'জিন'গুলি মোর সোনার খাঁচায়...

বছর কুড়ি আগে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকুলার বায়োলজি এবং মলিকুলার জেনেটিক্সের এক অধ্যাপক ডঃ অ্যান্টনি জেমস জেদ ধরে বসলেন যে, দেশ থেকে, এমনকি পারলে, সারা বিশ্ব থেকে তিনি ম্যালেরিয়া তাড়াবেন। “ভাগাড়ের মাংস খেয়ে বড় হয়েছি” বলা বাঙালির কাছে এই ঘটনা খুব মামুলি হলেও, জানিয়ে রাখা ভালো যে, প্রতি বছর এই রোগেই হাজার হাজার মানুষ মারা যান সারা বিশ্ব জুড়ে। তা এই রোগ তাড়াতে গেলে যে দুটো কাজ সবার আগে করতে হবে তা হল- এক, এই রোগের বাহক স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশাকে এমন ভাবে নিষ্ক্রিয় করতে হবে যাতে সে এই রোগের জীবাণুকে নিজের শরীরে বাড়তে দিতে না পারে আর দুই (এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধাপ), সারা বিশ্বের সব অ্যানোফিলিস মশাকেই একই ভাবে নিষ্ক্রিয় করতে হবে। অ্যান্টনি তড়িঘড়ি প্রথম কাজটা অর্থাৎ ম্যালেরিয়া-প্রতিরোধী অ্যানোফিলিস মশা তৈরি করতে লেগে গেলেন। বলে রাখা ভালো যে, এইরকম পরিবর্তনের জন্য, যে কোনও জীবের একেবারে সেই প্রাথমিক বংশানুক্রমিক এককের বদল ঘটানো প্রয়োজন। সমস্ত জীবের  এই বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্যগুলির যে ধারক এবং বাহক তাই-ই হল জিন (উৎপত্তি গ্রিক শব্দ gonos থেকে, মানে সন্তান-সন্ততি বা জননক্রিয়া)। আপনি দেখতে কেমন হবেন? বাবার মতো না মায়ের মতো, রোগা না মোটা, লম্বা না বেঁটে, কালো না ফর্সা- সবই ওই জিনের দ্বারা পূর্বনির্ধারিত। শুধু বাহ্যিক গঠনই না, বংশগত রোগগুলোও এই জিনের মারফৎ এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। শরীরের নির্দিষ্ট কোন জিন যখন ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়, কখনও জন্ম থেকে বা অনেকসময় হঠাৎ করে (যা ক্যান্সারের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে) তখনই নানা সমস্যা এবং দূরারোগ্য ব্যাধির জন্ম হয়। যার বেশিরভাগের কোনও আশাপ্রদ চিকিৎসাই নেই! কিন্তু যদি এমনটা হতো যে, যে জিনটি গণ্ডগোল করছে, তাকে সারানো যাবে? আরও ভেঙে বললে, জিনের যে অংশটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তাকে একটা কাঁচি দিয়ে কেটে বাদ দিয়ে যদি আবার বাকিটা জোড়া লাগিয়ে দেওয়া যায় বা যদি বাইরে থেকে একটা একই ধরনের জিন লাগিয়ে দেওয়া যায়? তাহলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যায়। ডঃ অ্যান্টনিও তাই করলেন। অ্যানোফিলিস মশার শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রতিরোধী 'জিন' ঢুকিয়ে দিলেন। ব্যাস! প্রথম কাজটা উদ্ধার হল! বস্তুত, জিন এডিট করলেন তিনি।

একবিংশ শতকের অন্যতম যুগান্তকারী আবিস্কার এই 'জিন বা জিনোম এডিটিং'। জিন নিয়ে কাটা ছেঁড়া করার এই তত্ত্ব আগেও ছিল। কিন্তু যে দু'জন বিজ্ঞানী এই কাজটিকে একদমই জলের মতো সোজা করে দিলেন তাঁরা হলেন, Emmanuelle Charpentier and Jennifer A. Doudna। 'জিনোম এডিটিং'-এর জন্য যে সহজ সরল পদ্ধতি তাঁরা আবিষ্কার করলেন, তার নাম দিলেন-  ক্রিস্পার-ক্যাস৯ (CRISPR-Cas9)। ২০২০ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার স্বীকৃতি দিল এই আবিষ্কারকে। কিন্তু কী এই CRISPR-Cas9?

CRISPR-Cas9-এর ধারণা প্রথম বিজ্ঞানীদের মাথায় আসে কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়ার ভাইরাস রোধ করার সহজাত ক্ষমতা দেখে। ভাইরাস দ্বারা ব্যাকটেরিয়ার আক্রান্ত হবার ঘটনাটা অনেকটা টাইম বোমা নিষ্ক্রিয় করার মতো। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ে শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করতে হবে। এবার, অনেক ব্যাকটেরিয়ার শরীরেই একধরনের অভিযোজনকারী ডিএনএ (জিন-এর মুখ্য উপাদান, বংশগতির মূল বাহক) থাকে, যার নাম CRISPR। যে খুব অল্প সময়েই আক্রমণকারী ভাইরাসের ডিএনএ-কে চিনে ফেলে তাকে নষ্ট করে দেয়। অন্যদিকে Cas9 হল ওই CRISPR সিস্টেমের অন্তর্গত একধরনের প্রোটিন (যে এখানে কাঁচির কাজটি করে), যা ওই ভাইরাস ডিএনএ-কে খুঁজে বের করে তাকে বিনষ্ট করে এক বিশেষ উপায়ে। কিছু বিশেষ ব্যাকটেরিয়ার এই যে প্রকৃতিজাত স্ব-প্রতিরোধক ক্ষমতা, তাই-ই আজকের Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats বা CRISPR-এর মূল অনুপ্রেরণা। মাইক্রসফট ওয়ার্ডে কোনও বাক্য লেখার সময় মাঝের কোন শব্দ ভুল হয়ে গেলে যেমন ভাবে তা বাদ দিয়ে বা কখনও অন্য শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়, CRISPR-Cas9ও ঠিক সেভাবে বিকৃত ডিএনএ-কে সারাতে পারে। কিন্তু এ তো গেল তত্ত্বকথা। এর বাস্তবিক প্রয়োগ কোথায়?

ইতিমধ্যেই, ইঁদুর ও বানরের ডিএনএ-র পরিবর্তন ঘটাতে এই প্রযুক্তির প্রয়োগ করা হয়েছে। এই পদ্ধতি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা মানুষের ভ্রূণের ডিএনএ-র পরিবর্তনও ঘটাতে পারে। অর্থাৎ, কোনও ভ্রূণ যদি বিকৃত বা ত্রুটিপূর্ণ ডিএনএ বহন করে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে তার সংশোধন করা সম্ভব। মানুষের দেহ থেকে এইচআইভি-র ডিএনএ নির্মূল করতেও এটি কাজে লাগে। জিনের গোলমালের জন্যে যে সব রোগ হয়ে থাকে, যেমন- সিকল সেল অ্যানিমিয়া বা প্রজেরিয়া বা মাস্কুলার ডিসট্রফি বা Tay-Sachs Disease... সেই সব রোগও এই প্রযুক্তির দ্বারা নিরাময় করা সম্ভব। যেহেতু, CRISPR-Cas9 একদমই সরাসরি ডিএনএ-র ওপর কার্যকরী, ডিএনএ মিউটেশনের ফলে ঘটে যাওয়া এই বিশ্বের অন্যতম মারণ রোগ ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও এর প্রভাব যে অভূতপূর্ব হবে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই প্রযুক্তি দিয়ে ফুসফুসের ক্যান্সার নিরাময়ের জন্যে গবেষণাও শুরু হয়ে গিয়েছে।

ফিরে আসা যাক গল্পে। ডঃ অ্যান্টনি যখন ভাবছেন যে, ম্যালেরিয়া তাড়ানোর দ্বিতীয় কাজটা অর্থাৎ সারা বিশ্বের কোটি কোটি অ্যানোফিলিস মশাকে কী করে ম্যালেরিয়া-প্রতিরোধী করে তুলবেন, তখনই আশার আলো দেখালেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেক অধ্যাপক ডঃ বায়ার। তিনি জানালেন যে, তিনি আর তাঁর গবেষক ছাত্র ভ্যালেন্টিনো মিলে এই CRISPR-Cas9-কে আরেক ধাপ আগে নিয়ে গিয়েছেন, যেখানে এই ম্যালেরিয়া-প্রতিরোধক ক্ষমতা কেবলমাত্র একটি অ্যানোফিলিস মশার মধ্যেই আটকে থাকবে না, বরং বংশপরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মেও সঞ্চারিত হবে। অতি দ্রুত। এই প্রক্রিয়ার নাম তাঁরা দিয়েছেন, 'জিন ড্রাইভ'। যেখানে একটি মশার শরীরের CRISPR কপি এবং পেস্ট হয়ে যাচ্ছে তার পরের প্রজন্মে। একটু খেয়াল করলে বুঝবেন যে, এমনটা যদি করা যায়, এই প্রযুক্তি একটা গোটা প্রজাতিকে বদলে দিতে পারে! তাই এই ঘটনা পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের চাইতে কম কিছু না! আমরা এর ভালো দিকটুকুই উদযাপন করব মানবকল্যাণের স্বার্থে। আশা কেবল এটুকুই...

তথ্যসূত্রঃ

  • Scientific Background on the Nobel Prize in Chemistry 2020ঃ A TOOL FOR GENOME EDITING.
  • James, A. A. and co-workers Transgenic Anopheles stephensi coexpressing single-chain antibodies resist Plasmodium falciparum development. PNAS, 2012, DOI: 10.1073/pnas.1207738109.
  • Gantz, V. M. and Bier, E. The mutagenic chain reaction: A method for converting heterozygous to homozygous mutations. 2015. DOI: 10.1126/science.aaa5945
  • How CRISPR lets us edit our DNA by Jennifer Doudna [ https://youtu.be/TdBAHexVYzc]

More Articles