুও আমি সংগীত সরিতা শুনিনি এরকম হয়নি।"

২০১৩ সালে আইয়ার এই সঙ্গীত সরিতা অনুষ্ঠানের উপরে একটি ২১ এপিসোডের সিরিজ তৈরি করেন, যা তখন বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তার অনুষ্ঠানটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, তাঁকে আমেদাবাদে আমন্ত্রণ পর্যন্ত জানানো হয়েছিল সম্মান প্রদর্শনের জন্য। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হওয়া এই গানের অনুষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন জনপ্রিয় ওড়িয়া বেহালাবাদক ভুবনেশ্বর মিশ্রা। ১৯৭৩ সালে তিনি বিবিধ ভারতীর সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি সব সময় চেয়েছিলেন ভারতীয় রাগাশ্রয়ী সংগীত নিয়ে কিছু একটা অনুষ্ঠান করতে। অবশেষে, এই দশকের মাঝামাঝি কোনও একটা সময় থেকে তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত সঙ্গীত সরিতা অনুষ্ঠানটির সম্প্রচারণ শুরু করে অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো।

পণ্ডিত রবিশঙ্কর থেকে শুরু করে, পান্নালাল ঘোষ, তিমির বরণ, রঘুনাথ শেঠ, সুলতান খান, রাম নারায়ন, আল্লা রাক্ষা অনেকেই এই অনুষ্ঠানে একাধিকবার নিজেদের সঙ্গীত পরিবেশনা করে গিয়েছেন। নিত্যানন্দ হলদিপুরীর কথায়, "সেই যুগে সঙ্গীত বলতে ছিল শুধুমাত্র হিন্দি গান এবং সিনেমায় ব্যবহৃত গান। কিন্তু সংগীত সরিতা ভারতের মানুষের কাছে ভারতীয় রাগাশ্রয়ী সংগীতকে পৌঁছে দিল। ভারতীয় ক্লাসিকাল মিউজিককে চিনতে শুরু করলো সমস্ত ভারতবাসী। ক্লাসিকাল সঙ্গীতের হিট গানের রাগ সঙ্গীতের নোটের মেলবন্ধনে সঙ্গীত সরিতা হয়ে উঠল সে যুগের সবথেকে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের মধ্যে একটি।"

তবে আমাদের বর্তমান জীবনে রেডিওর চল প্রায় নেই বললেই চলে। সঙ্গেই, আকাশবাণী কিংবা বিবিধ ভারতীর মত চ্যানলগুলির দর্শক সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা। তাই, সঙ্গীত সরিতা অনুষ্ঠানের নতুন এপিসোডও আর রেকর্ড হয়না। কিন্তু এই কালজয়ী অনুষ্ঠানকে এখনো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়নি অল ইন্ডিয়া রেডিও। সময়টা হয়তো পরিবর্তিত হয়েছে। সকাল ৭.৩০ টার পরিবর্তে এখন সকাল ৬.৩০ এ এই শো আপনারা শুনতে পান। পুরনো এপিসোড চালিয়েই কোনমতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে ভারতীয় রেডিওর জগতের একসময়ের সবথেকে জনপ্রিয় এই অনুষ্ঠানটি। কিন্তু এখনো এই অনুষ্ঠানের কিছু দর্শক রয়ে গিয়েছেন কোথাও না কোথাও। যারা এই অনুষ্ঠানটিকে মন থেকে ভালবাসতেন, তারা এখনও এই অনুষ্ঠান নিয়মিত দেখেন। অল ইন্ডিয়া রেডিওর ইউটিউব চ্যানেলেও এই অনুষ্ঠানের কিছু আর্কাইভ করা পুরনো এপিসোড আপলোড করা হয়েছে। সংগীতশিল্পী সুভা মুদগলের বর্ষা চৌমাসা সিরিজটি ইউটিউবেও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।

অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর বিবিধ ভারতী মুম্বই থেকে সম্প্রচারিত সঙ্গীত সরিতা অনুষ্ঠানটি মূলত ভারতীয় রাগাশ্রয়ী সংগীতের তিনটি দিক নিয়ে কাজ করতো। প্রথমটি হল, ভারতীয় রাগ সংগীতের সবথেকে জনপ্রিয় সুর. দ্বিতীয়টি হল, অল ইন্ডিয়া রেডিওতে রাগ সঙ্গীতের শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনের ইচ্ছা। তৃতীয়টি হল, বলিউড এবং ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের একটি মেলবন্ধন। কিন্তু বর্তমানে, রাগাশ্রয়ী সংগীতের এই তিনটি দিকের মধ্যে কোনটি নিয়েই তেমন কোনও চর্চা হয় না। একটা সময় ছিল, যখন, ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের শিল্পীদের সবথেকে সম্মানজনক আখ্যার মধ্যে একটি ছিল "রেডিয়ো শিল্পী"। কিন্তু এখন সেই আখ্যার গুরুত্ব প্রায় নেই বললেই চলে।

দুঃখের বিষয়, এখন এই অনুষ্ঠান তেমন কেউ শুনতে চান না। একটা সময়ে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, পান্নালাল ঘোষ, শিবকুমার শর্মা, টি কে জয়ারামান, আল্লা রক্ষা, সরস্বতী রাজাগোপালানের মতো বর্ষীয়ান সঙ্গীতশিল্পীরা এই অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর প্রবাদপ্রতিম সঞ্চালক ইউ এল বড়ুয়ার লেখা একটি বই ' দিস ইজ অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো '-তে আমরা দেখেছিলাম, শুরুর দিকে অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো ভারতীয় শ্রোতা এবং সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে আসলে ঠিক কত তীব্র আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল!

সেই সময়ে রেডিয়োর সবথেকে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলি ছিল মূলত গানের অনুষ্ঠান। সিনেমার গান, সঙ্গীত সরিতা, ছায়াগীতের মত অনুষ্ঠানগুলি তখনকার মানুষের রোজনামচার অংশ ছিল। উত্তর ভারতে ভারতীয় ক্লাসিকাল মিউজিকের শ্রোতা ৩০ শতাংশের কাছাকাছি হলেও দক্ষিণ ভারতে এই সংখ্যাটা ৬০ শতাংশের বেশি থাকতো। জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী বিদ্যাধর ব্যাসের কথায়, "সেই সময় ৭০-এর দশকে রেডিয়ো আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সকাল ৭.৩০-টায় মাত্র ১৫ মিনিটের এই সঙ্গীত সরিতা অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য সারা ভারত অপেক্ষা করতো।"

রাগাশ্রয়ী সংগীতের সঙ্গে তৎকালীন বলিউডের গান- প্রতিদিন সকালে একেবারে স্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়তো সারা ভারতে। অফিসের ক্যান্টিনের আড্ডা হোক কিংবা সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে চা-সিগারেটের সুখটানে বন্ধুদের খোশগল্প, সব কিছুতেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকতো সঙ্গীত সরিতা। সম্পূর্ণ রাগাশ্রয়ী সঙ্গীতের উপর নির্ভরশীল একটি নির্ভেজাল অনুষ্ঠান হলেও বিবিধ ভারতীর অন্যান্য কমার্শিয়াল অনুষ্ঠানগুলিকে সম্পূর্ণরূপে টক্কর দিতে সক্ষম ছিল সংগীত সরিতা। ভুবনেশ্বর মিশ্র অবসর নেওয়ার পরে ১৯৮৫ সালে এই অনুষ্ঠানটির দায়িত্বগ্রহণ করেন ছায়া গাঙ্গুলী। তাঁর সময়কালে এই অনুষ্ঠানে আরও কিছু নতুন ধারার গানের আগমন ঘটে। ছায়া গাঙ্গুলী নিজেও ছিলেন একজন গজল গায়িকা। তিনি দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে এই অনুষ্ঠানটির প্রযোজনার কাজ সামলেছেন। ছায়া গাঙ্গুলীর পরে আরো বেশ কিছু নতুন মুখ আসেন সঙ্গীত সরিতা অনুষ্ঠানের প্রযোজক হিসেবে। কাঞ্চন প্রকাশ সংগীত এবং মনীষা জৈনের মত প্রখ্যাত প্রযোজকরাও এই অনুষ্ঠানটির হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু, ৯০ এবং ২০০০ এর দশকের বলিউডের গানের অতি জনপ্রিয়তার মাঝে দাড়িয়ে রাগ সঙ্গীতের একটি অনুষ্ঠানের পক্ষে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা খুব একটা সম্ভব ছিল না।

More Articles