গায়ে জাতীয় দলের জার্সি, মনে চিকিৎসার মন্ত্র, বিশ্বের বিস্ময় আফগান শরণার্থী নাদিয়া নাদিম

সব রিফিউজিদের জীবনের গল্পই মোটামুটি একরকম। সাপলুডো খেলার এই জীবনে স্বপ্নই তাঁকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়। সব হারিয়েও দিনবদলের স্বপ্ন জাপটে ধরে নতুন উদ্যমে কাজে লেগে পড়েন। বেশির ভাগই গড্ডালিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন, দিতে বাধ্য হন। তবে এমন বিরলতম মানুষও থাকেন যিনি বেয়নেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারেন, ভরসা দিতে পারেন অজুত মানুষকে।  আর এমন হার না মানা জেদকে আটকাবে কে? ইতিহাসের নিয়মটাই এই, সব বাঁধা কাটিয়ে মধ্যগগনে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত উদয় হয় এই অকুতোভয় পুরুষ নারীর। সারাবিশ্ব তখন লড়াকু শক্তিকে সেলাম ঠোকে। এমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র নাদিয়া নাদিম, আফগান ফুটবল তারকা। বাবার মৃত্যু, শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় আর সেখান থেকে ম্যানচেস্টার সিটির ফুটবল দলে জায়গা করে নেওয়া, ১১টি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারা, ডাক্তারি পাশ করা- নাদিয়া নাদিম যেন লড়াই শব্দটির প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছেন অভিধানে।

ফিরে দেখা লড়াইয়ের সেই দিনগুলি

নাম নাদিয়া নাদিম। জন্ম ১৯৮৮ সালের ২ জানুয়ারি আফগানিস্তানের হেরাতে। বাবা মা ছাড়াও চার বোন নিয়ে তাঁর পরিবার আফগানিস্তানেই থাকতেন। বাবা রাবানি নাদিম আফগান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তালিবান গোষ্ঠী আফগানিস্তানের ক্ষমতার দখল নিতে শুরু করলে রাবানিকে বৈঠকের জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁরা। পরের ছ'মাস আর খোঁজ মেলেনি তাঁর। পরে একদিন নাদিয়ার মা হামিদা জানতে পারেন তালিবানের হাতে নিহত হয়েছেন রাবানি। নাদিয়ার বয়স তখন মাত্র ১১। তাঁর কথায়, 'সেই সময়টা ছিল বিভীষিকার মত। আপনারা হয়তো তালিবান সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছেন।তাঁরা আফগান মানুষের মন ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। আমি সবকিছু স্বচক্ষে দেখিনি কারণ সে সময় আমাদের একা বাড়ি থেকে বেরোনোর অনুমতি ছিল না কিন্তু চারিদিকের কথা কানে আসত '। নাদিয়া আরও জানান,"পৃথিবীর অন্যান্য স্বৈরতন্ত্রের মতোই তালিবানরা ক্ষমতা দখলের জন্য  আফগান সরকারের যে সব উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মীদের খুন করেছেন আমার বাবা তাঁদের একজন। আমরা ভেবেছিলাম হয়তো তাঁরা বাবাকে জেলবন্দি করবে"। সেই থেকেই লড়াই শুরু নাদিয়া ও তাঁর পরিবারের। সেসময় আফগান মহিলাদের কোনো পুরুষ ছাড়া বাইরে বেড়ানোর অনুমতি ছিল না। মেয়েদের পড়াশোনা, গান শোনা এমনকী টেলিভশন দেখাও মানা ছিল। পুরুষরা জিন্স পড়তে পারবে না,এমনকী তাঁদের দাঁড়ি রাখতেই হবে"।

এমন পরিস্থতিতে বহু কষ্টে আফগানিস্তান ত্যাগ করে নাদিম পরিবার, দেশছাড়ার যন্ত্রণা যে ছেড়েছে সেই শুধু জানে। হামিদা তাঁদের সমস্ত জমি,বাড়ি, গাড়ি এবং গয়না বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেন দেশ ছাড়ার। তারপর একদিন মধ্যরাতে  ছোট একটি ভ্যানে করে সুন্দর ভবিষ্যতের খোঁজে রওনা হন নাদিয়া ও তাঁর পরিবার। পাকিস্তান বর্ডার পেরিয়ে দুমাস লুকিয়ে থাকেন করাচিতে। নকল পাসপোর্ট বানিয়ে কোনোক্রমে ইতালি এসে পৌঁছান। এরপর বেশ কিছু রাত কেটেছিল একটি লন্ডনগামী ট্রাকের মধ্যে। কিন্তু ভাগ্য তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল ডেনমার্কের প্রত্যন্ত এক গ্রামের শরণার্থী শিবিরে। সেদিন ওই শিবিরে কর্মরত এক ব্যক্তি ক্ষুধার্ত নাদিয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলেন দুধ, টোস্ট এবং একটি কলা।

আরও পড়ুন-বড় ক্রিকেটারে নয়, বিরাট ব্র্যান্ডে মোহিত নিউ ইন্ডিয়ার জনগণমন

২১ বছর পরে সেই দিনের স্মৃতি হাতড়ে নাদিয়া জানিয়েছেন,' শরণার্থী শিবিরের ওই ঘটনায় আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত। সেই খাবারের মূল্য হয়তো খুব বেশি হলে ২ পাউন্ড হবে কিন্তু এই খাবারটুকু আমি সারাজীবন মনে রাখব। একজন মানুষ হিসেবে ওই ঘটনাটি আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছিল যে আমি অন্যদের জন্য কী করতে চাই!' সব মিলিয়ে মোট ন’মাস ডেনমার্কের সেই শিবিরে কাটিয়েছিলেন নাদিয়া ও তাঁর পরিবার।   

দিনবদলের গল্প

 শরণার্থী শিবিরে ধীরে ধীরে জীবন বদলাতে শুরু করে নাদিয়ার। একদিন শিবিরের কাছে একদল মেয়েকে ফুটবল খেলতে দেখে সে। নাদিয়া সেই দৃশ্য মনে করে বলেছেন ,' প্রথমদিকে ভয় পেতাম.... কাঁটাতারের বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়েদের ফুটবল খেলা দেখতাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে প্রথমবার তাঁদের ফুটবল খেলতে দেখে মনে হয়েছিল আমিও মাঠে যেতে চাই। চারিদিকের সবকিছু থমকে গিয়েছিল সেদিন।'

পরের দু'মাস টানা প্রশিক্ষণের পর প্রথম ম্যাচ খেলতে নামলেন দলের জার্সি গায়ে। ডেনমার্কের স্থায়ী নাগরিকত্ব মিলতেই নাদিয়ার পেশাগত ফুটবল খেলা শুরু হয়। আলবর্গ ক্লাবের হয়ে প্রথম খেলেন নাদিয়া। এরপর জীবন খানিক সিনেমার গল্পের মতোই। ওই বছরের শেষে ভাইবর্গে যোগ দেন । এরপর প্রায় ১০ বছর ডেনমার্কের একাধিক ক্লাবের নির্ভরযোগ্য স্ট্রাইকার হয়ে খেলেছেন নাদিয়া। ২০০৯ সালে ডেনমার্কের জাতীয় দলের খেলার সুযোগ পান এই ফুটবল রমণী। নাদিয়াই  ডেনমার্কের প্রথম ফুটবলার যিনি জন্মসূত্রে ড্যানিশ নন। দেশের হয়ে ৯৯ ম্যাচে ৩৮ টি গোল রয়েছে নাদিয়ার ঝুলিতে।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্কাই ব্লু এফসির হয়ে মাঠে নামেন আফগান এই তরুণী। ২০১৮ সালে ম্যানচেস্টার সিটির জার্সি গায়ে ওঠে নাদিয়ার। সেখানে এক বছর কাটিয়ে প্যারিসের সঁ জঁ ক্লাবে তিনি যোগ দেন ২০১৯ সালে। সহ অধিনায়ক হিসেবে খেলে প্রথমবার লিগ খেতাব জিতে নেয় তাঁর ক্লাব। ওই মরশুমে ২৭ ম্যাচে ১৮ টি গোল করেন নাদিয়া। গত বছর থেকে মার্কিন লিগ ফুটবলে রেসিং লুইভিল ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করেছেন তিনি। অনেকই মনে করেন ৩৪ বছরের নাদিয়াই সর্বকালের সেরা আফগান মহিলা ফুটবলার। তবে এখানেই নিজেকে থামিয়ে রাখেননি নাদিয়া। ফুটবলের পাশাপাশি পাঁচ বছর ধরে চালিয়ে গেছেন ডাক্তারির পড়াশোনাও। আজ নাদিয়া একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তারও। সম্প্রতি ট্যুইট করে জানিয়েছেন," যাঁরা প্রথম দিন থেকে আমাকে সমর্থন করেছেন এবং যাত্রাপথে যে সকল মানুষকে নতুন বন্ধু হিসেবে পেয়েছি,তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ'। ১১ টি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন নাদিয়া।

আফগান মহিলা ও শিশুদের অধিকার নিয়েও সরব হয়েছেন এই মেয়ে। নাদিয়ার মত, যত খারাপ সময়ই আসুক না কেন, হাল ছাড়লে চলবে না। বিশ্বাস রাখতে হবে ,একদিন ঠিক সময় বদলাবে। ইতিবাচক মানসিকতা ও চিন্তাধারাই আপনার জীবন বদলে দেবে। আজও অগ্নিপরীক্ষা দিচ্ছেন বহু আফগান নারী। কঠিন সময়ে নাদিয়ার জীবন এবং তাঁর লড়াই জীবনে ঘুরে দাঁড়াবার মন্ত্র দিয়ে যাচ্ছে তাদের কানে।

More Articles