আফগানিস্তানের ইতিহাসের এক অন্য দিক

মহম্মদ আশরাফ গনিকে সরিয়ে বেশ কয়েক দশক পরে আবারো আফগানিস্তানের মসিহা বর্তমানে তালিবান। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই রাষ্ট্রের সবকিছুই এখন মুসলিম আধিপত্য বেষ্টিত। কিন্তু এরকমটা সব সময় ছিল না। তালিবান শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে আফগানিস্তানের হিন্দু এবং শিখেরা তাদের ভিটেমাটি ত্যাগ করতে বাধ্য হলেও একটা সময় ছিল যখন আফগানিস্তানে হিন্দুধর্ম বিরাজ করত। ১৯৭০ এর দশক নাগাদ আফগানিস্তানে ৭ লক্ষেরও বেশি শিখ এবং হিন্দু নাগরিকের বসবাস ছিল, যা বর্তমানে হয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র হাতে গোনা। কিন্তু কীভাবে মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই হিন্দু সভ্যতা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল আফগানিস্তান থেকে?

অখন্ড ভারতের একটা অন্যতম অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল আফগানিস্তান। বর্তমান ইসলামিক রাষ্ট্র আফগানিস্তান একটা সময় ছিল হিন্দু ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের ধ্বজাধারী অন্যতম একটি দেশ। সপ্তম শতাব্দীতে পারস্য উপনিবেশকে সমূলে উৎপাটিত করে বর্তমান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসেন রাশিদুন খেলাফতের আরবীয়রা। সেখান থেকেই আফগানিস্তানে হিন্দু ধর্মের বীজ রোপিত হয়। এই আফগানিস্তান নামটির পিছনে রয়েছে একটা হিন্দু ইতিহাস। এই আফগানিস্তান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ' উপ-গণ-স্থান ' থেকে যার সরাসরি বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়, ' এমন একটি জায়গা যেখানে বহু প্রজাতি একসাথে বসবাস করে।'

শুধু তাই নয়, মহাভারতেও বর্তমান আফগানিস্তানের কিছু বিশেষ জায়গার উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতের অন্যতম চরিত্র গান্ধারীর জন্মস্থান অর্থাৎ গান্দাহার অঞ্চলটি কিন্তু আদতে আফগানিস্তানের অংশ। তবে বর্তমানে স্থানটির নাম পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে কান্দাহার। এই এলাকাটিও এখন তালিবানের কবলেই রয়েছে। উপরন্তু, পাখতুন বা পাশতুন সম্প্রদায়টিও বৈদিক সাহিত্যে উল্লেখিত পাকথা উপজাতির বংশধর। সিন্ধের রাজা দাহির সেন বেশ কয়েক বছর আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অংশে রাজত্ব করেছিলেন। সিন্ধের শেষ হিন্দু সম্রাট ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পরেই ওই সাম্রাজ্য দখল করে নেন মহম্মদ বিন কাসিম।

আফগানিস্তানে হিন্দু ধর্মের সব থেকে ভালো সময়টা ছিল ৮৫০ থেকে ১০২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়ে আফগানিস্তানের সিংহাসনে ছিলেন হিন্দু শাহিরা। ওই সময়ে আফগানিস্তানে প্রবলভাবে প্রচার শুরু হয়েছিল হিন্দু ধর্মের। আফগানিস্তানের হিন্দু শাহিরা আদতে ছিল ক্ষত্রিয়।  তাঁদের সাম্রাজ্যর স্থাপন করেছিলেন একজন ব্রাহ্মণ, যাঁর নাম ছিল কল্লার। আফগানিস্তান প্রথম থেকেই হিন্দু ধর্মের একটা অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে গণ্য হতো। সে যুগের আর্য সভ্যতার অনেক জাতি উপজাতি হিন্দু ধর্মের প্রচারক ছিলেন। চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীতেও আফগানিস্তানে হিন্দু ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ছিল, তবে সেটা এতটা বিপুলভাবে ছিল না। ওই শতাব্দীতে আফগানিস্তানে একাধিক শিবের মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। পশ্চিম এবং মধ্য এশিয়ার বেশ কিছু জায়গায় হিন্দু ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্ম ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল।

শুধুমাত্র আফগানিস্তান নয়, উজবেকিস্তান এবং কাজাকাস্তানেও হিন্দু ধর্মের প্রভাব ছিল বলেই ইতিহাসে বর্ণিত। চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীতে কুষাণ এবং কিদারা সভ্যতার সময়কালে আফগানিস্তান সহ মধ্য এশিয়ায় হিন্দু ধর্মের বিকাশ হয়েছিল চরমভাবে। কিন্তু, কিদারা সাম্রাজ্যের পতনের পর আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে হুনেরা। এই হুন জনগোষ্ঠী সাধারণত মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য বিখ্যাত ছিল। আবার অনেকের মতে, ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে নাকি কিদারা সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় চলে এসেছিল হুন সাম্রাজ্য। আজকের যুগের কান্দাহার অর্থাৎ এককালীন গান্দাহারের রাজা ছিলেন হিন্দু রাজা কিংঘিলা। হুন সাম্রাজ্যের সবথেকে উল্লেখযোগ্য নেতা হিসাবেই তাকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

পঞ্চম শতাব্দীর শেষ দিকে হুন সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করে আজকের ভারতবর্ষের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। তাদের অধীনে চলে যায় সিন্ধ, এবং সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চল। হুণেরা হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাই তাদের আমলেও এই দুটি ধর্মের প্রচার হয়েছিল বিপুলভাবে। তারা হিন্দু দেব-দেবীদের এতটাই বিশ্বাস করতেন যে, রাজা কিংঘিলার চালু করা মুদ্রায় ভগবান শিবের ছবি খোদাই করা ছিল। ৮৪৩ সালে হুন সভ্যতার পতনের পর, ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ মন্ত্রী। সেই সময় আফগানিস্তান সহ বিস্তীর্ণ এলাকার ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় ব্রাহ্মণদের কালকা সম্প্রদায়ের হাতে। পরবর্তীতে, এই কালকা সম্প্রদায় কল্লার হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করে।

এই কল্লার সভ্যতার পরেই সেই সভ্যতার শেষ ব্রাহ্মণ মন্ত্রী আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকায় হিন্দু শাহি সাম্রাজ্যের বীজ বপন করে দেন। ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করতে শুরু করে হিন্দু শাহি সাম্রাজ্য। তাদের শাসনকালে আফগানিস্তান এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হিন্দু সভ্যতা একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল। আফগানিস্তানে হিন্দু সভ্যতার বিস্তারের পিছনের সব থেকে বড় কৃতিত্ব ছিল হিন্দু শাহি রাজাদের। ভাক্কাদেবা, জয়াপালাদেবা, ভীমাদেবা, আনন্দপালা, সহ একাধিক হিন্দু শাহি রাজারা আফগানিস্তানে হিন্দু সভ্যতার বিস্তারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে শাহি সভ্যতার সম্রাট কমলাবর্মনের সময় থেকেই কাজাকাস্তান, উজবেকিস্তান, সমরখন্দ সহ আফগানিস্তান লাগোয়া একাধিক অঞ্চলে সামানীয় সভ্যতার বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। সামানীয় সভ্যতাটি ছিল আদতে একটি সুন্নি সভ্যতা। অষ্টম শতাব্দীতে সামান খুদা এই সভ্যতাটিকে স্থাপন করেন। কাজাকস্তান, উজবেকিস্তানের কিছু অঞ্চলে নিজের রাজত্ব কায়েম করার পরেই উত্তর আফগানিস্তানের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে সুন্নি মুসলিমরা। পারস্য সভ্যতার একটি অংশ হওয়ার কারণে ওই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে তাদের পক্ষে খুব সহজ ছিল।

পারস্য সভ্যতার কিছু অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও হিন্দু শাহি রাজাদের কাছে তারা ক্রমাগত পরাজিত হতে থাকেন। শাহি সাম্রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে গজনীতেও হিন্দু সভ্যতার প্রভাব শুরু হয়। গাজিদের জায়গায় হিন্দুদের আধিপত্য স্থাপন করে সুন্নিদের কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন কমলাবরণ। প্রায় ১ শতাব্দি পর্যন্ত আফগানিস্তানে হিন্দু সভ্যতার একনিষ্ঠ সংরক্ষক ছিলেন হিন্দু শাহি রাজারা। সামানীয় মুসলিম সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করলে মাঠে নামে তুর্কমেনিস্তানের মুসলিম সাম্রাজ্য। হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণ দিকের বেশকিছু জায়গাতে মুসলিম প্রভাব বিস্তার শুরু হয়ে যায় প্রবলভাবে। অন্যদিকে, শাহি সাম্রাজ্যের রাজা ভীমাদেবার কোনো পুরুষ বংশধর ছিল না। এই কারণেই, ভীমাদেবার সময়কাল থেকেই শাহি সাম্রাজ্যের পতনের সূত্রপাত হয়।

শাহি সাম্রাজ্য বড় এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাশীল হলেও, এই সাম্রাজ্যের কোন সঠিক বংশধর ছিল না। এই কারণেই কার্যত বাধ্য হয়ে পাঞ্জাবের সঙ্গে আফগানিস্তানের এই শাহি সাম্রাজ্যের চুক্তি করতে বাধ্য হন ভীমাদেবা। তারপরে ধীরে ধীরে আফগানিস্তানের শাহি সাম্রাজ্যের প্রভাব কমতে শুরু করে। ভীমাদেবার মৃত্যুর পর শাহী সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন রাজা জয়পালদেবা। তিনি শাহি সাম্রাজ্যের আদতে না হলেও তিনি নিজের নামের পাশে দেবা শব্দটি ব্যবহার করতেন। আদতে তিনি ছিলেন পাল বংশের রাজা। তার সময়কালেও হিন্দু শাহি সাম্রাজ্য আরও কিছুটা শক্তিশালী হয়। তুর্কমেনিস্তানের মুসলিম সম্রাটদের প্রতি তিনি কড়া মনোভাব পোষণ করতেন।

দশম শতাব্দী পর্যন্ত হিন্দু শাহি সাম্রাজ্য আফগানিস্তানে টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যেক সাম্রাজ্যের মতই, এই সাম্রাজ্যের পতনও লেখা হয়ে গিয়েছিল জয়পালদেবার আমল থেকেই। সময়ের সঙ্গে এই সাম্রাজ্যের প্রভাব-প্রতিপত্তি কমতে শুরু করে। গজনীর মেহমুদ এই সুযোগে আফগানিস্তানের একাধিক জায়গা দখল করতে শুরু করেন। হিন্দু শাহি এবং গুর্জর সভ্যতার পতন ঘটিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে এসে পৌঁছন মেহমুদ। ১০০১ সালের ২৮ নভেম্বর রাজা জয়পালদেবাকে পেশোয়ারের যুদ্ধে পরাজিত করে আফগানিস্তানের শাহি সাম্রাজ্যের একটা বিশাল অংশের দখল নেন মেহমুদ। জয়পাল আত্মহত্যা করেন এবং শাহি সাম্রাজ্যের বাকি অংশের সিংহাসনে অধিষ্ঠান করেন তাঁর পুত্র আনন্দপাল। কিন্তু তারপরে খুব একটা বেশি দিন শাহি সাম্রাজ্য টিকে থাকতে পারেনি।

এরপর থেকেই আফগানিস্তান এবং লাগোয়া বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিজয়রথ ছুটতে শুরু করে। তুর্কমেনিস্তান এবং আরবের মুসলিম শাসকদের পরাজিত করে ২০০ বছর আফগানিস্তানে রাজত্ব করেছিলেন হিন্দু রাজারা। সেই সময়  আফগানিস্তানে হিন্দু ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল। আফগানিস্তানের সবথেকে পুরনো ধর্ম হিসেবে পরিচিত এই হিন্দুধর্ম। সনাতন হিন্দুধর্মের বহু নিদর্শন এখনও আফগানিস্তানে বর্তমান।

তথ্যসূত্রঃ 

https://www.aljazeera.com/amp/features/2017/1/1/the-decline-of-afghanistans-hindu-and-sikh-communities

https://www.speakingtree.in/allslides/the-hindu-history-of-afghanistan

More Articles