স্তনবৃন্ত, কাটা জিভ দিয়ে বেল্ট, চেয়ার তৈরি- রাতের ঘুম কেড়েছে বীভৎসতম এই সিরিয়াল কিলাররা
Serial Killer: 'দ্য চেসবোর্ড কিলার' নামেই ডাকা হত আলেকজান্ডার পিচুস্কিনকে। রাশিয়ার সিরিয়াল কিলার আন্দ্রেই চিকাটিলোর সঙ্গে নাকি প্রতিযোগিতা করে ৪৯ জনকে হত্যা করে চেসবোর্ড কিলার আলেক্সান্ডার।
মহিলাদের স্তন বৃন্ত দিয়ে তৈরি বেল্ট, কাটা জিভ দিয়ে তৈরি গলার হার, ঠোঁট দিয়ে তৈরি ছিটকিনি, মানুষের চামড়া দিয়ে তৈরি ডাস্টবিন, চেয়ারের উপর আচ্ছাদন দেওয়া মানুষের চামড়া, বিছানার চারটে খুঁটির মাথা তৈরি মানুষের মাথার খুলি দিয়ে, বসার চেয়ারেরও তাই। মানুষের চামড়া দিয়ে তৈরি লেগিংস, মহিলাদের মুখের চামড়া দিয়ে তৈরি মুখোশ- এমন অজস্র বীভৎস শিল্পকর্মের কারিগর এডওয়ার্ড থিওডর জিন। খুন করা এবং কবর থেকে ‘মায়ের মতো দেখতে’ মহিলাদের দেহ তুলে এনে তা ছিঁড়েখুঁড়ে এই কীর্তি করত এড জিন। মায়ের প্রতি অগাধ নির্ভরতা আর নড়বড়ে ছোটবেলা বিশ্বকে উপহার দিয়েছিল এক নৃশংস সিরিয়াল কিলার।
চোরাগোপ্তা করিডোর, সাউন্ডপ্রুফ ঘর, বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া যায় এমন দরজা, গ্যাস চেম্বার, বড় বড় ফার্নেস! অত্যাচারের জন্য এত আয়োজন। প্রথমে গ্যাস দিয়ে বেঁহুশ করা, তারপর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বের করে নেওয়া, তারপর ফার্নেসে জ্বালিয়ে দেওয়া। মৃতের কঙ্কাল মেডিক্যাল কলেজগুলিতে বিক্রি আর মৃতদের জীবনবীমার টাকা জালিয়াতি করে নিজের নামে তুলে নিয়ে শুধু হত্যার আনন্দ পেতে একটা আস্ত তিনতলা হোটেলকে মার্ডার কাসল হিসেবে গড়ে তুলেছিল হোমস। নাহ, ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের বাসিন্দা হোমস নন। সিরিয়াল কিলারদের জগতে যার উদাহরণ সনাতন এই সেই হেনরি হাওয়ার্ড হোমস। ১৮৯১ থেকে ১৮৯৪ অব্দি ২৭ খানা খুনের কারিগর।
শব্দটাই শিরায় শিরায় কৌতূহল-ভয়-রহস্য-আতঙ্ক মেশানো একটা তরল অনুভূতি জাগাতে যথেষ্ট। তরল বলেই কখনও উপন্যাস, কখনও সিনেমা কখনও হালফিলের ওয়েবসিরিজ তাকে নিজের নিজের মতো করে এ পাত্র সে আধারে ঢেলে দর্শক-পাঠকদের উত্তেজনা জুগিয়ে এসেছে। বিদেশের গল্পের পাশাপাশি দেশি সিরিয়াল কিলারদের দিয়ে ফের নাড়াঘাটা শুরু হয়েছে। সে রমন রাঘব ২.০-র আকারে ফিরেছে অথবা পোশম-পা’র আধারে। সিরিয়াল কিলারদের নামকরণ বিষয়টাই আদ্যন্ত কাব্যিক। সে কাব্যরসের রং যতই রক্তের বা গ্যাঁজলার হোক না কেন, তাতে রসবোধের খামতি নাই।
আরও পড়ুন- রূপান্তরকামীদের আরাধ্য মোরগবাহন বহুচরা দেবী, অচেনার তালিকায় এক রহস্যময় সংযোজন
দেশি সিরিয়াল কিলারের কথাই হচ্ছে যখন তখন নামকরণের ক্ষেত্রে ‘সায়ানাইড মল্লিকা’র নাম বাদ যায় কীভাবে! পোশাকি নাম ডি কেমপান্না, বিশ্বের কতিপয় মহিলা সিরিয়াল কিলারের তালিকায় জ্বলজ্বলে তার কর্মকাণ্ড। মন্দিরে পুজো দিতে আসা উচ্চ মধ্যবিত্ত মহিলাদের সঙ্গে ভাব জমানো, ভাব থেকে বন্ধুত্ব, তারপর সেই বন্ধুর ঘরে গিয়ে সুখ দুখের গল্প করতে করতে পটাশিয়াম সায়ানাইড খাইয়ে খুন এবং চুরি। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৭ অবধি আট বছরে ৭ জন মহিলাকে খুন করে ‘সায়ানাইড মল্লিকা’।
দেশের বাইরে জাপান। সেখানকার বিখ্যাত (যদিও এসব ক্ষেত্রে 'কুখ্যাত' বলাটাই রীতি) সিরিয়াল কিলারের নাম মানব ড্রাকুলা! নামের মধ্যেই কামের (অবশ্যই কর্ম অর্থে) ইঙ্গিত দেওয়ার যে ধারা তা এদেশেও বহমান। আসল নাম সুতোমু মিয়াজাকি। ছোটো ছোটো মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে বা জোর করে ধরে আনা এবং খুন। এখানেই শেষ নয়, খুনের পরে মৃতদেহের সঙ্গে যৌনতা, মৃতের রক্ত খাওয়া আর মৃতদেহের নানা অংশ ঘরে ট্রফির মতো সাজিয়ে রাখা ছিল এই খুনির নিজস্ব স্টাইল। খবর বলছে, একবার নাকি মৃতের আঙুলও খেয়ে ফেলে মিয়াজাকি। প্রতিটি মেয়েকে খুন করার পর হত্যার ধারা বিবরণী একটা পোস্টকার্ডে লিখে মৃতের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিত এই সিরিয়াল কিলার।
মৃতের সঙ্গে সিরিয়াল কিলারের যৌনতা বিষয়ে মিয়াজাকিই প্রথম নাম নয়। এই বিশেষ জগতে হাড় কাঁপানো নাম ছিল টেড বান্ডি বা থিওডর রবার্ট বান্ডি। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ এর মধ্যে ৩০ টি খুন। প্রতিক্ষেত্রেই শিকার মহিলারা, বিশেষ করে কলেজ-বয়সী মেয়েরা। সুদর্শন টেড হোমড়াচোমড়া পরিচয় দিয়ে এই তরুণীদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাঁদের অচৈতন্য করে কোনও জায়গায় নিয়ে যেত, সেখানে তাঁদের ধর্ষণ করে গলা টিপে খুন করত। বেশ কিছু ক্ষেত্রেই আবার খুনের জায়গায় ফিরে গিয়ে মৃতদেহের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হত টেড, তারপর সব চিহ্ন মুছে ফেলতে জংলি পশুদের খাইয়ে দিত সেই দেহ। ১২ জন মৃতের মাথা ধড় থেকে আলাদা করে বাড়িতে সাজিয়েও রেখেছিল সে।
'দ্য চেসবোর্ড কিলার' নামেই ডাকা হত আলেকজান্ডার পিচুস্কিনকে। রাশিয়ার সিরিয়াল কিলার আন্দ্রেই চিকাটিলোর সঙ্গে নাকি প্রতিযোগিতা করে ৪৯ জনকে হত্যা করে চেসবোর্ড কিলার আলেক্সান্ডার। বীভৎসতার নিরিখে আন্দ্রেই চিকাটিলোর নাম তালিকার প্রথমদিকেই আসে। খুন করে চোখ উপড়ে নিত আন্দ্রেই, বিশ্বাস করত চোখের মধ্যে মৃতদের শেষ দেখা দৃশ্যের (খুনির মুখ) ছবি নাকি বন্দি হয়ে থেকে যায়। পাকস্থলী কেটে বের করে, মৃতদের নাক চিবিয়ে, জিভ আর যোনি কেটে বের করে আনত আন্দ্রেই। শুধুমাত্র আনন্দ পেতে মৃতদের ঘিরে উলঙ্গ হয়ে নাচ করতে করতে পাশবিক চিৎকারও করত এই সিরিয়াল কিলার। তাকেই স্মরণীয় বরণীয় ভেবে পথবাসী মানুষদের মদ খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে বাড়িতে ডেকে আনত আলেক্সান্ডার। তারপর মাথায় হাতুড়ি মেরে খুন এবং নিজের সিগনেচার স্বরূপ মৃতের মাথায় ভদকার বোতল গুঁজে দিত সে। নিজের জবানবন্দিতে সে জানিয়েছিল, দাবার বোর্ডের চৌষট্টিটা খোপ পূরণে ৬৪ টা খুন করার পরিকল্পনা ছিল আলেক্সান্ডারের।
আরও পড়ুন- চার পায়ে হাঁটা থেকে কাঁচা মাংস খাওয়া, কেমন ছিল বাস্তবের মোগলি
অ্যাঞ্জেল অব ডেথ, ১৯৮৪ থেকে ২০০৩ সাল অবধি ৪০ জনকে হত্যা! পেশায় নার্স ছিল চার্লস এডমন্ড কালেন। যদিও ৩০০-রও বেশি রোগীকে হত্যার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে, ৪০ টি হত্যার কথা সে নিজে স্বীকার করে। স্বীকারোক্তিতেই জানা যায়, অ্যাঞ্জেল অব গডের কাজই মৃতপ্রায়, শারীরিক যন্ত্রণায় থাকা মানুষকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়া। তাই নিজেকে ত্রাতাজ্ঞানে বয়স্ক রোগগ্রস্ত মানুষদের বিষ খাইয়ে হত্যা করত এডমন্ড।
দেশি সিরিয়াল কিলারদের কথায় ফিরে এসে শেষ করা যাক এমন খুনির কথা দিয়ে যার প্রসঙ্গ এলেই অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। নাম অমরদীপ সাডা। বয়স ৮। মাত্র আট বছর বয়সে ৩ খানা খুন, একইভাবে এবং সব কিছুর পরেও নির্বিকার। তিন শিশুকে হত্যার অভিযোগ ছিল অমরদীপের বিরুদ্ধে যার মধ্যে ছিল তার নিজেরই বোন, বয়স মাত্র আট মাস। তার পরেই নিজের খুড়তুতো ভাইকেও হত্যা করে অমরদীপ, ভাইয়ের বয়স আরও কম। মাত্র ছয় মাস। এই দুই পারিবারিক খুনের ঘটনা অমরদীপের পরিবার জানলেও তারা চুপ থেকে যায়। এর পরেই প্রতিবেশী এক শিশুকেও একইভাবে খুন করে অমরদীপ। একটা খাঁ খাঁ মাঠে নিয়ে গিয়ে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে থেঁতলে খুন করত বিহারের বেগুসরাইয়ের অমরদীপ। মরে গেলে ঘাসপাতা চাপাও দিয়ে দিত সে। আশ্চর্যের বিষয়, পুলিশের কাছে এ সবই নির্বিকার ভাবে স্বীকারও করেছিল বছর আটের এই সিরিয়াল কিলার। মনোবিজ্ঞানীদের কথায়, জন্ম থেকেই একটি বিশেষ মানসিক রোগে আক্রান্ত সে। অন্যকে কষ্ট দেওয়ার মধ্যে আনন্দ পাওয়ার এই রোগ চিকিৎসা ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সেরে যেতেও পারে বলেই জানিয়েছিলেন তাঁরা।
সিরিয়াল কিলার হোক অথবা সন্ন্যাসী, অদ্ভুতভাবেই তাদের বেড়ে ওঠার আধার সমাজই। সমাজ মানে ছোটবেলার জীবনবিজ্ঞান বইয়ে পড়া সমাজ। সেই বইতে যা লেখা থাকে না, তা হল বিধ্বস্ত ছোটবেলার আখ্যান, অথবা গভীর মানসিক জটিলতার ঘা, সমাজের ঘুণধরা আবর্ত। সেরে তো যেতেই পারে মনের রোগ, সমাজের সারবে কী না এই প্রশ্নটাই গোলমেলে কেবল।
তথ্যসূত্র
১। The Big Book of Serial Killers by Jack Rosewood
২। https://www.britannica.com/biography/
৩। In cold blood by Truman Capote