নিগ্রহ, ধর্ষণ, পুলিশের তাড়ায় বিপর্যস্ত অভিজিতের ইচ্ছেপূরণের নাম অভীনা

ভুল করে একটা পুরুষ শরীরে সেঁধিয়ে যাওয়ার অপরাধে স্কুলে বন্ধুদের দিয়ে ধর্ষণ, চাকরিহীনতা, যৌনকর্মী হয়ে বাকিদের দিয়ে ধর্ষণ এবং ইত্যাদি ইত্যাদি পেরিয়ে যে এখন অভীনা, রূপান্তরিত সমাজকর্মী। 

সময়টা ১৯৯০ নাগাদ। মহারাষ্ট্রের ওরলির একটি স্কুল। একটা ফাঁকা ক্লাসঘরে বেশ কিছু ছেলের দল। একটা লম্বা কাঠের স্কেল, আর একজন ভীতু ছাত্র। ভীতু ছাত্র, নরম ছাত্র, বাকিদের সঙ্গে মারামারিতে থই না খুঁজে পাওয়া শান্ত ছাত্রকে উপুড় করে ধরে রেখেছে বাকিরা। জোর করে প্যান্ট নামিয়ে পিছন দিয়ে ভীতু শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল কাঠের লম্বা স্কেল। একটা বয়ঃসন্ধির শরীরে অচেনা পথ দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে স্কেল মাপল ঘৃণার পরিমাপ, স্কেল মাপল অন্যরকম হওয়ার মাশুল, স্কেল বুঝল শরীর যাদের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা তাদের যাপনটাই বিভীষিকাময়। তারপর আসে গলগল রক্তপাত, তারপর আসে চোখ বুঁজলেই সমস্ত দৃশ্য অবিকল, তারপর আসে ব্যথার যন্ত্রণা এবং আরও বহু কিছু যা সততই গিলে নিতে হয়। যেমন গিলেছিল ভীতু ছাত্র, অভিজিৎ আহের। ভুল করে একটা পুরুষ শরীরে সেঁধিয়ে যাওয়ার অপরাধে স্কুলে বন্ধুদের দিয়ে ধর্ষণ, চাকরিহীনতা, যৌনকর্মী হয়ে বাকিদের দিয়ে ধর্ষণ এবং ইত্যাদি ইত্যাদি পেরিয়ে যে এখন অভীনা, রূপান্তরিত সমাজকর্মী। 

১৯৭৭ সালে ওরলিতে জন্ম, তিন বছর বয়সেই বাবার মৃত্যু। একা মায়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা অভিজিতের। মা কত্থকশিল্পী মঙ্গলা আহের। মায়ের মতো দেখতে হতে চাওয়া এবং মায়ের মতো নাচ শেখার ইচ্ছা থেকে অভিজিতকে বিরত রেখেছিল একমাত্র তার শারীরিক লিঙ্গ পরিচয়। ভেতরে ভেতরে সে যে ততখানি ছেলে নয় তা বেশ কম বয়সেই বুঝেছিল অভিজিৎ। বুঝেছিলেন মঙ্গলাও। তাই “ছেলেরা নাচ শেখে না” গোছের স্থূল সামাজিক বুলি দিয়ে আটকাতে চেয়েছিলেন একমাত্র সন্তান অভিজিতকে। ভালো করে পড়াশোনা, সরকারি চাকরি এবং নিজের সংসারের গল্পেই ঘুম পাড়াতে চেয়েছিলেন অভিজিতের ভেতরের অভীনাকে। সাত বছর বয়স থেকেই মেয়েদের পোশাক পরতে শুরু করেছিল অভিজিৎ। একটা অস্বস্তিকর শরীরে মেয়ে হয়ে ওঠার এই সফর যে তা ছেঁদো সিনেমার মতো সমান্তরাল নয়। কেবল শরীর নয়, পুরো যাপনটাই দুর্ঘটনা হয়ে যায় অভিজিতদের কাছে, অভিজিতদের বাড়ির কাছেও। যেমন মঙ্গলার হয়েছিল, বহু বহু মঙ্গলাদের হয় রোজ। পুরুষ সন্তানটি কেন ততখানি পুরুষ নয়, বা মেয়ে সন্তানটি কেন ততখানি নমনীয় নয় এই নিয়ে পড়শিদের ঘুম আসে না, সরকারের নথি আসে না, সমাজের মহাভারতটি উল্টে গড়াগড়ি যায়। শারীরিক লিঙ্গ অনুযায়ী সমাজ সামাজিক লিঙ্গও বেঁধে দেয়। একটি ছেলেকে কতখানি ছেলে হয়ে উঠতেই হবে বা একটি মেয়েকে কতখানি কমনীয়, এসবের শাস্ত্র শ্রুতি হয়ে হয়ে বহমান।


যে সময়ে অভিজিৎ বড়ো হয়েছেন, সে সময়ে না ছিল ইউটিউব ভিডিওর সহজলভ্যতা, না ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় সমভাবনার মানুষের গোষ্ঠী খোঁজার সুযোগ, না ছিল নেট ঘেঁটে হাজারো লেখাপত্তরের মধ্যে দিয়ে নিজেকে বোঝার সুযোগ। শরীরে কিছু একটা হচ্ছে, শরীরে নাকি শরীরের ঊর্ধ্বে এ ঠাওরাতে সময় লাগলেও তার এই ‘অন্যরকম’ হওয়ার জন্যই যে অপদস্থ হতে হচ্ছে মাকে এ বুঝতে সময় লাগেনি। শারীরিক নিয়মেই যে বদলগুলো আসে দেহে সে নিয়ে অভীনা বলছেন, “আমার নিজেকে বীভৎস লাগত। আয়নায় নিজেকে দেখতে ভয় পেতাম। মনে হতো আমারই অন্ধকার সত্ত্বা কালিঝুলি মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমারই সামনে।”

আরও পড়ুন-সত্যজিতের ছবি থেকে হালের দেবদাস, প্রতিটি মুদ্রায় রয়ে গেলেন বিরজু মহারাজ


ডুবন্ত নৌকায় বিপ্লব হয় না। মায়ের কথা মতোই নিজেকে যথাসম্ভব পুরুষ সাজিয়ে কলেজে গেলেন অভিজিৎ। যা যা করলে সমাজ পুরুষত্বে সিলমোহর দেয় ঠিক তাই তাই করে রূপান্তরণের ইচ্ছাকে নিভৃতে রেখেই স্নাতক হন অভিজিৎ। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমাও করেন। ছোটোবেলার স্মৃতির ঘা শুকোতে ওরলির পাট গুটিয়ে মা-‘ছেলে’ চলে আসেন খারে।


এখানেই আলাপ সাংবাদিক এবং রূপান্তরকামীদের অধিকার নিয়ে লড়াই করা মানুষ অশোক রাও কবির সঙ্গে। সফটওয়্যারের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ ছেড়ে দিয়ে অশোক রাও কবির হামসফর ট্রাস্টের একটি প্রকল্পে যোগ দেন অভিজিৎ। সাতাশ বছর বয়সে নিজের রূপান্তরণ ঘটান অভিজিৎ। শরীর ও মননের সামঞ্জস্য রেখে অভীনা আহের হিসেবেই পরিচিতি চান। এবং ঠিক এইখান থেকেই পৃথক লড়াইয়ের শুরু।


শরীর বদলে ফেললেও, সমাজের নথি বদলায় না। পরিচিতির সকল নথিপত্র জুড়ে ‘অভিজিৎ আহের, সেক্স-মেল’ লেখাটুকু আর বদলে যাওয়া অভীনার শরীরকে কোনও সংস্থাই চাকরি পেতে দেয়নি। অস্ত্রোপচার করে ছেলের এই মেয়েমানুষ হয়ে ওঠায় একই ঘরে থেকে মা মঙ্গলাও সমস্ত যোগাযোগের পথে নৈঃশব্দ্য বসিয়ে দেন, টানা ছয় বছরের নৈঃশব্দ। এই সময়কাল অভীনার জীবনের দ্বিতীয় বিভীষিকা। অভীনা জানাচ্ছেন, “তিন বছর যৌনকর্মীর কাজ করেছি। এমন সময়ও গিয়েছে, এক রাতে এগারোজন ক্লায়েন্ট। একের পর এক ধর্ষণ, অসুরক্ষিত যৌনতা, গলার সামনে ছোরা ধরে যৌনতা। পুলিশের তাড়া খেয়ে লুকিয়েছি, হিজড়েদের দলে ভিড়েছি। শুধু অভিজিৎ থেকে অভীনা হয়েছি বলে।”


যৌনকর্মীর কাজ করতে করতেই এইচআইভি সচেতনতা সংক্রান্ত একটি কাজে জুড়ে যান অভীনা। রূপান্তরকামীদের স্বাস্থ্য বিষয়ে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রকের অধীনে ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশনের সঙ্গে জুড়ে যান অভীনা। রূপান্তরকামীদের নিরাপত্তা ও অধিকার আইন, ২০১৯ এবং সুপ্রিম কোর্টের ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি (NALSA) নিয়ে কাজ করেছেন অভীনা। বর্তমানে এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকির মুখে থাকা যৌনকর্মী, রূপান্তরকামী, সমকামী পুরুষদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে আইটেক ইন্ডিয়ার হয়ে কাজ করেন অভীনা। 


ছ’বছর যে মা কথা বলেননি অভীনার সঙ্গে, মেয়ের সাক্ষাৎকার, মেয়ের কর্মকাণ্ডের খবর, বিশ্বজুড়ে রূপান্তরকামীদের নানান জবানবন্দি পড়তে পড়তে শুনতে শুনতে এই বৃদ্ধা নিজেকে সেক্সুয়ালিটি এবং সামাজিক লিঙ্গ বিষয়ে দিনের পর দিন তৈরি করেছেন, বদলেছেন। যোগ দিয়েছেন রূপান্তরকামীদের অভিভাবকদের নিয়ে তৈরি স্বীকার ফাউন্ডেশনে। ২০১৩ সালে রূপান্তরকামী পুরুষ ও মহিলাদের নিয়ে নিজের সংগঠন ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার ইক্যুইটি অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট ট্রাস্ট (TWEET Foundation) গড়ে তোলেন অভীনা আহের। রূপান্তরকামীদের অধিকার বিষয়ে আরও কথা বলতে দেশের মধ্যে প্রথম রূপান্তরকামীদের নাচের দল Dancing Queens Mumbai গড়েন অভীনা।


দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে রূপান্তরকামীদের অধিকার নিয়ে অভীনার এই লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়ে তাঁকে জাতীয় রূপান্তরকামী সম্মান ২০২১-এ সম্মানিতও করা হয়েছে সম্প্রতি। শুধু অভীনা নন, মেয়ের এই লড়াইয়ে নানা চড়াই উৎরাই পার করেও সঙ্গ না ছাড়ার জন্য মঙ্গলা আহেরকে সম্মানিত করা হয়েছে বিদ্যা সম্মানে। মায়ের মতো নাচ শিখতে চেয়ে অভীনা নিজের নাচের দলকে নিজেদের কথা বলার হাতিয়ার করে গড়েছেন। হয়তো দুর্ঘটনা নয়, শরীরটা একটা পথ মাত্র, তাকে ঘিরে চলতে থাকা সফরটাই মূল। আর সফরের কোনও লিঙ্গপরিচয় হয় না, কখনও না।

More Articles