নয়া তালিবানি ফতোয়ায় বোরখার আড়ালে আফগান নারী! ফের ফিরবে কালো দিন?

পর্দা প্রথা মেয়েদের নানা শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে।


"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার
হে বিধাতা?...’’

 

তালিবান শাসনে আফগানিস্তানে নারীর অধিকার নেহাতই কথার কথা। বিধাতার কাছে হাজারও আর্তনাদেও মেয়েদের যে এখানে আপন ভাগ্য জয় করার কোনও অধিকার জন্মাবে না, তা বলাই বাহুল্য। তালিবান দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে যে উদারতার কথা শুনিয়েছিল, তা যে নেহাতই ফাঁকা আওয়াজ, তা আবার প্রমাণ করল তারা। বুঝিয়ে দিল, তালিবান আছে তালিবানেই। বোরখা নিয়ে আবার নির্লজ্জ ফতোয়া জারি করল তারা।

 

জানিয়ে দিল, হিজাবে চলবে না। জনসমক্ষে পরতে হবে বোরখা। নয়া ফতোয়ায় আফগান মহিলাদের একথা জানিয়ে দিল তালিবান। ঘোষণাপত্র জারি করে তালিবানের সর্বোচ্চ নেতা হিবাতুল্লা আখুন্দজাদা বলেছেন, "আফগান মহিলাদের ঐতিহ্যবাহী চাদরি (মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা বোরখা) পরা উচিত। কারণ সেটাই তাঁদের সম্মানের সঙ্গে মানানসই।"

 


এমনকী, পুরুষ আত্মীয়দের সামনে আসার সময় আফগান নারীদের শরিয়ত মেনে মুখ ঢাকারও নির্দেশ দিয়েছেন তালিবান সর্বোচ্চ নেতা। তবে বয়স্ক মহিলা এবং শিশুকন্যাদের এক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে আখুন্দজাদার ‘পরামর্শ’, "যদি বাইরে গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজ না থাকে, তবে মহিলাদের বাড়িতে থাকাই ভালো।"

 

আরও পড়ুন: বিরোধিতা করলেই দেশদ্রোহ! আর কতদিন দেশে থাকবে এই ব্রিটিশ আমলের আইন?

 

গত আগস্টে তালিবানের কাবুল দখলের পর সংগঠনের আন্তর্জাতিক মুখপাত্র সুহেল শাহিন কাতারের দোহায় সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছিলেন, অতীতের মতো বোরখা নিয়ে কড়াকড়ি হবে না। তিনি বলেছিলেন, ‘‘বোরখা একমাত্র আবরণ নয়। তার বাইরেও অন্য ধরনের হিজাব রয়েছে।’’ কিন্তু সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতা বুঝিয়ে দিলেন, ফের বোরখা-বিতর্কে অতীতের পথেই হাঁটবেন তাঁরা।

 

১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতায় ছিল তালিবান। সেসময় নারী নির্যাতনের এক ভয়াবহ রূপ দেখেছিল গোটা বিশ্ব। মেয়েদের স্কুলে যেতে দেওয়া হত না। বাইরে কাজ করারও অনুমতি ছিল না। এমনকী, বাড়ির বাইরে পা রাখলেই বোরখা পরা ছিল বাধ্যতামূলক। নিদান অমান্য করলেই নেমে আসত শাস্তির খাঁড়া! মাঝে কিছুটা সময় তালিবানের হাত থেকে শাসনক্ষমতা গেলে আফগানিস্তানে মেয়েদের স্বাধীনতা কিছুটা ফিরে আসে। তালিবান ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের অবস্থা পুনর্মূষিক ভব।

 

এবারে আফগানিস্তান দখলের পর নিজেদের আগের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছিল তালিবান। অন্তত, তাদের কথা তা মনে হয়েছিল বিশ্বের। তারা বলেছিল, হিজাব পরলেই চলবে, বোরখা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু তা যে কেবল সান্ত্বনা ছিল, তা তালিবানের নয়া ফতোয়া থেকে স্পষ্ট।

 

নারী নিরাপত্তা, সম্মান, স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তালিবান নয়া ফতোয়া জারি করল আফগান মহিলাদের জন্য। এখন থেকে জনসমক্ষে বোরখা পরতে হবে আফগান মহিলাদের। কেবল হিজাবে হবে না। এই নিয়ে তোলপাড় সারা বিশ্ব।

 

হিজাব এবং বোরখার পার্থক্য
'হিজাব' শব্দটি ঢেকে রাখার কাজকে বর্ণনা করে। এটি একটি হেড স্কার্ফ যা মাথা এবং ঘাড় ঢেকে রাখে, তবে মুখটি অনাবৃত রাখে। হিজাবকে আবরক, ওড়না, পর্দা ও বিভাজক ইত্যাদি হিসেবে অনুবাদ করা যেতে পারে। কোরানে এটি আক্ষরিক এবং রূপক- উভয় অর্থে পৃথকীকরণ, সুরক্ষা এবং আচ্ছাদন সম্পর্কিত ধারণাকে বোঝায়। পরবর্তীকালে, শব্দটির অর্থ বিকশিত হয় এবং বর্তমানে এটি সাধারণত মুসলিম নারীদের পর্দা বা নারী-পুরুষের মধ্যে পৃথকীকরণের ধারণাকে বোঝায়। ইংরেজিতে এই শব্দটি মূলত মুসলিম নারীদের মাথা ঢেকে রাখা এবং ইসলাম ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলাকে বোঝায়।

 

বোরখা হল মহিলাদের এক ধরনের পোশাক, যা সারা শরীর ঢেকে রাখে। ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী পর্দা বজায় রাখার স্বার্থে প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নারীরা ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় এটি পরিধান করে থাকেন। কোরানে মুসলিম নারীদের পর্দা প্রথার কথা বলা হয়েছে। এই আদেশের অর্থ হল, দেহের বেশ কিছু অংশ যেমন বক্ষ, কেশ, বাহু এবং পা পরপুরুষের সামনে ঢেকে রাখতে হবে। চোখের সামনে থাকবে একটি জাল।

 

বোরখা আফগানিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পশতুন মহিলারা প্রাক-ইসলামিক সময় থেকে পরে আসছেন। বোরখা মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীর ঢেকে রাখে। সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক এবং বুলগেরিয়া-সহ বেশ কয়েকটি দেশ বোরখা আংশিক বা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে।

 

পর্দা প্রথা মেয়েদের নানা শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে। যেমন, পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের শরীরে কম ভিটামিন ডি প্রয়োজন- এটি একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রোপাগান্ডা, বরং প্রকৃত সত্যটা ঠিক এর উল্টো। মেয়েদের গর্ভকালীন সময়ে, বিশেষ করে শিশুর হাড় তৈরি হওয়ার সময় নারীদের পুরুষদের থেকে অনেক বেশি পরিমাণ ভিটামিন ডি-র দরকার হয়। আর মাত্রাতিরিক্ত যে কোনও উপাদানই প্রাণীদেহের জন্য ক্ষতিকর, তবে সুস্থ শরীরের জন্য প্রতিটি মানুষের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সূর্যালোক প্রতিদিন প্রয়োজন। স্বাভাবিক আবহাওয়ায় সূর্যের আলো আমাদের চামড়ার মধ্যে বিদ্যমান তেলে ভিটামিন ডি তৈরি করে থাকে, যেটা পরবর্তীতে হাড়ের গঠনের জন্য ক্যালসিয়ামকে বৃহৎ আকারে সাহায্য করে। বোরখা দিয়ে পুরো শরীর আবৃত থাকলে নারীদেহ ভিটামিন ডি তৈরি হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে এর ফল মারাত্মক হতে পারে।

 

বোরখা এবং বেশিরভাগ সময় ঘরে থাকার কারণে অধিকাংশ পর্দানশিন নারীর শরীরে `osteomalacia’ বা `bad bones’ নামক মারাত্মক রোগের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও ভিটামিন ডি-র অভাবে শরীরে osteoporosis (হাড়ে ছেদ), depression (অবসাদ), heart desease ( হৃদ রোগ), strode, cancer, diabetes, parathyroid problems, immune function, weight loss-এর (ওজন হ্রাস) মতো মারাত্মক সব রোগের জন্ম হয়। নিয়মিত বোরখা-পরিহিত নারীরা ভিটামিন ডি ও মেলাটোনিনের ( melatonin) অভাবে হাড় ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ত্বকে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশের থেকেও বঞ্চিত হয়। যার ফলে ত্বক তার স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর সুযোগ থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে, যা কিনা মানবশরীরের সবথেকে বড় ইন্দ্রিয়।

 

একথা বলার আর বোধহয় অপেক্ষা রাখে না যে, বোরখা শুধু কোনও সামাজিক ব্যাধি নয়, শারীরিক ব্যাধির নামও।

More Articles