মৃতের সহিত কথোপকথন! পৃথিবীর অদ্ভুত এই টেলিফোন বুথে আজও কথা বলে কারা...

Phone of the Wind: মানুষ মারা গেলেও তো কথারা থেকেই যায়। কে শুনবে সেসব গোঙানি, সেসব গেরস্থালির রোজনামচা, কে নতুন করেই বা আর শুনতে চাইবে ‘ভালোবাসি’।

এক জীবনে আমাদের কথাগুলো ফুরোয় না, এক জীবন কেন, সহস্র জীবনেও না। প্রিয় মানুষকে কত কী বলার থাকে! পরীক্ষার নম্বর থেকে শুরু করে গাছে প্রথম কুঁড়ি আসার বার্তা, জীবনে প্রথম পূর্ণিমা দেখার উচ্ছ্বাস থেকে শুরু করে কঠিনতম বেদনার কথা, সবই তো কাউকে না কাউকে বলার থাকে। বলাগুলো ফুরোয় না, যদিও মানুষকে ফুরিয়ে যেতেই হয়। মানুষ ফুরোলে তার ফোন নম্বরও ফুরিয়ে যায়। সেই নম্বরে ফোন বাজে না, বেশ কিছুক্ষণ বাজার পরে তুলে নিয়ে কেউ পরিচিত গলায় 'হ্যালো' বলে না। সচরাচর কেন, কোনওদিনই সেই টেলিফোন তো আর আসে না। তবু প্রহরবিহীন প্রতীক্ষা, আজীবনের প্রতীক্ষা বেঁচে থাকে। যাকে অনেক কথা বলার ছিল, তাকে বলতে চাওয়া সব বাক্যই গলার ভেতর, বুকের ভেতর, নাড়িভুঁড়ি-অন্ত্রের ভেতর, মাথার ভেতর কেবলই গোঁত্তা খেয়ে মরে।

কোথাও গোঁত্তা খায়, কোথাও আবার হাওয়ায় ভেসে যায়। জাপানের ছোট্ট একখানা জনপদ, ওৎসুচি। তাতে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এমনই এক টেলিফোন বুথ, যেখানে জমানো কথারা হাওয়ায় ভেসে ভেসে চলে যায় সেই ফুরিয়ে যাওয়া মানুষদের কাছে। Kaze no Denwa (বা "phone of the wind")। কাঁচের ঘর, আদ্যিকালের একখানা টেলিফোন, কালো রঙের, যত্ন করে রাখা। পাক দিয়ে নেমে এসেছে রিসিভারের তার। সামনে নোটবই। সোনালি রঙের ডায়ালে বহু বহু ব্যবহারের দাগ স্পষ্ট। মৃত মানুষের সঙ্গে  ফোনে কথা বলার এক নিজস্ব ঠিকানা। এই টেলিফোন ক্রিং ক্রিং শব্দে বাজেনি কখনও, কেউ ও-প্রান্তে ফোন ধরে আবেগ বা উৎকণ্ঠায় জানান দেয়নি। তবু কী মুখর!

মৃত আত্মীয় বা স্বজনদের সঙ্গে বাতাসের টেলিফোনে কতকাল ধরে কথা বলে চলেছেন এই ছোট্ট জনপদের মানুষরা। শুরুটা করেছিলেন ইতারু সাসাকি, ২০১০ সালে। নিজের ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রিয়জনকে হারানোর পর নিজের বাড়ির বাগানে এই টেলিফোন বুথ তৈরি করেন। ইতারু জানিয়েছিলেন, সাধারণ ফোনে তো আর কোনওদিন কথা হবে না হারানো ভাইয়ের সঙ্গে, কথা বলার উপায় হাওয়ায় কথা ভাসিয়ে দেওয়া। আর সেই জন্যই এই ফোন অব দ্য উইন্ড।

আরও পড়ুন- রূপান্তরকামীদের আরাধ্য মোরগবাহন বহুচরা দেবী, অচেনার তালিকায় এক রহস্যময় সংযোজন

তবে ২০১১ সালে চিত্রটা বদলে গেল এই ছোট্ট শহরের। মার্চ মাসের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প আর সুনামিতে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় ওৎসুচি। শহরের দশ শতাংশ মানুষ এই সুনামির ঢেউয়ে ভেসে যান, মারা যান। তারপর থেকে এই টেলিফোন বুথ হয়ে গেল সকলের, যাঁরা যাঁরা নিজের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, যাদের এখনও অনেক কথা বলার আছে, শোনানোর মানুষকে সশরীরে পাবেন না আর যাঁরা। সাসাকির তৈরি এই টেলিফোন বুথ তারপর থেকে কত যে কথোপকথনের সাক্ষী! কেউ কেউ আবার সেই ছোট্ট নোটবুকে লিখে রেখেছেন বিশেষ বার্তা। কেউ অঝোরে কেঁদেছেন, কেউ আবার ফোন ধরে চুপ করে বসে থেকেছেন। চারপাশের খাঁ খাঁ শব্দের মাঝে অন্তরের কথোপকথন বাঙ্ময় হয়ে পৌঁছে গেছে সেই মানুষের কাছে, যে ছিল; কিন্তু নেই। যা ছিল সাসাকির ব্যক্তিগত শোকের নিজস্ব ঘর, সেই ঘরে শোকের আত্মীয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে দিল প্রকৃতির বীভৎসতম প্রলয়।

এই শোকের আত্মীয়রা মিলেই এখন যত্ন করেন টেলিফোন বুথের। বছর খানেক আগেই প্রচণ্ড ঝড়ে কাঁচ ভেঙে, ছাদ উড়ে গিয়ে ভেঙে যায় এই বাতাসের ফোনঘরের একাংশ। তিনদিনের মধ্যেই স্থানীয় মানুষরা মিলে ফের সারিয়ে গড়ে নেন তাঁদের এই নিজস্ব তীর্থক্ষেত্র। ধর্ম নেই, শুধু স্মৃতি, শুধু বেদনা দিয়ে গড়া এক আরশিমহল।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে মানুষ এখানে আসেন মৃতের সঙ্গে কথা বলতে। যে মৃত হতে পারে তাঁদের বাবা, মা, ঠাকুমা, স্ত্রী, স্বামী, প্রেমিক বা স্কুলের বন্ধু। ৫০ মাইল রাস্তা পেরিয়ে মৃত স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে আসেন বছর ছেষট্টির বৃদ্ধা। মাঝ সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে যে স্বামী ঢেউয়েই হারিয়ে গেছিলেন, ১০ বছর আগে। মানুষ মারা গেলেও তো কথারা থেকেই যায়। কে শুনবে সেসব গোঙানি, সেসব গেরস্থালির রোজনামচা, কে নতুন করেই বা আর শুনতে চাইবে ‘ভালোবাসি’। হাওয়া বয়, কথাকেও বইয়ে নিয়ে যায়। তাই তো, ৭০ বছরের বৃদ্ধ যত্ন করে ফোন রাখার আগে মৃত স্ত্রীকে বলেন, “হ্যাঁ, আমি খেয়াল রাখব নিজের। ভাগ্যিস তোমার সাথে দেখা হয়েছিল! রাখি তবে এখন?” কালো রঙের টেলিফোনের পাশেই রাখা নোটবুকে অজস্র মানুষ লিখে রাখেন কত কীই। পুরনো অ্যালবাম ঘেঁটে নিয়ে আসা সাদাকালো ছবি অথবা পোলারয়েড ক্যামেরায় তোলা আলতো শিশুর স্নিগ্ধ মুহূর্ত! ছবির নীচে পরম মায়ায় লেখা “শুভ পনেরোতম জন্মদিন আনজু”।

আরও পড়ুন- ফিতের ফাঁদে ‘বিকাশ’! উদ্বোধনের প্রতিযোগিতায় নাস্তানাবুদ সরকারের দেশ

সুনামিতে হারানো স্বজনদের স্মরণ করতে এই যে টেলিফোন বুথ, তার রেপ্লিকা অবশ্য দেখতে পাওয়া যায় বিশ্বের নানা শহরেই। স্বজন হারানোর কারণ সেখানে ভিন্ন ভিন্ন, তবু স্মৃতির আধার হিসেবে রয়েছে এই টেলিফোন বুথ। যেমন, ওকল্যান্ডের এক বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে মৃতদের স্মরণ করতে শিল্পী জর্ডন স্টেম এমনই এক টেলিফোন বুথ তৈরি করেন। ম্যাসাচুসেটস বা ক্যারোলিনা এমনকি কলোরাডোতেও ফোন অব দ্য উইন্ডের রেপ্লিকা রয়েছে মৃতের সহিত কথোপকথনের জন্য।

সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারী পর্বেও আবার নতুন করে এই টেলিফোন বুথ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন কিছুজন। ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য এবং পোল্যান্ডের মানুষ চাইছেন কোভিড-১৯ মহামারীতে যারা নিজেদের স্বজন হারিয়েছেন তাঁদের জন্য এমনই এক টেলিফোন বুথ তৈরি হোক। যে নম্বরে আর ফোন করবে না কেউ, সেই সব নম্বরে এই বুথ থেকে ফোন যাক। হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে যাক কথাবার্তা। আসলে ফোন অব দ্য উইন্ড আমাদের এই নয়া পয়সার যাপনের মধ্যে কখনও ছিঁড়তে দিতে না চাওয়া যোগসূত্রদের তীব্রভাবে জড়িয়ে রাখার একটা তাগিদ। যে তাগিদের টানেই বহু দূর শহর থেকেও মানুষ এই ছোট্ট নিভৃত টেলিফোন বুথের কাছে ছুটে আসেন। দু’দণ্ড শান্তির খোঁজে, আজীবন স্মৃতিদের বাঁচিয়ে রাখার খোঁজে। যে নম্বরে কেউ ফোন ধরবে না, সেই নম্বর, সেই মানুষদের জড়িয়ে জড়িয়ে একটা ফিনফিনে হাওয়া কত কত মৌখিক চিঠি নিয়ে ভেসে যায়, সমুদ্র পেরিয়ে, ডাঙা পেরিয়ে। মানুষ ছড়িয়ে পড়ে, দেশান্তরে, এভাবেই।   

More Articles