ইংল্যান্ডের রানি পরতে ভয় পান, কেন আজও বিতর্কিত তৈমুর রুবি?

তৈমুরের রুবি বলতে যে পাথরটিকে আমরা চিনি, তা আসলে চুনি নয়। এই ধরনের অষ্টমুখী স্ফটিককে 'স্পাইনেল' বলা হয়। বাংলায় অনেকে একে 'লোহিতক'-ও বলে থাকেন। উজ্জ্বল লাল এই স্ফটিকটির আকার ঠিক যেন দু'টি পিরামিডকে কেউ ভূমি অনুযায়ী পরস্পরের ওপর বসিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে দ্য ব্রিটিশ রয়্যাল কালেকশনে রয়েছে এই রুবি। এর ইতিহাস জটিল, বর্তমানও বিতর্কিত। কিন্তু কেন? একটি সামান্য পাথরকে ঘিরে কীসের এত গুঞ্জন? আসুন, আজ জেনে নিই তৈমুর রুবির রহস্যাবৃত ইতিহাস।

 

তৈমুর রুবির নামটি এসেছে কুখ্যাত তৈমুর লং-এর নাম থেকেই। মধ্য এশিয়ায় বিশাল তৈমুরীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৈমুরের নাম আমরা প্রায় সকলেই শুনেছি। ১৩৩৬ থেকে ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দ, প্রায় সত্তর বছর বেঁচেছিলেন তৈমুর। তৈমুরের পায়ে একটি সামান্য অসুবিধে ছিল, খুঁড়িয়ে হাঁটার জন্যই লং বা ল্যাং শব্দটি জুড়ে যায় তাঁর নামের সঙ্গে। সম্ভবত, যুদ্ধে আহত হয়েই তাঁর পা-টি অকেজো হয়ে গিয়েছিল। তাঁর আসল নাম ছিল সুজাউদ্দিন বেগ তৈমুর বারলাস। চেঙ্গিস খানের বংশে জন্মানো এই দুর্ধর্ষ সেনানায়কের গোত্র অর্গুজ। তৈমুরের দুনিয়াজয়ের অভিযান আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আধুনিক তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশই তাঁর সাম্রাজ্যের মধ্যে ছিল। কাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্ক্মেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, পাকিস্তান, ভারতের খানিক অংশ, এমনকি চিনের কাশগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই রাজ্য। 'তুজুক ই তৈমুরী' নামে একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ লেখেন তিনি। এহেন তৈমুরের কাছে কীভাবে রুবিটি এসে পৌঁছয়, তার লিখিত কোনও তথ্য নেই। তবে পৌঁছনোটা যে খুব একটা অসম্ভব ছিল না, তা সহজেই অনুমেয়। বলা হয়, রুবিটি একদম প্রথমদিকে যাদের হস্তগত হয়েছিল, তৈমুর নাকি ছিলেন তাঁদেরই একজন। সেই হিসেবে রুবিটি খনি থেকে ওঠে চতুর্দশ শতকে বা তারও আগে। যদিও কোন পর্যায়ে রুবিটি তৈমুরের করায়ত্ত হয়, সে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

 

রুবিটি বিষম আকারের। খুব ভালো করে পালিশ করা, কিন্তু এই ধরনের স্পাইনেলে সাধারণত কেটে মুখ বের করা হয় না। প্রাকৃতিক মুখগুলিকেই পালিশ করা হয়। ওজনে ৩৬১ ক্যারাটের রুবিটি যে বেশ বড়, তা আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। পাঁচজনের নাম রুবিটিতে খোদাই করা আছে, নিশ্চিতভাবে রুবিটি যাঁদের সম্পত্তি ছিল বলে মনে করা হয়। আকবর, জাহাঙ্গির (১৫৬৯-১৬২৭), ফারুকসিয়র (১৫৯২-১৬৬৬), নাদির শাহ (১৬৮৮-১৭৪৭), আফগানিস্তানের সম্রাট আহ্‌মেদ শাহ দুরানি (১৭২২-১৭৭২)। এঁদের মধ্যে আকবরের নামটি নাকি জাহাঙ্গীর নিজেই খোদাই করেছিলেন। আকবরের হেফাজতে আদৌ রুবিটি ছিল কি না, জানা যায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর হাতবদল হয়েছে রুবিটির। ভারত থেকে ইরান এবং আফগানিস্তান হয়ে ফের ভারত ইত্যাদি।

 

আরও পড়ুন: কেন অসম্পূর্ণ জগন্নাথ মূর্তির হাত-পা? অলৌকিক সেই কাহিনি আজও রোমহর্ষক

 

১৮১৩ নাগাদ ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলে শিখ সাম্রাজ্যের সম্রাট মহরাজা রঞ্জিৎ সিং-এর কাছে এসে পোঁছয় রুবিটি। ১৮৪০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র মহারাজা শের সিং রত্নটি পান উত্তরাধিকার সূত্রে। শের সিং আততায়ীর হাতে খুন হয়ে যান। সেসময় তাঁর পাঁচ বছরের ভাই দলীপ সিং-কে মহারাজা ঘোষণা করা হয়। রাজ্য পরিচালনার বয়স হয়নি দলীপের। আর এই সুযোগটাই নিয়েছিল ইংরেজরা। ১৮৪৮-'৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন শিখ সাম্রাজ্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন দলীপের বয়স মাত্র দশ। প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও এক সময় হার মানল দলীপ। বাধ্য হয়ে নিজের রাজত্ব ইংরেজদের লিখে দিতে হল তাঁকে। সঙ্গে সঙ্গে স্কটিশ অভিভাবক নিযুক্ত হল তাঁর। দেশের আত্মীয়স্বজন কারও সঙ্গেই আর কোনওরকম যোগাযোগ রাখতে দিল না ইংরেজরা। সেই সময়কার দু'টি উল্লেখযোগ্য রত্ন দলীপের হাতে ছিল- কোহিনূর এবং তৈমুর রুবি। দু'টিই কেড়ে নিল ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকেরা একে উপহার বলে চালাতে চাইলেও আদতে এ ছিল সোজাসাপটা চুরিই।

 

রত্নদু'টিকেই লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হল রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হল দলীপকেও। সারা জীবন বহুবার নিজের দেশে ফিরতে চেয়েছেন দলীপ। কিছুতেই তাঁকে ফিরতে দেয়নি ইংরেজরা। আমৃত্যু তাঁকে ইউরোপে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। ১৮৯৩ সালে প্যারিসে মৃত্যু হয় দলীপের। ১৮৬০ নাগাদ মাত্র বারদুয়েক কয়েকদিনের জন্য দেশে আসতে পেরেছিলেন দলীপ।

 

১৮৫০ থেকে তৈমুর রুবি রয়ে গিয়েছে ইংরেজদের কাছেই। ১৮৫১ নাগাদ রত্নটিকে ভালো করে পরীক্ষা করে বোঝা যায়, এটি চুনি নয়, স্পাইনেল বা লোহিতক। একটি সোনা ও হিরে-নির্মিত নেকলেস রানি ভিক্টোরিয়ার জন্য সেই স্পাইনেল দিয়ে বানিয়ে দেন গারার্ড। গারার্ড তখন রাজ-জহুরি। ১৮৫৩ নাগাদ নেকলেসটির কাজ সম্পূর্ণ হয়। এমনভাবেই রুবিটি বসানো হয়েছিল, যেন পরে তৈমুর রুবি খুলে নিয়ে কোহিনুর হিরেও এই নেকলেসে বসানো যায়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ও বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বহু রানিই কোহিনুর এই নেকলেসে লাগিয়ে পরেছেন, তুলনামূলকভাবে তৈমুর রুবি আমরা তেমন দেখি না। ১৯৬৯ নাগাদ বিবিসি 'রয়্যাল ফ্যামিলি' নামে একটি একটি তথ্যচিত্র বানায়। তাতে দেখা গিয়েছিল, রানি ওই নেকলেসটি হাতে নিয়ে সেটির বিষয়ে কথা বলছেন তাঁর ড্রেসারের সঙ্গে। কিন্তু কোহিনুর এবং তৈমুর রুবি চুরি করে নিয়ে যাওয়া নিয়ে ইতিহাসে প্রতিবাদ এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে, আজ আর রানিরা রত্নগুলো পরার সাহস পান না। যদি বিতর্কের দাগ লাগে।

 

কে বলে বিতর্ক খারাপ? মাঝে মাঝে প্রবল বিতর্কও প্রতিরোধ হয়ে উঠতে পারে, তৈমুর রুবি তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

 

More Articles