তালিবানের বন্দুক, প্রকৃতির রক্তচক্ষু..., আর কত দুঃখ সইবে আফগানরা

গোটা অঞ্চলে টুকরো টুকরো বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপ। গাড়ি উপর ধ্বসে গিয়েছে টানেল। এখানে ওখানে সেই ইঁট পাথরের ডাঁই হওয়া স্তূপের ভিতর থেকে পা বেরিয়ে আছে লাশের। চাপা পড়ে কাতরাচ্ছে মানুষ। পা হাত ভেঙে গিয়েছে। পাঁজরে আঘাত। স্ট্রেচার নিয়ে ছোটাছুটি চলছে উন্মাদের মতো। কিন্তু অত স্টেচার কই! চারিদিকে বিলাপ আর আর্তনাদের শব্দ। ধুলো খানিক থিতিয়ে এসেছে তখন। একে একে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেন মৃত আত্মীয়ের লাশ, কারোর বাবা, কারো ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, ভাই বোন, মা—মৃতদেহদের জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন বাকিরা, যারা বেঁচে গিয়েও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতে পারছেন না। বহু লোক নিরুদ্দেশ। তাঁদের খবর পেতে পেতে হয়তো লাশ পচে ফুলে উঠবে। এমন যদি হয় আপনার আমার শহরে? কী? ভেবেই শিউরে উঠছেন? আফগানিস্তানের বাস্তব এখন এটাই। গ্রামের পরে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। ধ্বংসস্তূপ হাত দিয়ে খুঁড়ে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন জীবিতেরা। আফগানিস্তানের ভয়াবহ ভূমকিকম্পে মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। তালিবান এবং আন্তর্জাতিক শক্তি একজোট হয়েও পীড়িতদের প্রয়োজনীয় শুশ্রূষা দিয়ে উঠতে পারছেন না, পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ সেখানে।

পাকতিকা অঞ্চলের গিয়ান জেলা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাটির ইঁটের স্তুপের ওপর বসে রয়েছেন গ্রামবাসী, এখানে গত পরশুও ছিল তাঁর বাড়ি। এক মুহূর্তে সব শেষ। কয়েকজন অতি সাবধানে ভাঙাচোরা দেওয়াল, বেরিয়া থাকা খুঁটি এড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছেন সেখান দিয়ে। গত দু দশকে এমন মারাত্মক ভূমিকম্প দেখেনি আফগানিস্তান। এখনও সরকারী কর্মচারীরা আশঙ্কা করছেন, মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজারেরও উপরে আহতদের পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। অন্তত সরকারি সংবাদ মাধ্যমে এই তথ্যই সামনে আসছে।

দশ মাস আগে আমেরিকা এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ আফগানিস্তান থেকে সরে আসে। এরপরেই তালিবান আফগানিস্তানের দখল নেয়। সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আফগানিস্তানকে সাহায্য করা বন্ধ করে দেয় বিশ্বের নানান দেশগুলি। সেই থেকে অবস্থা খুব একটা ভালো নয় সাধারণ আফগানি জনগণের। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, পর্যাপ্ত খাবার নেই মানুষের। দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছেন বহু মানুষ। এই অবস্থায় ৬ এককের প্রচণ্ড ভূমিকম্পে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কয়েকশো গুণ বেড়ে গেল। আদৌ তালিবানেরা ভূমিকম্প পীড়িতদের সাহায্য করতে দেবে কিনা, তা নিয়ে চিন্তিত সবাই। উদ্ধারকর্তা যেটুকু উদ্ধার কার্য চালিয়েছেন, বিনা যন্ত্রপাতি বিনা প্রযুক্তিতে খালি হাতে ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে তাদের কাজ করতে হয়েছে। 

মৃত্যুর হাত থেকে এক চুলের জন্য রক্ষা পেয়েছেন হাকিমুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানিয়েছেন, “আমরা ইসলামিক এমিরেট সহ সমস্ত দেশকে অনুরোধ করছি, আমাদের পাশে দাঁড়ান, আমাদের সাহায্য করুন। বিশ্বাস করুন, আমাদের কিচ্ছুটি নেই। খাটিয়ে শোওয়ার মতো একটা তাবু পর্যন্ত পাইনি আমরা।” ধীরে ধীরে পাহাড়ি গ্রামগুলিতে হওয়া বীভৎস ক্ষয়ক্ষতি সামনে উঠে আসছে। এমনিতেই পাহাড়ি রাস্তায় যান চলাচলের একটু সমস্যা রয়েছে। তার উপর এতটাই বিশ্রীভাবে সেই সব রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে যাতায়াতের প্রায় অনুপযুক্ত হয়ে উঠেছে। একই ধ্বস এবং বৃষ্টির কারণে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এমনিতে ৬ এককের ভূমিকম্প যে খুব ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম, তা নয়। অন্যান্য জায়গায় এমন ভূমিকম্প হওয়ার পরেও বহুতল টিকে গিয়েছে। কিন্তু আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলে বাড়িগুলি মূলত ইঁটের, তাতে মাটির গাঁথনি। পাহাড়ি অঞ্চলগুলিও বেশ ভূমিকম্পপ্রবণ, তাই এখানে সাধারণ ভূমিকম্পও বেশ প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। উদ্ধারকর্তারা হেলিকপ্টার নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু উদ্ধারকার্য তেমন দ্রুত গতিতে হচ্ছে না। তার একটা বড় কারণ বহু মিত্রশক্তিকে দেশছারা করেছিল তালিবানেরা, ফলে সরাসরি কোনও সরকারই তালিবানদের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চাইছে না।

তালিবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ ট্যুইট করেছেন যে, পাকিস্তান আট ট্রাক খাবার এবং অন্যান্য জিনিসপত্র এসেছে। বৃহস্পতিবারই তিনি জানান, ইরান থেকে দুটি এবং কাতার থেকে একটি প্লেন মানবিক সাহায্য নিয়ে এসেছে। এর থেকে বেশি সাহায্য সরসরি করা প্রায় অসম্ভব জেনেই বহুদেশ মানবিক সাহায্য পাঠাচ্ছেন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের হাত দিয়ে বা বিভিন্ন সংস্থার হাত দিয়ে, সোজাসুজি তালিবানের হাতে কোনও রকম অর্থসাহায্য করতে চাইছে না তারা।

পাটিকা অঞ্চলই ভূমিকম্পে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খোস্ত শহর থেকে ৩১ কিমি দূরে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের মেটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিমি গভীরে ছিল এর কেন্দ্র। এ জাতীয় ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ে। বুধবারের ভূমিকম্পে বহু জায়গায় ধ্বস নেমেছে, বাড়ি ও বহুতল ধ্বসে পড়েছে। খোস্তের সেপারে জেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। লোকেদের বাড়িঘর কাদার স্তূপে পরিণত হয়েছে। কড়িকাঠ পর্যন্ত ফেটে হাঁ হয়ে গিয়েছে এখানে সেখানে। রাতের বেলা কম্বলকে তাবুর মতো খাটিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল লোকে, প্রবল হাওয়ায় সে সবও উড়ে গিয়েছে।

সেপারে জেলাপ্রধান জানিয়েছেন, “পার্বত্য এলাকা, ফলে সমস্ত খোঁজখবর এখনও পাওয়া যায়নি। পাওয়াটা কঠিন। তবু তারই মধ্যে যেটুকু পারা যায়, সেটুকু খবারাখবর জোগাড়ের চেষ্টাচরিত্র চলছে আর কি!” বৃহস্পতিবারের একটি নিউজ বুলেটিন জানাচ্ছে, আফগানি সরকারি দূরদর্শনে সম্প্রাচারিত হয়েছে তাদের পরম শত্রু জো বাইডেনের বক্তৃতা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ভূমিকম্পের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন এবং মানবিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া একটি স্টেটমেন্টে উনি জানান, যে ইউএসএইড এবং সরকারের অন্যান্য সঙ্গীরা আফগানিস্তানের ভূমিকম্পে পীড়িত মানুষদের যেভাবে পারবেন সাহায্য করবেন।

More Articles