মমতার বাংলা বিজয়ের বর্ষপূর্তি, অমিত-আগুনেই পুড়ল বঙ্গ বিজেপি?

বাংলায় এসে বঙ্গ বিজেপির দক্ষতা নিয়েই আসলে প্রশ্ন তুললেন অমিত শাহ?

 

বঙ্গ-বিজেপির হাতে স্রেফ পেনসিল ধরিয়ে দিল্লি উড়ে গেলেন অমিত শাহ৷

 

অথচ একবুক আশা নিয়ে 'শাহি' প্রতীক্ষায় ছিলেন রাজ্য বিজেপির নেতারা৷ একুশের ভোটের পর প্রথমবার রাজ্যে আসছেন৷ এর মাঝে একাধিক নেতা দফায় দফায় দিল্লির শাহি দরবারে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে নালিশ ঠুকে এসেছিলেন৷ ভেবেছিলেন, বাংলায় পা রেখেই অমিত শাহ সমানে তোপ দাগবেন মুখ্যমন্ত্রীর দিকে৷ ৩৫৬-র হুমকি দেবেন৷ সিবিআইয়ের তৎপরতা বাড়ানোর কথা বলবেন, কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের হুঁশিয়ারি দেবেন৷ মোটের ওপর এমন কাণ্ড শাহ করবেন, যার জেরে ভয়ে গুটিয়ে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী৷ আর সেই সুযোগে নিজেদের ছাতি আরও চওড়া করে নেবেন রাজ্যের গেরুয়া সেনাপতিরা৷

 

শুরুটা কিন্তু তেমনই হয়েছিল৷ উত্তরবঙ্গে গিয়ে অমিত শাহ নাগাড়ে নিশানা করেছিলেন রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীকে৷ সিএএ লাগু করা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত করেছিলেন৷ তারপর কাশীপুরের অর্জুন চৌরাসিয়ার হত্যা পারদ চড়াল৷ অকুস্থলে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের উদ্দেশ্যে কার্যত কার্পেট-বম্বিং করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ রাজ্য পুলিশের ওপর সরাসরি অনাস্থা প্রকাশ করে চৌরাসিয়া-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত পর্যন্ত দাবি করলেন৷ বাংলার মোগাম্বোরা খুশ হলেন৷ নিজেদের মধ্যে হয়তো আলোচনাও সেরে ফেললেন, ফেরত যাওয়ার আগে 'যশস্বী' অমিতজির মুখ থেকে একবার ৩৫৬-র হুমকিটা যেভাবেই হোক বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে শোনাতেই হবে৷ তাহলেই এ যাত্রায় পূর্ণ হবে ষোলোকলা৷

 

আরও পড়ুন: মমতার সরকারকে টোকা মারা সোজা নয়! মেনে নিলেন অমিত শাহ-ও?

 

কিন্তু 'সাধ না মিটিল, আশা না পূরিল'! কিছুক্ষণের মধ্যে বঙ্গ বিজেপিকে নিশানা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক'-এ যাবেন, তা স্বপ্নেও ভাবেননি শাহের সফরসঙ্গী সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারীরা৷ কিন্তু সেটাই হলো!

 

নিউটাউনের এক হোটেলে দলের সাংগঠনিক বৈঠকে হাজির হয়ে অমিত শাহ স্পষ্টভাষায় বলে গেলেন, "নিজেদের লড়াই নিজেরা করুন, নইলে বাড়ি যান৷" আরও প্রাঞ্জল ভাষায় বললেন অনেককিছুই৷ কী বলেছেন? রাজ্য বিজেপির সব বড় বড় নেতাদের স্বাবলম্বন-বার্তা দিয়ে তিনি বলেন, "দিল্লির দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেরা লড়ুন৷ প্রয়োজনে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। কান্নাকাটি করলে হবে না। আপনাদের লড়াই আপনাদের করতে হবে। আপনাদের লড়াই কেন্দ্রীয় নেতারা লড়ে দেবেন না৷"

 

এদিন শাহ-র কাছে বাংলায় সিবিআইকে আরও তৎপর হওয়ার দাবি জানান রাজ্যের একাধিক বিজেপি নেতা। এর জবাবে শাহ বলেন, "রাজ্যে ২৭২টি মামলা দেখছে সিবিআই। সিবিআইয়ের ভরসায় থাকলে চলবে না। সিবিআই কোনও ঘটনার তদন্ত করতে পারে মাত্র। কিন্তু তৃণমূল নেতাদের জেলে ভরে রাখা সিবিআইয়ের কাজ নয়।"

 

একুশের ভোটের ফলপ্রকাশের কয়েকদিন পর থেকেই শাহের কাছে কারণে-অকারণে নানাভাবে রাজ্যে ৩৬৫ ধারা জারির দাবি জানাতে থাকেন বঙ্গ বিজেপির নেতারা। সিবিআই তদন্ত নিয়েও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওপর চাপ তৈরির চেষ্টাও করছিলেন তাঁরা। এদিনের দলীয় বৈঠকে এই দুই আশায় ঠান্ডা জল ঢেলেছেন অমিত শাহ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যের দলীয় নেতাদের চড়া সুরে বলেছেন, "বিরোধী দল হিসাবে লড়াই করা সব সময়ই কঠিন। আমরাও যখন বিরোধী দলে ছিলাম, অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে ৫০টার কাছাকাছি মামলা রয়েছে। তার মধ্যে ৬টা খুনের মামলা। দেহের অনেক হাড় ভেঙেছে। কেউ যদি মনে করে এরাজ্যের লড়াই অন্য রাজ্য থেকে লড়ে দেবে, তাহলে সে ভুল করছে।"

 

এত দূর পর্যন্ত না হয় ঠিকই ছিল৷ ক্লাসের পিছনের বেঞ্চিতে বসা 'ফেলু' ছাত্রদের মাস্টারমশাই এমন কথাই বলেন৷ কিন্তু এরপরেই শাহ বিজেপির বাংলার নেতাদের চরম বিড়ম্বনায় ফেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াইয়ের উদাহরণ টেনে আনেন৷ বিজেপির শীর্ষ নেতাদের সামনে 'বিরোধী নেত্রী' মমতা-র পথ অনুসরণ করার বার্তা দেন শাহ৷ দলীয় নেতাদের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, "কান্নাকাটি করলে হবে না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্যে দীর্ঘদিন সিপিএম-এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, বিরোধী আসনে থেকেই মার খেয়েছেন। বিরোধী হিসেবে লড়াই করেই মমতা এখন এই রাজ্যের শাসক৷ বামফ্রন্টের রাজত্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লড়াই করতে হয়েছে। সিপিএমের হাতে ওঁকে কম মার খেতে হয়নি। তবু তিনি লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে চলে যাননি। বিরোধী দলে থাকলে রাজনৈতিক লড়াই লড়তেই হয়। সন্ত্রাস, সন্ত্রাস শুধু বলে ভয় পেলে হবে না, লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে।বিরোধী দলে থাকলে বাধা আসবেই। তবুও মাথা উঁচিয়ে লড়াইটা করতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও যখন বিরোধী দলে ছিলেন, তখন তিনি লড়াই করেছেন।" শাসক মমতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াইয়ের দৃষ্টান্তই সুকান্ত-শুভেন্দুদের সামনে তুলে ধরেন অমিত শাহ।

 

অমিত শাহ ওই বৈঠকে বাংলার বিজেপি নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করে বলেন, "একটা দল বিরাট জনমত নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। বঙ্গ বিজেপি এখন শুধু বাংলায় আইনশৃঙ্খলার খামতি রয়েছে বলে অভিযোগ তুলে বারবার রাষ্ট্রপতি শাসন লাগু করার দাবি তুলছে৷ এই দাবি তুললে হবে না। ৩৫৫ ও ৩৫৬ ধারা জারি করে একটি নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়।" এদিন বঙ্গ বিজেপি নেতাদের দাবি সরাসরি খারিজ করে দেন অমিত শাহ। জানা গিয়েছে, খুব বেশিক্ষণ বক্তৃতা দেননি শাহ৷ অল্প কথায় তিনি বুঝিয়ে দেন, রাজ্যে সংগঠন বড় করতে হলে দিল্লির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। লড়াইয়ের মানসিকতা থাকতে হবে৷ যাঁরা ভাবছেন, এমনি এমনিই সব হয়ে যাবে, তাঁরা ঘরে বসে থাকুন। বাংলার নির্বাচিত সরকার ফেলে দিতে হস্তক্ষেপ করবে না কেন্দ্রীয় সরকার। চাইলেই নির্বাচিত সরকারকে ফেলা যায় না। তাই ৩৫৫ বা ৩৫৬ জারি করার দাবি ভুলে যান, লড়াই করুন।”

 

এর পরই অমিত শাহ জানিয়েছেন, এবার থেকে নিয়মিত পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসবেন তিনি। একথায় খুশি হননি বঙ্গ বিজেপির নেতারা৷ দলের এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, "অমিতজি যদি বারবার বাংলায় এসে এমন কথা বলে যান, তাহলে গোটা দলটাই এক সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী হয়ে যাবে৷ বিজেপি বলে এখানে আর কিছু থাকবেই না।"

 

এদিকে রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, অমিত শাহ বঙ্গ বিজেপি নেতৃত্বের দক্ষতা, যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন৷ এরপর রাজ্য বিজেপি তথা পরিষদীয় দলের দায়িত্বপ্রাপ্তদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত একযোগে ইস্তফা দেওয়া৷ কিন্তু এই "অযোগ্য বাহিনী সেই পথে কখনওই হাঁটবে না৷ কারণ এঁদের পদের লোভ মারাত্মক৷"

 

More Articles