যেখানে উৎসবের জৌলুস নেই

কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। কিন্তু দুর্গাপুজো সেই সবের মধ্যে নির্দ্বিধায় সবার ওপরে জায়গা পায়। দুর্গা পুজো আপামর বাঙালি জাতির কাছে আলোর উৎসব, খুশির উৎসব। কিন্তু এই পুজোর আরেকটা দিক আছে। যা আমাদের চোখের সামনে থেকেও চোখে পড়ে না, যা নিয়ে ভাবার সময় হয়তো সবার হয়ে ওঠে না। যেমন সাদার বিপরীত কালো, যেমন ভালোর উল্টোদিকে মন্দ থাকে, তেমনই আলোর অপর দিকে থাকে অন্ধকার।

বছরের এই চারটে দিনের জন্য যখন একটু একটু করে সেজে উঠতে থাকে কলকাতা, আশেপাশের মফসসল, ছোট-বড় শহর, গ্রাম, ঠিক সেভাবেই এই রাজ্য থেকে অনেক দূরে কোনও ভিন্ন ভাষায় কথা বলা রাজ্যের বুকে কোনও বাঙালি বরণ করে ঘরে আনেন প্রতিমা। বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যায় মা দুর্গার উজ্জ্বল মুখ ঘিরে হাসি খুশি ছবি। কিন্তু, এই সাজানো প্রতিমা, এই চাকচিক্যের মণ্ডপ, জমজমাট আলোময় রাস্তার ঠিক পেছন দিকটায় বাসা বেঁধে থাকে অন্ধকার। দুর্গাপুজো বলতে মানুষ জানে কলকাতার রাস্তায় মানুষের ঢল। কোনও কোনও মানুষ চলে যান নিজের পছন্দের অন্য কোথাও, অনেকে হয়তো এই ছুটির সুযোগ নিয়ে চলে যান পাহাড়ে বা সমুদ্রে। কিন্তু ঠিক এই শ্রীভূমি, মহম্মদ আলি পার্কের পাশাপাশি রেডরোড, বাবুঘাট, প্রিন্সেপ ঘাট লাগোয়া  রাস্তা, যেখানে বছরের অন্য সময় লোক থইথই করে, পুজোর সন্ধেগুলো বড্ড ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সেই রাস্তাগুলো থেকে খানিকটা এগিয়ে গেলেই হয়তো আপনার চোখে পড়বে হাজারো মানুষের ঢল, সারি বেঁধে মণ্ডপে প্রবেশ, বেলুন, ফুচকার স্টল; পেশাদার ঢাকিদের ঢাকের আওয়াজে মিশে যায় ছোট্ট বাচ্চা ছেলের মজা করে বাজানো বাঁশির সুর। কিন্তু ওই রাস্তাগুলো মনমরা হয়ে বসে থাকে এই সন্ধে, রাতগুলোয়। অফিসযাত্রীর ভিড় নেই, বাসের হর্ন নেই, কন্ডাক্টরের খালি গাড়ির হাঁক নেই, শুধু কয়েকটা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু বাড়ি, কারও কারও গা বেয়ে নেমে গেছে কয়েকটা টুনি বালবের চেন।

একইভাবে, হয়তো গোল মুখের মা দুর্গার প্রতিমা বরণ করে আনা হয়েছে পাড়ার প্যান্ডেলে কিংবা আকাশ ছোঁয়া মূর্তি এসেছে কলকাতার কোনও ক্লাবে, কারিগর নিজের সবচেয়ে ভালো প্রতিভাটুকু উগড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যেই কাজটার মধ্যে, টানা টানা চোখ করেছেন, সজ্জিত করেছেন দশ বাহু, সোনালী রুপোলি গয়না, সুন্দর শাড়ি পরিয়েছেন বাঙালির মেয়েকে; কিন্তু মায়ের মূর্তির ঠিক পেছন দিক টা তাকিয়ে দেখলে ভেসে উঠবে একটা শুকিয়ে যাওয়া এঁটেল মাটির মণ্ড, যাকে মসৃণ করা হয়নি, যত্ন করা হয়নি, গয়না, শাড়ি তো নয়ই এমনকি রংটুকু ছুঁইয়ে দেখেননি শিল্পী। আমরা জানি, এর জন্য তিনি পারিশ্রমিক পান না, এক একজন কারিগরকে কত কত মূর্তি তৈরি করতে হয় সারা বছর অপেক্ষা করে থাকা এই মহোৎসবের জন্য এবং সব থেকে দরকারি বিষয় মানুষ প্রতিমার সামনে ভিড় করে, তার আড়ালে থাকা কোনও কিছুই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। একটা বিশাল বড় থিম পুজোর প্যান্ডেল হোক, অথবা পাড়ার ছোট্ট ক্লাবের ছোট্ট ছিমছাম মণ্ডপ, সামনের হাজার লোকের ঢল হোক কিংবা গোটাকতক পরিবারের ভিড়, মণ্ডপের ঠিক পেছনে থাকে কিছু ভাঙা বাঁশ, ফুটোফাটা ত্রিপল, কাপড়ের সঙ্গে কাপড় বেঁধে তৈরি করা মঞ্চের কিছু বাঁধন আর অনেকটা অন্ধকার। যেখানে কেউ অপার মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে থাকে না, যেখানে ভিড় হয় না, আলো পড়ে না। অথচ প্যান্ডেলের পিছন দিকটাও প্যান্ডেলেরই অংশ। আলো আর অন্ধকার যেন জন্ম জন্ম ধরে কয়েনের এই পিঠ আর ওই পিঠের সম্পর্কে আবদ্ধ। আলো সঙ্গে করে নিয়ে আসে অন্ধকার, আবার উল্টোটা বললেও ভুল হয় না। 

পুজো, যেমন নিয়ে আসে হাজারো বাড়ি ফেরার গান, সারা বছর দশটা-সাতটার ডিউটি করা একটা পরিবারের হইহই করে কাটিয়ে দেওয়া কয়েকটা দিন, শপিং মল, চারচাকা-মোটর সাইকেলের জ্যাম, আবার একাধারে বহু খেটে খাওয়া মানুষের রোজগারের একটা পথ, গ্রাম থেকে হেঁটে আসা ঢাকি, বহুদূর মফসসল থেকে আসা মণ্ডপ গড়ার কারিগর, শহরের কোনও এক প্রান্তের এক বৃদ্ধ প্রতিমাশিল্পী, জামাকাপড়ের দোকানি কিংবা অন্য সমস্ত কিছু। আমাদের নজরে শুধু ওই আলোটুকু ভেসে ওঠে, ভিড়, আনন্দ, চাকচিক্য। পুজোর আমেজ যতটা শিউলির ফুলের গন্ধে, কাশফুলের ঝাঁকে আছে, ততটাই আছে ঢাকের তালে, রাস্তার ধারে মাটি খুঁড়ে বাঁশ পুঁততে শুরু করাতেও। উৎসব সকলের, প্রতিটা মানুষ বর্ণ, ধর্ম, ভাষা, উঁচু-নিচু ভুলে মিশে যায় এই স্রোতে। 

কারও একটু দামি পোশাক জোটে, কারও হয়তো এবার পুজোয় আর কিছু কিনে ওঠা হয় না। কেউ সারারাত ঘুরে বেড়ায়, কারও হয়তো একটা আকস্মিক মনখারাপে ওই ক'টা দিন থেকে যেতে হয় চার দেওয়ালের মধ্যে। কেউ হয়তো ছুটি পায় না কাজ থেকে,কেউ হয়তো দূর শহরে বসে থাকে, বাড়ি ফিরতে পারে না। কোথাও আলো, কোথাও আঁধারী। প্রাকৃতিক নিয়মে সূর্য ঠিক যেখানে আলো দিতে পারে তার অপরদিকে সেই সময় এই পৃথিবীর অর্ধেক লোক ঘুমিয়ে থাকে, অন্ধকারে। বছরের আর পাঁচটা দিন শহরের ব্যস্ততম অথচ পুজোয় ঝিমিয়ে থাকা রাস্তাগুলো হোক কিংবা মণ্ডপের আড়ালে থেকে যাওয়া অন্ধকারটুকু, প্রতিমার পেছনের অমসৃণ দিকটা হোক বা পুজোর ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো, তাদের প্রত্যেকের দিকে নজর পড়লে যদি আমরা এক মুহুর্ত থমকে দাঁড়াই, দেখতে পাব এই উৎসবের আমেজের পাশাপাশি, আনন্দের পাশাপাশি, এত আলো, ভিড়ের পাশাপাশি এই মনখারাপ, এই অন্ধকার, নির্জনতাগুলি আজীবন বিদ্যমান। ওরা পাশাপাশি হেঁটে যাবে ছায়ার মতো, শুধু আমাদের নজর কেড়ে নিতে পারবে না।

আসলে প্যান্ডেলের পিছন দিকের অন্ধকার, আলোর উল্টোদিকের অন্ধকার, মূর্তির পিছনদিকের অবহেলা, প্রয়োজন শেষের অপ্রয়োজনীয়তা যেন ঠিক আমাদের জীবনের মতো; যে আমির ভিতরে একরাশ সুখের আলো, সে আমির ভিতরেই যন্ত্রণার নিকষ অন্ধকার। যে আমি লোকসমাজে ভীষণ গোছালো, সে আমি'র ভিতরঘরে সবকিছু অগোছালো। যে আমি প্রয়োজনে প্রিয়জন, সে আমিই প্রয়োজন শেষে হ্যালাফেলা। মা শুধু বছর বছর এসে আরেকবার মনে করিয়ে দিয়ে যান- এই যা...

More Articles