দেশজুড়ে আগুন জ্বালিয়েছে 'অগ্নিপথ'! কী এই প্রকল্প, কেন দাবানলের মতো ছড়াচ্ছে বিক্ষোভ?

কেন্দ্রীয় সরকারের 'অগ্নিপথ বিকল্প' ঘিরে তুমুল অশান্তি দেশজুড়ে। দেশের বহু জায়গায় তরুণরা এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন।

 

কেন্দ্রীয় সরকারের 'অগ্নিপথ প্রকল্প' ঘিরে তুমুল অশান্তি দেশজুড়ে। দেশের বহু জায়গায় তরুণরা এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। মঙ্গলবার এই প্রকল্পের ঘোষণার পর বুধবার থেকেই প্রতিবাদে সামিল হয়েছে তরুণরা। আজ দ্বিতীয় দিনেও ছাত্রদের বিক্ষোভ অব্যাহত। সকাল থেকেই রাস্তা অবরোধ,রেল লাইনে অবস্থান দেখিয়ে প্রতিবাদ করছেন তরুণ ছাত্ররা। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং চুক্তিভিত্তিক সেনা নিয়োগের এই প্রকল্প ঘোষণাকে 'ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত' বলে উল্লেখ করছেন। তবে অনেকেরই মত, এর চেয়ে অন্য চাকরি খোঁজা বেশি বুদ্ধিমানের কাজ ।

অগ্নিপথ প্রকল্প কী?

ভারতীয় সশস্ত্র সেনাবাহিনীর তিন শাখায় (স্থল, নৌ ও বায়ুসেনা) চুক্তির ভিত্তিতে সেনা নিয়োগের জন্য অগ্নিপথ প্রকল্পের ঘোষণা করেছে সরকার। এই প্রকল্পের আওতায় নিয়োগ করা সেনাদের পোশাকি নাম 'অগ্নিবীর'। এই প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিক পর্যায়ে চার বছরের জন্য নিয়োগ করা হবে অগ্নিবীরদের। সাড়ে ১৭ বছর থেকে ২১ বছর বয়সি তরুণ-তরুণী, সকলেই অনলাইনে আবেদন করতে পারবে এক্ষেত্রে। ভারতীয় সেনার নির্ধারিত মাপকাঠির ভিত্তিতে মেধা যাচাই, ইন্টারভিউ এবং শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষার পর নিয়োগ করা হবে এই অগ্নিবীরদের।

প্রাথমিক পর্যায়ে মাসিক বেতন হবে ৩০ হাজার টাকা (প্রথম বছরে মোট ৪ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা)। চুক্তির শেষ বছরে এই বেতন বেড়ে হবে ৪৫ হাজার টাকা (শেষ বছরে আয় ৬ লক্ষ ৯২ হাজার টাকা)।

আরও পড়ুন: নুপুর শর্মা একা নন, যে বিজেপি নেতারা একই কাজ করেছেন অতীতে

প্রথম ছ’মাস চলবে প্রশিক্ষণপর্ব। চার বছর পর অগ্নিবীরদের ২৫ শতাংশকে যোগ্যতার ভিত্তিতে ভারতীয় সেনায় আরও ১৫ বছরের জন্য নিয়োগ করা হবে। বাকিরা, অর্থাৎ যাঁরা যোগ্যতা পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে না, তাঁরা ‘সেবা নিধি’ প্রকল্পে ১১ থেকে ১২ লক্ষ টাকা নিয়ে অবসর গ্রহণ করবেন। অবসরের সময় পাওয়া ১০ লক্ষ ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়করমুক্ত হবে। ছাঁটাই হওয়া সেনাদের মধ্যে যাঁদের বয়স থাকবে, তাঁরা ফের ভারতীয় সেনার স্থায়ী পদে নিয়োগের জন্যও আবেদন জানাতে পারবেন।অগ্নিবীরদের একাংশকে পরিবহণ মন্ত্রক, শুল্ক দপ্তরের মতো বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থায় নিয়োগ করার বন্দোবস্ত করবে স্বয়ং সরকার। আবার অবসরের পর ব্যবসা করতে চাইলে পাবেন ব্যাঙ্ক ঋণের বিশেষ সুবিধা।

এছাড়াও কর্তব্যরত অবস্থায় কোনও অগ্নিবীর আহত বা নিহত হলে তিনি বা তাঁর পরিবারকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর একজন সদস্যর সমান ক্ষতিপূরণ, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। সঙ্গে বিনা মূল্যে ৪৮ লক্ষ টাকার জীবনবিমা। এ-বছর ৪৬ হাজার অগ্নিবীর নিয়োগ করা হবে বলেও জানিয়েছে সরকার।

সামরিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, এই প্রকল্পের কারণে অনেক তরুণ দেশসেবা এবং দেশ গড়ার কাজে সরাসরি যুক্ত হতে পারবেন। সশস্ত্র বাহিনীও তরুণ প্রজন্মের দ্বারা গঠিত হওয়ায় অনেক বেশি প্রাণবন্ত হবে।

সরষের মধ্যেই ভূত

বর্তমানে দেশের সেনাবাহিনীতে মোট জওয়ানের সংখ্যা ১৩ লক্ষরও বেশি। সেখানে নতুন প্রকল্প মতে বছরে মাত্র ১২ হাজার জওয়ান নিয়োগ করা হবে। বছরে দু’বার নিয়োগ হলেও এই সংখ্যাটা দাঁড়াবে ২৪ হাজার। তাও মাত্র ১৫ বছরের জন্য। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের পেনশন নিয়ে উদ্বেগ কমবে। পেনশন নিয়ে সেনাকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবিদাওয়া রয়েছে। নতুন প্রকল্পের সাহায্যে সেই দাবিকেও ঘুরিয়ে পাশ কাটানো যাবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে সাপও মরবে আর লাঠিও ভাঙবে না। কিন্তু এর ফলে স্থায়ী সেনার সংখ্যা কমবে বলেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অনেকে আবার প্রশ্ন তুলেছেন, চার বছর পর কী হবে? এই চাকরির নিশ্চয়তা কোথায়? প্রাক্তন সেনাকর্তা প্রবীর সান্যাল সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, "চার বছর পর এদের ভবিষ্যৎ কী হবে?" তবে জানা গেছে যে আগামী ৩ মাসের মধ্যেই দেশজুড়ে অগ্নিপথ প্রকল্পের মাধ্যমে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

দেশজুড়ে বিক্ষোভ

অগ্নিপথ প্রকল্পের ঘোষণার পর থেকেই বিক্ষোভ ফেটে পড়েছে বিহার। ছাপরায় পাথর ছুড়ে ট্রেন থামিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। বাস ভাঙচুরও করা হয়। এখনও পর্যন্ত তিনটি ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। পূর্ব রেলের মোট ২২টি ট্রেন বাতিল করা হয়েছে ইতিমধ্যেই। বক্সারের দুমরাও স্টেশনেও সুবিধা এক্সপ্রেসের এসি কামরার জানলার কাচ ভেঙে ফেলা হয়। পাশাপাশি স্টেশনে আগুনও জ্বালিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভ-অবরোধের জেরে ৮৩ এবং ১১০ নম্বর জাতীয় সড়কে যান চলাচল আটকে যায়। অশান্তি ছড়িয়েছে আরা, নওয়াদা, মুঙ্গের-সহ বিহারের আরও কয়েকটি শহরে। প্রতিবাদে শামিল হওয়া তরুণদের কথায়, "দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের চাকরির বড় ভরসা ভারতীয় সেনা। চাকরিতে স্থায়িত্বের কারণে গরিব ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণরা মূলত এই সেনার চাকরিকেই বেছে নেন। এই প্রকল্পে সেই চাকরির নিশ্চয়তা কোথায়?"

বেগুসরাইয়ে সেনাবাহিনীর চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া বহু যুবক কেন্দ্রীয় সরকারকে এই প্রকল্প প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। একজন পরীক্ষার্থীর কথায়, "সারা বছর পরিশ্রম করে সেনাবাহিনীর চাকরি পাওয়া যায়। চার বছর সেনাবাহিনীর কাজ করে কীভাবে দেশরক্ষা হবে? সরকারের উচিত দ্রুত এই প্রকল্প প্রত্যাহার করা।" নাওয়াদায় বিজেপি নেত্রী অরুণা দেবীর গাড়ি লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে বিক্ষোভকারীরা। অরুণা দেবী-সহ মোট পাঁচজন জখম হয়েছেন এই ঘটনায়। এমনকী, সেখানকার বিজেপি পার্টি অফিসেও ভাঙচুর করা হয়েছে।

'অগ্নিপথ' প্রকল্পের বিরুদ্ধে গুরুগ্রাম এবং রেওয়ারির বিলাসপুর এবং সিধরাওয়ালি এলাকায় কয়েকশো যুবক রাস্তায় নেমেছে। এই প্রকল্পর বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশের কয়েকটি জেলাতেও বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। ছাত্ররা বুলন্দশহরের জিটি রোড অবরোধ করে সশস্ত্র বাহিনীতে স্বল্পমেয়াদি নিয়োগ প্রকল্প অগ্নিপথ প্রত্যাহারের দাবিতে স্লোগান তুলেছে। উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতেও বিক্ষোভ করছে ছাত্ররা। দিল্লি-জয়পুর এক্সপ্রেসওয়েতেও জমায়েত করে বিক্ষোভ শুরু করে ছাত্ররা।

হরিয়ানা রাজ্যেও কয়েকশো যুবক প্রতিবাদে সামিল হয়েছে। হিমাচল প্রদেশে নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে গাগ্গাল বিমানবন্দরের সামনে বিশাল-সংখ্যক তরুণ বিক্ষোভ শামিল হয়েছে।

 

 

 

More Articles