নদিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জার্মানি, বাঘ-সিংহকে বশ মানাতেন এই বাঙালি

এই কাহিনি বাঙালির এক দুর্ধর্ষ নায়কের। যাঁর হাত ধরে কোনও একসময় বাঙালি পাড়ি দিয়েছিল সপ্তসমুদ্র, যার হাত ধরে বাঙালি এক লহমায় ঝেড়ে ফেলেছিল তার চিরাচরিত ‘ঘরকুনো’ অপবাদ। সত্যজিৎ রায়ের ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ গল্পে উল্লেখ আছে এই ব্যক্তিত্বের। তাঁর পরিচয় দেওয়ার আগে দু’টি ঘটনা বলে নেওয়া প্রয়োজন।

নদিয়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নাথপুর। শেষ বিকেলের রোদ্দুর নব রঙে রঙিন করে তুলেছে গ্রামের মেঠো পথঘাটকে। গ্রামছাড়া রাঙা মাটির পথ ধরে ঘরে ফিরছে এক বছর বারোর কিশোর। হঠাৎই পাশের জঙ্গল থেকে ছুটে এল একটি বন্য শূকর, হিংস্রভাবে তেড়ে গেল সেই বছর বারোর কিশোরের দিকে। তারপর কিছুক্ষণের অসম লড়াই।কাছেই ছিলেন কিছু নীলকর সাহেব। তাঁরা যতক্ষণে ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছেন ততক্ষণে শূকরটিকে মাটিতে ফেলে শরীরের ধুলো ঝাড়তে ব্যস্ত সেই অসমসাহসী কিশোরটি।

এর পরের ঘটনা বাংলার বাইরের। মাদ্রাজ তখনও চেন্নাই হয়ে ওঠেনি। রাতের নিয়ন আলোর রোশনাইকে তার অলংকার করে মাদ্রাজ প্রতি মুহূর্তে যেন আরও মোহময়ী হয়ে উঠছে। এমন সময় সস্তার এক ধর্মশালা থেকে বেরিয়ে এল সুঠাম এক যুবক। সকালের ট্রেনেই কলকাতা থেকে মাদ্রাজ এসেছে সে। রাতের অন্ধকারে সুন্দরী মাদ্রাজের রূপ-রস–গন্ধকে উপভোগ করতে রাস্তায় নেমেছে এই যুবক। এমন সময় পাশের গলিতে শোনা গেল এক মহিলাকণ্ঠের আর্তচিৎকার। শোনামাত্র একছুটে পাশের গলিতে হাজির যুবকটি। দেখতে পেল, একদল আততায়ীর আক্রমণে বিপন্ন এক মহিলা। ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। আততায়ীদের ধরাশায়ী করে কিছুক্ষণের মধ্যেই উদ্ধার করল সে এই মহিলাকে।

উপরের দু’টি ঘটনার অবিসংবাদিত নায়ক যিনি, তিনি হলেন কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস। ঊনবিংশ শতকের বাংলা তখন নব চেতনার উন্মেষ ঘটাতে ব্যস্ত। এমন এক সময়, যখন কলকাতার জোড়াসাঁকোতে জন্ম নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠিক সেই সময়ই নদিয়ার এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নিচ্ছেন সুরেশ বিশ্বাস নামক এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। সুরেশের বাবা ছিলেন ছাপোষা চাকুরে, অন্যদিকে সুরেশ চিরদিনই ভিন্ন ধাতুতে গড়া। কিশোর বয়স থেকেই চূড়ান্ত অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় সুরেশের দৌরাত্ম্যে গ্রামের প্রায় প্রতিটি সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। ফলে, কিছুদিনের মধ্যেই একপ্রকার বাধ্য হয়ে নদিয়ার বাস ওঠাতে হল সুরেশের বাবাকে। কলকাতা এসে ডেরা বাঁধলেন বালিগঞ্জ অঞ্চলে। কিন্তু নতুন শহরটাকে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে এক মুহূর্তে আপন করে নিয়েছিল সুরেশ। পাশে পেয়েছিল লন্ডন মিশন কলেজের প্রফেসর মি. আটসনকে। মূলত তাঁর উৎসাহেই সুরেশ আরও আকৃষ্ট হয় অ্যাডভেঞ্চারিজমের প্রতি। অন্যদিকে, সময় কিন্তু থেমে থাকেনি। কালের নিয়মে সময় সুরেশকে তৈরি করে নিচ্ছিল নিজের মতো করে। একদিকে চাকরির খোঁজ, অন্যদিকে দেশ-বিদেশের বইপত্র পড়া- দুইই চলছিল সমান তালে। তারই সঙ্গে তাল রেখে বাড়ির সঙ্গে, পরিবার–পরিজনের সঙ্গে সুরেশের দূরত্ব বাড়ছিল ক্রমাগত। অবশেষে একদিন বাড়ির সঙ্গে সমস্ত নাড়ির টান ছিন্ন করে দেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়লো নদিয়ার সেই অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে সুরেশ বিশ্বাস।

এরপর চলে যাওয়া যাক জার্মানির হামবুর্গ শহরে। সময়টা বসন্তকাল, প্রেমের ঋতু।জার্মানির আকাশে-বাতাসে তখন নব প্রেমের সুসংবাদ। ঠিক এই সময়ই হামবুর্গের একপ্রান্তে একটি মাঠে দেখা মিলল বেশ কিছু তাঁবুর। বসন্তের সমাগমের সঙ্গে সঙ্গে সার্কাসের দলও হাজির, তাদের হরেকরকম মজার খেলার পসরা নিয়ে। এখানেই জার্মানরা পরিচিত হল এক বাঙালি যুবকের সঙ্গে। যে অভূতপূর্ব দক্ষতায় কাবু করে ফেলছে সার্কাসের ভয়াল সিংহকে, এমনকী, জার্মানির এই সার্কাসের মধ্যেই খোঁজ মেলে ফ্যানি নামক একটি বাঘের, যাকে অদ্ভুতভাবে নিজের বশে রাখতে সক্ষম হন কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস।

তবে শুধু সার্কাস নয়, আরও একটি কারণে হামবুর্গ খ্যাত হয়ে আছে সুরেশের জীবনে।এখানেই তিনি দেখা পেয়েছিলেন তাঁর প্রেয়সীর। জার্মান তরুণীটি সুরেশের অসীম সাহস দেখেই তাকে মন দিয়ে ফেলেছিলেন কি না, তা জানা যায় না। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের প্রথম পর্বের সেই প্রেম পূর্ণতা পায়নি। কারণ সেই তরুণী ছিলেন সেই সময়ের এক ডাকসাইটে সুন্দরী। ফলে পানিপ্রার্থীর অভাব ছিল না তাঁর। তাঁর যসমস্ত প্রেমিকরা একনাগাড়ে খুনের হুমকি দিতে থাকে সুরেশকে। ফলে, একপ্রকার বাধ্য হয়ে জার্মানি ত্যাগ করতে হয় তাঁকে। না, এবার রেঙ্গুন বা কাছেপিঠের কোনও দেশ নয়। সুরেশ পাড়ি জমালেন সুদূর ব্রাজিলে। জার্মানি ছাড়ার আগে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে তাঁর উক্তি ছিল: তোমার-আমার মাঝে আকাশ–পাতাল ব্যবধান। আমাদের বিয়ের সম্ভাবনা নেই।পারলে আমায় ভুলে যেও।

১৮৮৭ সালে ব্রাজিলের অশ্বারোহী বাহিনীর কর্পোরাল পদে অধিষ্ঠিত হলেন সুরেশ বিশ্বাস। ১৮৯৩ সালে হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। এই সময়ই আধুনিক যুদ্ধবিদ্যা পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়ে মাত্র পঞ্চাশজন সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে ব্রাজিলের সেনা বিদ্রোহকে দমন করেন তিনি।

ঊনবিংশ শতকের বাংলা তথা সমগ্র ভারতের বুকে সাহসিকতার লেলিহান অগ্নিশিখা জ্বেলে দিয়েছিলেন এই বীর বাঙালি সন্তান সুরেশ বিশ্বাস। নদিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম নাথপুর থেকে ব্রাজিল– পথটা সহজ ছিল না। কিন্তু তারপরেও তাঁকে অবলীলায় অতিক্রম করেন এই অগ্নিপুরুষ। আত্মবিস্মৃতিতে জর্জরিত বাঙালি কি এই বীরত্বের কাহিনি মনে রেখেছে?

তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ আগস্ট, ২০১৬

More Articles