ময়ূরাক্ষীর গল্প

না, আমি কোনও লেখক কিংবা কবি নই, নেহাতই সাধারণ একজন খেটে খাওয়া মানুষ- যার জীবনে প্রায় বত্রিশ বছর তীব্র লড়াই করার পর একটু হলেও সচ্ছলতা এসেছে। সচ্ছলতা বলতে ছোট একটা গাড়ি, নিজস্ব ফ্ল্যাট, আর সংসার যেমন হয়, বউ-ছেলে, তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে চলা। জীবনের নানা ওঠানামা, অ্যাডজাস্টমেন্ট ইত্যাদি একঘেয়ে গল্প তো আছেই। সে সব বলতে গেলে একটা মহাভারত লিখতে হবে, আর আমার এই অপেশাদারী ভাষায় ও সব হয় না। তবে জীবনের প্রথম লেখা গল্পটা প্রথম শোনাবো ভাবছি আমার বউকে, সে বেচারা একটু লম্বা কিছু শোনাতে গেলে, তা সে আমার জীবনের যে কোনও অতীত কথা কিংবা অফিসের যে কোনও কাহিনি, খুব উৎসাহ নিয়ে শুনতে শুরু করে, আমিও বলতে শুরু করি, তার একটু পরেই তাকালে আপনিও স্পষ্ট দেখবেন ও ঘুমোচ্ছে, একটু খেয়াল করলেই শুনতে পারবেন ফুরফুর করে নাকও ডাকছে ওর; আমি হয়তো জানতে চাইলাম, কী গো শুনছো? ও একটু জড়ানো গলায় বলবে, শুনছি তো, খুব মন দিয়ে শুনছি, তুমি বলো না, বলো!

দেখলেন তো এই এক দোষ আমার মতো লোকের, কিছু বলতে গেলেই সংসারী মানুষ সংসারে ঢুকে পড়ে আর বউয়ের কথা বলতে শুরু করলে শেষ করতে পারে না। ওই জন্যই তো আগেই বলেছি লেখক নই, লেখক হলে নিশ্চয়ই এ ধরনের ভ্যানতাড়া দিয়ে গল্প শুরুই করতাম না!

অনেক দিন আগে পুরীর সমুদ্রের সামনে রাতের দিকে আমি আর আমার বন্ধু গৌতম দুটো আমাদের বয়সী মেয়েকে পটাতে গিয়েছিলাম। তখন অল্প বয়স, আর গৌতমের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করেছি ওর পছন্দের মেয়েটির সঙ্গে ওর আলাপ করাবো। গেলাম। দু'জন যুবতী, দু'জন যুবক। গৌতমের পছন্দের মেয়েটি ছাড়া আর যে মেয়েটি সে  কুচকুচে কালো তবে মুখশ্রী ভারী সুন্দর। ভালো লাগল আমারও। একটু কাব্য করে বললাম , আমার না বলা বাণী ঘন যামিনীর মাঝে... ওরা বেশ ইমপ্রেসড হল, তারপরেও অনেক দিন সম্পর্ক ছিল। তারপর কেটেও গেল একদিন, কিন্তু যে কথাটি বলবার সেটি হল কয়েক দিন আগে করোনা ভাইরাস তাড়িত লকডাউনের একঘেয়েমি কাটাতে  গীতবিতানের পাতা খুলে দেখি সেখানে লেখা আছে , আমার না বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে... ওই একটি 'র' মিস করার জন্য এতদিন পরেও আমার কেমন খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, মেয়ে দু'টি কি আমার ওই সামান্য ভুল বুঝতে পেরেছিল তখন! সমুদ্রের সামনে আমি একটি ভুল পংক্তি উচ্চারণ করেছিলাম। এ জন্য ওরা কি হাসাহাসি করেছে পরে ? যদিও এ সব ভাবনার কোনও অর্থই হয় না, ওদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বহু দিন, তবু আমি ভাবছি !

পৃথিবী এখন প্রবল অনিশ্চয়তায় দুলছে। একটি প্রায় অদৃশ্য ভাইরাস মানবজীবনকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। অন্তত আমার মতো সাধারণ মানুষের সেটাই মনে হচ্ছে। যদিও এই ভাবনার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। আর আমরা তো বর্তমান-কণ্টকিত মানুষ। প্রায় দিন আনি দিন খাই-এর দলে। এই অতিমারির সময়ে এই দলের যে কী করুণ অবস্থা, তার খবর কে রাখে!

এতক্ষণে  নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে আমার অপারগতা। গল্প বলার যে স্টাইল পাঠককে টেনে রাখে, সামনের দিকে নিয়ে যায় তা বপন করে চলা আমার পক্ষে অসম্ভব। যদিও অন্যদের গল্প পড়তে পড়তে অনেক সময়েই আমার মনে হয়েছে লেখক গল্পটা বানাচ্ছে, কিন্তু তাঁর লেখনির অসামান্য প্রসাদগুণ গল্পকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে পরিণতির দিকে। আমি সেটা পারছি না; কিন্তু আমার মধ্যে উঁকি দিয়েছে একটি গল্প লেখার ইচ্ছা, সেখানেও ঢুকে পড়ছে অন্য অপ্রাসঙ্গিক বিষয়। যে কথাটি বলবার জন্য এত উদ্যোগ সেটা এখনও শুরুই করতে পারিনি, সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে আমি কেমন গল্প-লিখিয়ে! তবু বলি।

ময়ূরাক্ষীর সঙ্গে  ফোনে কথা হচ্ছিল। মেয়েকে নিয়ে থাকে। মেয়েটা ছোট। নাইনে পড়ে। ময়ূরাক্ষী এক সময়ে প্রেম করে মা-বাবার সম্পূর্ণ অমতে বিয়ে করেছিল দেবায়নকে। আর বিয়ের পর-পরই বাস্তবের প্রচন্ড ধাক্কা, সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া দেবায়ন ওর স্বপ্নকে ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়েছিল। বিধ্বস্ত ময়ূরাক্ষী অনেক রাতে বেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। সুনসান রাস্তায় স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া মন নিয়ে হাঁটছিল। একটু দূরেই একটা সেতু। সেতুটা নীচে থেকে ঢাল বেয়ে উঠে গেছে উপরে। সেতুর অনেকটা নীচে ছুটে গেছে রেললাইন। একটা আলো টিমটিম করে জ্বলছে সেতুর মুখটাতে । ময়ূরাক্ষী জানত সেতুর মাঝামাঝি কোনও আলো নেই , তবু ও এগোচ্ছিল। কেননা একটু পরেই ওই রেললাইন ধরে ছুটে যাবে মেল ট্রেন... ময়ূরাক্ষী হাঁটছিল । একটা প্রাইভেট কার হুশ করে ওর পাশ দিয়ে বেরিয়ে সেতুর মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। খুব দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ল তিনটে ছেলে, ওরা দৌড়ে আসছিল ময়ূরাক্ষীর দিকে। ডান দিকে একটা গলি। সেই গলিতে ঢুকে পড়ল ময়ূরাক্ষী। ছেলেগুলো ছুটে আসছিল। একটু দূরে ভাঙা দেওয়াল, কারও বাড়ির। ঝোপঝাড় আছে জায়গাটায়, তারই আড়ালে ঢুকে পড়ল ময়ূরাক্ষী। ছেলেগুলো ওকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছিল খুব কাছাকাছি... ঠিক তখনই ঝমঝম করে মেল ট্রেনটা পেরিয়ে যাচ্ছিল রেললাইন। একটা দীর্ঘশ্বাস ময়ূরাক্ষীর বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে মিশে গিয়েছিল অন্ধকারে। সেই যে অন্ধকারে চলে যাওয়া, তা থেকে আজও বেরোতে পারে না ও। সারারাত ঘুম আসে না। মেয়েটা অকাতরে ঘুমোয়। ময়ূরাক্ষীর মনেই পড়ে না শেষ কবে সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে।

আসলে নিজের কথা ছেড়ে ময়ূরাক্ষীর কথা বলবার একটাই উদ্দেশ্য সেটা হল গল্প বলা। কিন্তু আমি যেটা শোনাচ্ছি তার এক বর্ণও বানানো কিংবা অতিরঞ্জিত নয়। ময়ূরাক্ষীর জীবন। ও রকমই ঘটেছিল ওর জীবনে এবং বিয়ের পরে পরেই। ওর ডিভোর্স হয়ে যাবার বহু বছর পরে আমি তা শুনেছিলাম। যেটা আমার সব থেকে আশ্চর্য লেগেছিল সেটা হল ওর বলবার স্টাইল, গতিশীলতা।এতগুলো বছর পেরিয়ে জীবনের আরও নানা অভিজ্ঞতায় চেরাই হতে হতেও আজও  সেই দিনের সেই স্মৃতি এক বর্ণ ভোলেনি ও। একটুও মলিন হয়নি সেই রাত ওর কাছে, চোখ বুজলেই  সেই রাতটাকে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পায়। দেবায়ন এখনও পুরনো হয়নি ওর মনে, আশ্চর্য!

-কী করছ গো ?

বউ মোবাইলে উঁকি মারল। আজকাল  আমাকে একটু সন্দেহ করে।

বললাম, গল্প লিখছি। শুনবে?

হাঁ করে আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, তোমার মতো কাঠখোট্টা লোক গল্প লিখবে ?

ওর বিস্মিত দৃষ্টি থামিয়ে দিয়ে বললাম, ইয়েস, একটা আস্ত গল্প!

বউ বলল, আজকাল অবশ্য ফেসবুকে অনেকেই গল্প-কবিতা লেখে। দেখেছি। খুব একটা পড়া হয় না।

আমি একটু গম্ভীর মুখে ওর কথা শুনছিলাম। লেখকরা একটু গম্ভীর প্রকৃতির হলেই মানায় ।

হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে কৌতুক মিশিয়ে বউ জানতে চাইল, তা তোমার গল্পটা নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে!

আমি একইরকম গাম্ভীর্য মাখানো স্বরে বললাম, না, তোমার নয়। এটা ময়ূরাক্ষীর গল্প।

More Articles