সায়েন্স ফিকশন ফিল্মে মানুষের তৈরি যন্ত্রই মানুষের শত্রু

'ফ্যানটাসটিক ৮ম বার্ষিকী' সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত। বানান ও যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত রাখা হল, নামকরণ সম্পাদকীয় দপ্তরের। মূল প্রবন্ধটি অমৃতবাজার পত্রিকা ১৯৬৬ পূজাবার্ষিকী থেকে অনূদিত। অনুবাদক: ড. অসীম বর্ধন।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার: রায় পরিবার, ফ্যানটাসটিক পত্রিকা, কল্পবিশ্ব প্রকাশনী

 

সায়ান্স-ফিকশ্যন এবং স্পাই এর গল্প নাকি আজকাল ক্রমশই রহস্য-রোমাঞ্চের হালকা গল্পের জায়গা দখল করে বসছে। আমি জানি না স্পাই গল্পের বাজার কেন এত গরম– জেমস বন্ড বোধহয় এর কারণ– তবে যে যুগে দ্রুত বিজ্ঞান-কারিগরীর উন্নতি হচ্ছে, অতি সাধারণ মানুষেরও চোখের সামনে অতি নিকট থেকে তোলা চাঁদের ফোটো নতুন কল্পনার জগৎ মেলে দিচ্ছে, মহাকাশচারীকে মহাশূন্যে ভারহীন অবস্থায় ভাসতে দেখা যাচ্ছে, সে যুগে সায়ান্স-ফিকশ্যনের অভ্যুদয় হবেই।

সায়ান্স–ফিকশ্যন নতুন কিছুই নয়। যে রূপে আজ এ জিনিস আমরা দেখছি, অন্তত এক শতাব্দী আগেই তার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, জুল ভের্ণের ‘ফাইভ উইকস্ ইন এ বেলুন’ উপন্যাসে তার সূচনা। ভের্ণ প্রথমদিকে এ নিয়ে চর্চা চালিয়ে গেছিলেন, এরপর এচ্ জি ওয়েলস ‘দি টাইম মেশিন’ নিয়ে আবির্ভূত হলেন এবং তাঁর বিখ্যাত ডজনখানেক গল্পকল্প অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী পরিবেশন করলেন।

বলতে পারা যায়, বর্তমান শতকের প্রথম দশ-বারো বছরের শেষ থেকেই এই নতুন সাহিত্য শাখা শেকড় গাড়তে শুরু করে, এবং তখন থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে এর সমৃদ্ধি বিকাশ চলতে থাকে। আজ এর যে ফুলে-ফলে বাড়বাড়ন্ত দেখছি, তা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী যুগের বিস্ময়াবহ ব্যাপার, যার মধ্যে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার অবদান-ধারা সংমিশ্রিত হয়েছে।

'২০০১: এ স্পেস ওডিসি' ছবির দৃশ্য

সিনেমার মধ্যেও যে সায়ান্স-ফিকশ্যন বিজ্ঞানসুবাসিত সাহিত্য বিকাশ প্রতিফলিত হয়েছে সমানভাবে, তার স্বাক্ষর ফ্রান্সের জর্জ মেলিসের ‘এ ট্রিপ টু দি মুন’ ফিল্‌ম এবং নির্বাক ছায়াছবি-যুগের গোড়ার দিকে তোলা ঐ ধরনের অন্যান্য কল্পনা রঙিন ফ্যানটাসি ফিল্‌মের মধ্যে আঁকা হয়ে গেছে।

মেলিস্ মূলতঃ তাঁর সাদাসিধে দর্শকমণ্ডলীকে কিছু ‘বিশেষ ধরনের কায়দাকৌশল’ দেখিয়ে আনন্দ দেওয়ার জন্যেই এ ধরনের ছবিতে হাত দিয়েছিলেন। এই উদ্যম আশ্চর্যের নয়, কারণ চলচ্চিত্রে ছবির ভ্রমবিলাস জাগানোর সম্ভাবনা এ পথের অগ্রণীদের মধ্যে যাঁরা একটু উদ্ভাবনপ্রিয় এবং আমুদে, তাঁদের মনে নাড়া দেবেই। আর মনে রাখতে হবে, মেলিস ছিলেন ভের্ণের দেশের লোক।

আরও পড়ুন: জীবনের নোংরা দিকটা আমার ছবিতে যথেষ্ট উঠে এসেছে’: সত্যজিৎ রায়

তবে তখনকার দিনে যা হয়— মেলিসের বহর ছিল ছোট। বড় ফ্যানটাসি কল্পনা রাঙানো ফিল্‌মের সৃষ্টি প্রতীক্ষা করে ছিল ১৯২০ সাল পর্যন্ত, তারপর ফ্রিৎস ল্যাং-এর উচ্চাশাপূর্ণ উদ্যোগে প্রস্তুত ফিল্ম ‘মেট্রোপলিস’ নিয়ে জরমানী বিজয় পদক্ষেপ করলো এদিকে। এটি ভবিষ্যৎমুখী এক ফ্যান্টাসি, কলাকৌশল এবং কর্মনৈপুণ্যের সুবাদে হৃদয় জয় করে ফেললো: সে-সময় কারিগরীতে কেউ জরমনদের ছাড়িয়ে যেতে পারত না। মেশিন প্রভুত্ব করছে এমন এক জগতের মানুষদের অবস্থা নিয়েই ফিল্‌মটির বিষয়ৰস্তু। বিজ্ঞানসুবাসিত গল্প-লেখকদের কাছে এ ধরনের বিষয়বস্তু খুবই প্রিয়; এচ্ জি ওয়েল্‌স নিজেই তো এরকম ভবিষ্যদ্বাণীমূলক গল্প লিখেছিলেন ‘দি শেপ অফ থিংস টু কাম’। গল্পটির ফিল্‌ম করেছিলেন আলেকজাণ্ডার কোরডা এবং এটি ১৯৩০ সালের যুগে বৃটিশ স্টুডিও থেকে প্রস্তুত সবচেয়ে বিরাট ছবি।

'বঙ্কুবাবুর বন্ধু' গল্পের অলংকরণ। শিল্পী: সত্যজিৎ রায়

‘মেট্রোপলিস’ এবং ‘দি শেপ অফ থিংস টু কাম’ দু-খানি ছবিই দৃশ্য অবতারণার মধ্যে দিয়ে কল্পনাকে সচকিত করে তোলার অভিযান শুরু করে। অবশ্য, এগুলোর মধ্যে সামাজিক কথাও বলবার ছিল। কিন্তু যেহেতু ছবিগুলির দৃষ্টি প্রসারিত ছিল বহু শতাব্দীর প্রান্তর পেরিয়ে, তাই সেই সময়কার দর্শকরা ছবির সামাজিক ব্যাপারগুলির সঙ্গে যেন খানিকটা আবেগপ্রবণ সংস্পর্শ অনুভব করতেন। তার মানে বলতে হয়, ভবিষ্যতের দিকে তাঁদের দৃষ্টি ছিল নিষ্প্রাণ নিরুদ্বিগ্ন।

আজকাল অবশ্য এরকম রেওয়াজ নেই— অন্ততঃ ফিল্‌মে নেই। আজ নতুন নতুন কাহিনী সম্ভার নিয়ে নতুন ধাঁচের এতরকম ছবি উঠছে যে, বিশ বছর আগের মতো এখন আর সায়ান্স-ফিকশ্যন ফিল্ম বলতে একটি মাত্র শিরোনামার নীচে তার বহুমুখী প্রকাশকে এক চোটে বুঝিয়ে দেওয়া যায় না।

যেমন, তার একটি ধরন— যেটিকে তালিকার নীচের দিকেই স্থান দিতে হয়— তাতে থাকে দৈত্যদানবাকৃতি প্রাণী— সেগুলো প্রাগিতিহাস যুগের জানা বা অজানা আকৃতি নিয়ে সাগরের তলা থেকে বেরিয়ে আসে কিংবা পারমাণবিক বা ঐরকম কোনো বিস্ফোরণের ফলে কোনো মেরু প্রদেশের হিমশীতলতা থেকে হয়তো মুক্তি পেয়ে বেরোয়।

আর একটি ধরন, একটু উঁচু দরের, তাতে সাধারণ নিরীহ পিঁপড়ে, মাছি বা মাকড়শার মতো প্রাণীর কাহিনী থাকে, যারা বিজ্ঞানের বা প্রকৃতির দুর্ঘটনার দুর্বিপাকে আকৃতি বদলে দানবরূপ পরিগ্রহ করেছে।

তৃতীয় ধরনের ছবিতে মানুষকে কোনো বৈরী গ্রহের অশুভ শক্তির সম্মুখীন করা হয়। এর আবার শ্রেণীবিভাগ করা যায়, কেন না আপনি দেখবেন কখনো মানুষ যাচ্ছে অন্য গ্রহে, কখনো দেখৰেন অন্যগ্রহের বাসিন্দা নামছে পৃথিবীর মাটিতে। আপনি এখনও দেখতে পারেন যে, বহির্গ্রহের বাসিন্দারা দূরস্থিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সাহায্যে মানুষকে প্রভাবিত করছে আর মানুষকে সেই বিভীষিকার রূপবর্ণহীন নিরাকার চাপের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

চতুর্থ এবং শেষ ধরনের ছবিতে দেখা যায় মানুষ তার নিজেরই বিজ্ঞান কারিগরীর বিভীষিকায় আতঙ্কিত হচ্ছে। অবশ্য এ হলো প্রসিদ্ধ ফ্রাংকেন-স্টাইন ধরনের ছবি, তবে এরই নানা ধাঁচের যেসব ছবি উঠেছে, তাও অনেক। ফ্রাংকেন-স্টাইন জাতীয় গল্পে দানবের জায়গায় রোবট আসছে এবং বহু সায়ান্স-ফিকশ্যন ফিল্‌মে সুচতুর ভাবে ভয়ঙ্কর রূপে এর আবির্ভাব ঘটানো হচ্ছে। এরকম সবচেয়ে ভালো ফিল্‌ম বোধ হয় ‘ফরবিডন প্ল্যানেট’। তবে বিপদাশঙ্কা সৃষ্টির জন্যে মানুষের তৈরী জিনিসের মধ্যে রোবটই বোধহয় একমাত্র নয়। এমনকি প্রকাণ্ড দৈত্যাকার অঙ্কবিশারদ কমপিউটার মেশিন (যেগুলোকে ‘জায়ান্ট ব্রেন’ বলা হয়) ছবিতে এমনভাবে দেখানো হচ্ছে যেন সেগুলোর নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি জেগে উঠছে এবং সেই যন্ত্র নিজের সৃষ্টিকর্তারই বিরুদ্ধে রুখে উঠছে।

১৯৪০ সাল নাগাদ যখন থেকে সায়ান্স-ফিকশ্যন যাবতীয় কলাকৌশল এবং জ্ঞান-দক্ষতার সংস্পর্শ লাভ করতে থাকলো, তখন থেকেই এই ধরনের ফিল্‌ম সৃষ্টি হচ্ছে। তবে এরকম ফিল্ম কখনই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। অবশ্য যখন এসব ফিল্ম খুব বড় পরিকল্পনায় বিরাট জমকালো ভাবে করা হয় তখন জনপ্রিয় হয়– যেমন হয়েছে ‘ওয়ার অফ দি ওয়ার্লডস’, ‘ফরবিডন প্ল্যানেট’, এবং ডিসনীর ‘টোয়েনটি থাউজ্যান্ড লীগ্‌স্ আন্ডার দি সী’। এসবের পাশে পাশে মাঝারি ধরনের কল্পনাপুষ্ট ফিল্‌ম তোলা হয়েছে, তবে সেগুলোর বহর দেখেই বোঝা যায়, প্রযোজকরা ছবির ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।

যাই হোক, মনে হয়, অবশেষে এখন এমন একটা সময় এসেছে যখন সায়ান্স-ফিকশ্যন ফিল্‌মকে ‘থ্রিলার’ রহস্যচিত্রের চেয়ে খুব বেশী ঝুঁকি বলে আর ভাবা হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, এই ফিল্‌ম শাখাটি এমন সব চিত্রপরিচালকদের আকর্ষণ করতে শুরু করেছে, যাঁরা হালকা ধরনের ছেলেমানুষী কাজে কখনোই নিজেদের জড়াতে পারেন না। ফ্রান্‌সে ত্রুফো এবং গডার্ড, আমেরিকায় জোসেফ লোসী এবং স্ট্যানলী কুবরিক তাঁদের প্রথম সায়ান্স-ফিকশ্যন ফিল্‌ম করছেন কিংবা ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন। কুবরিকের ফিল্‌ম ‘২০০১: এ স্পেশ ওডিসী’ একটি স্টুডিওতে গৃহীত হচ্ছে। গত জুলাই মাসে আমি একদিন এর কাজ দেখতে পেরেছিলাম ; আমার সঙ্গে ছিলেন কুবরিকের ‘এ স্পেশ ওডিসী’র যুগ্ম লেখক, জ্যোতির্বিদ, কলিঙ্গ পুরস্কার বিজয়ী সায়ান্স-ফিকশ্যন লেখক আরথার ক্লার্ক।

ফিল্‌মটির মধ্যে যে পরিমাণ গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা মেশানো হয়েছে, তা পরম বিস্ময়কর। ক্লার্ক নিজে প্রতিটি ব্যাপার নিশ্চিতভাবে যাচাই করে দেখেছেন, যেন বৈজ্ঞানিক দিক থেকে নিখুঁত নয় এমন কোনো জিনিস ফিল্‌মটিতে স্থান না পায়।

হাজার হাজার স্কেচ, প্ল্যান আর ডায়াগ্রাম নক্সা আঁকা হয়েছে স্পেশ-স্যুটের, রকেটের, মুন-বাসের এবং স্যাটেলাইট স্টেশনের- যেখানে ফিল্‌মটি তোলা হচ্ছে সেই এম জি এম স্টুডিওর ডজনখানেক অফিস ঘরের সেল্‌ফে এবং ড্রয়ারে সেগুলো বোঝাই হয়ে আছে, ছড়িয়ে রয়েছে মেঝেতেও। একটা মস্ত বড় ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে মডেলের জন্যে- স্পেশশিপ, ল্যানডিং স্টেশন এবং স্যাটেলাইটের মডেল। সমস্ত উদ্যোগটির সুসংবদ্ধ নিখুঁত প্রয়াসের ব্যাপারটি দেখলে তবে বিশ্বাস হবে! যেহেতু চাঁদে যাওয়ার অভিযান নিয়ে গল্পটি রচিত, তাই একটি রকেটের মধ্যেকার সমস্ত মূল্যবান উপাদানের অন্যতম হয়ে উঠেছে। রকেটটির ডিজাইন যিনি করেছেন, তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তিনি সত্যিকারের রকেট ডিজাইনের ক্ষেত্রে একজন শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ রূপে পরিচিত হয়ে পড়েছেন। তার মানে, ফিল্‌মে যে রকেটটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি তত্ত্বসূক্ষ্মতার দিক দিয়ে সত্যিকারের আকাশ পাড়ি দিতে পারে, যদিও কখনই স্টুডিও চত্বরের বাইরে একে বেরুতে দেওয়াই হবে না।

আমি যখন স্টুডিওর সেটে হাজির হলাম, দেখলাম রকেটের কনট্রোল প্যানেলের একটা ‘শট’ তোলা হচ্ছে। এর জন্যে, কনট্রোল বোর্ডের ষোলটি ১৬ মি মি ক্যামেরা বসানো হয়েছে এবং একসঙ্গে রঙবেরঙের ষোলটি চলচ্চিত্রায়িত চার্ট ঐ বোর্ডের ষোলটি ভিউ-প্যানেলে ফেলা হচ্ছে। ঐ প্যানেলগুলির ফোটোই তুলে যাচ্ছে একটি ৭০ মি.মি ক্যামেরা। ক্লার্ক বললেন, ঐ সব চার্ট গুলোই কোনো বিজ্ঞানীর কাছে অর্থপূর্ণ। এই অতি সযত্ন প্রয়াস এবং বিরাট বহর থেকেই মনে হয় ‘এ স্পেশ ওডিসী’ যাঁরা তুলেছেন, তাঁদের দৃপ্ত ঘোষণার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে; তাঁরা দাবী করেছেন, এ যা বিরাট ফিল্‌ম হবে, তেমন আর নাকি হয়নি। আর বিরাট মানেই স্বভাবত দামী! স্টুডিওটি থেকে সেদিন সন্ধ্যায় আমি সত্যি সত্যি এই ধারণা নিয়েই ফিরেছি যে, সায়ান্স-ফিকশ্যন অবশেষে নিজের মর্যাদা লাভ করতে শুরু করেছে; এবং ভবিষ্যতের গর্ভে মানুষের যা কিছু সঞ্চিত আছে, তার মধ্যে নিশ্চয়ই আরো ভালো, আরো গুরুত্বপুষ্ট সায়ান্স-ফিকশ্যন ফিল্‌মের সম্ভাবনা রাখা আছে।

More Articles