কোম্পানির আমলে দুর্গাপুজো

দেবীপক্ষের সূচনা ঘটেছে ইতিমধ্যেই। হিমালয় থেকে তল্পিতল্পা নিয়ে  মা দুর্গা এখন বাপের বাড়িতে স্বমহিমায় বিরাজমান। পুজোর মণ্ডপগুলোতে ইতিমধ্যেই ভিড় জমিয়েছে অসংখ্য দর্শনার্থী, চারিদিক আজ আনন্দে মুখরিত। গোটা বাংলা জুড়ে এখন উৎসবের মরশুম। 

বাংলায় একদম আদিকাল থেকে যে দুর্গাপুজোর চল ছিল, তেমনটা কিন্তু নয়। শোনা যায়, ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে দিনাজপুর অথবা মালদার জমিদারেরা বাংলায় দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। কিন্তু এও শোনা যায় যে আকবারের আমল থেকেই নাকি বাংলায় খুব ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হত। আবার অনেকের মতে, জমিদার ভবানান্দ মজুমদার নাকি ১৬০৬ সালে বাংলায় প্রথম এই পুজোর প্রচলন ঘটান। তবে সেকালের দুর্গাপুজো যে মাতৃ প্রতিমাকেন্দ্রিক ছিল, তেমনটা নয়। কোথাও পুজো মানে ছিল সামান্য ঘট পুজো আবার কোথাও সেই শালগ্রাম শিলা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে  কোম্পানির হাত ধরেই বাংলার দুর্গপুজো পরিণত হত দুর্গোৎসবে। তখনও বাংলায় দশের আইন চালু হয়নি অর্থাৎ, তখনও পাকাপাকিভাবে এ দেশীয়রা ইংরেজদের ঠিক প্রজা হয়ে ওঠেনি। ১৭৯২ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে ‘ ক্যালকাটা ক্রনিকল’ পত্রিকায় দুর্গোৎসবের প্রসঙ্গে কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম উঠে আসে। তার মধ্যে ছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ, প্রাণকৃষ্ণ সিংহ, নারায়ণ মিত্র, রামহরি  ঠাকুর, দর্পনারায়ণ ঠাকুর প্রমুখ ব্যক্তিরা। তৎকালীন সময়ে দুর্গাপুজোর মূল উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির সঙ্গে জড়িত মানুষগুলিকে খুশি করে নিজেদের ব্যবসার উন্নতি সাধন করা। এইসব পুজোমাত্রেই ছিল কোম্পানির পুজো।

তবে সেই সময় যে কেবল বাঙালিরাই দুর্গাপুজো করতেন, তা নয়। কোম্পানির এক কর্মচারী দুর্গাপুজা করতেন নিজের টাকায়। তাঁর নাম জন চিপস, বীরভূমের জনপ্রিয় ‘চিকবাহাদুর’। ১৭৮২ সালে রাইটার হিসাবে তিনি বাংলায় পা রাখেন এবং কয়েকবছর পরেই শোনা যায় তিনি কোম্পানির অডিটার জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি নিযুক্ত হন বীরভূমের কমার্শিয়াল এজেন্ট হিসাবে। তখন সেখানে কোম্পানির তুলা, রেশম, রঙ, লাক্ষা ইত্যাদির জমজমাট ব্যাপার, চিপস এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি। ক্রমে তিনিও নিজের ব্যবসা শুরু করেন কিন্তু বিশেষ লাভ করতে পারেন না। তখন তাঁকে শ্যামকিশোর পরামর্শ দেন, দেবী দুর্গার আরাধনা করার। কোম্পানির কুঠিতেই ধুমধাম করে শুরু হয় দুর্গাপুজো, পরে নাকি ব্যবসার বিশেষ উন্নতি হতে শুরু করে। তবে তাঁর পুজো আর কলকাতার পুজোর মধ্যে ছিল বিশাল ফারাক। চিপসের পুজোয় সর্বসাকুল্যে খরচ হত ৫০ টাকা। তারমধ্যে আবার পুজোয় খরচ মোটে সতেরো টাকা, বাকি টাকায় তিনি গ্রামের লোকদের নতুন কাপড় দান করতেন।

এবার আসা যাক, খাস কলকাতার পুজোর কথায়। তবে কলকাতার পুজোর উঠতি এবং পড়তি দুটোই খুব প্রকটভাবে দৃশ্যমান।  ১৮১৯ সালের ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ থেকে পুজোর বিবরণ সম্পর্কে জানা যায় –

… may indulge in an anticipation of the highest gratification from arrangements which this gentlemen have respectively made, to render their mansions the scene of jocund festivity and veried amusements…’’  

জমিদার বাড়িগুলিকে এভাবে সাজানোর মূল কারণ ছিল সাহেবদের নজরে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা। যে ঘরগুলিতে ইউরোপিয়ানদের থাকার ব্যবস্থা করা হত, তা ছিল প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে পরিপাটি করে সাজানো। কাশ্মীর ছাড়িয়ে ব্রহ্মদেশ থেকে আনা হত সুন্দরী ও সুগায়িকা নর্তকীদের, সাথে বিপুল খানাপিনা তো থাকতোই। দুর্গাপুজোয় আরও একটি বিষয় পালিত হত। বছরের এই সময় ঋণের দায়ে আটক বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হত। সেকালে এককালে ঋণ মিটিয়ে দিলেই তাদের মুক্তি দিয়ে দেওয়া হত। অনেক বাবুরা তো আবার নিজেদের সাধ্যমতো বন্দীদের মুক্তি দিতেন, ছাড় পেত বিশেষ করে ইংরেজ বন্দীরা। শোনা যায় ঠিক পুজোর আগে আগেই কোর্টে ভিড় লেগে যেত অধমর্ণদের। কিন্তু এই রমরমা বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারল না কলকাতা। ১৮২৮ সালে কলকাতার পুজো পড়তে শুরু করে, ১৮৩২ সালে একেবারে তা তলানিতেও এসে ঠেকে। সমাচার চন্দ্রিকার মত পত্রিকা লিখলো,

‘ শ্রীশ্রীপূজার সময় যে প্রকার ঘটা কলিকাতায় হইত এক্ষণে তাহার ন্যূন হইয়াছে, কেননা গোপীমোহন ঠাকুর ও মহারজা সুখময় রায় বাহাদুর ও বাবু নিমাইচরণ মল্লিক প্রভৃতির বাটীর সম্মুখে রাস্তায় প্রায় পূজার তিন রাত্রিতে পদব্রজে লোকের গমনা গমন ভার ছিল যেহেতুক ইঙ্গরেজ প্রভৃতির শকটাদির ও যানবাহনের বহুল বাহুল্যে পথ রোধ হইত।’  

আগে যেসব বাড়িতে সাধারণ মানুষের ছাড়পত্র ছিল না সেইসব বাড়ির পুজোর দরজা ক্রমে সাধারণ মানুষের জন্য খুলে গেল। এই বিষয়ে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ জানালো,

‘ ...(এবার) সেই সকল বাড়ীতে ইতর লোকের স্ত্রীলোকেরাও স্বচ্ছন্দে প্রতিমার সম্মুখে দণ্ডায়মানা হইয়া দেখিতে পায় এবং বাইজীরা গলি গলি বেড়াইতেছেন তত্রাপি কেহ জিজ্ঞেসা করে নাই... এবং যাহাদের বাড়ীতে পাঁচ সাত তরফা বাই থাকিত এ বৎসর সেই বাড়ীতে বৈঠকিগানের তালেই মান রহিয়াছে...’  

এভাবেই কলকাতার পুজো হয়ে উঠলো সাধারণ জনগণের পুজো। তবে বাবুদের এই সাহেবদের তৃপ্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৮২০ সালে ডিরজিওর শিষ্যরা ঘোর বিরোধিতা করতে শুরু করেন। ফলে পুজোকে কেন্দ্র করে এক রাজনৈতিক লড়াইয়ের সূচনা হয় এবং খুব অল্প পরিমাণেও হলে রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিরোধীতা হতে দেখা যায় ইয়ং বেঙ্গলের হাত ধরেই। তবে কলকাতার পুজোয় সাহেবদের বাড়বাড়ন্ত বন্ধ হবার অন্যতম কারণ হিসাবে দেখা দেয় ধর্মীয় মতভেদ। গো-মাংস ভক্ষণকারী সাহেবদের পুজোয় এরূপ অবস্থান অনেকেই মেনে নিতে পারেননি, পরে অবশ্য দশের আইন আসায় নেটিভরা পরিণত হয় শোষিত প্রজায় এবং রাজার ধর্মের সাথে প্রজার ধর্মের এই মিলন এক বৃহত্তর বিভেদে পরিণত হয়। 

কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার এই দুর্গাপুজোকে ঢাল বানিয়ে বিল্পবীদের কার্যকলাপ অব্যহত রাখা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে মেদিনীপুরের একটি দুর্গাপুজোর সূচনা হয় এই কারণেই। তিরিশের দশকে যখন গোটা দেশের নানাস্থানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, ছাতার মত গজিয়ে উঠছে একাধিক বিপ্নবী সংগঠন, সেই সময় মেদিনীপুরের পর পর তিন বছর বিপ্লবীদের হতে প্রাণ হারান তিন অত্যাচারী ইংরেজ জেলাশাসক। তৃতীয়বারের হামলার পর ইংরেজদের অবস্থা থরহরি কম্পমানের মত। কোন ইংরেজই আর এই অঞ্চলের দায়িত্ব নিয়ে চাইছিলেন না, সেই সময় মেদিনীপুরে পাঠানো হয় অবসরপ্রাপ্ত অতি অত্যাচারী আধিকারিক পিজি গ্রিফিতকে। তিনি এসেই গোটা শহরকে এক কারাগারে পরিণত করেন এবং সন্ধ্যার পর রাস্তায় বেড়ানোর উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তাই বিপ্লবীরা তাঁদের কর্মকাণ্ড অব্যহত রাখার ফন্দি হিসাবে এক নতুন পরিকল্পনা নেন। এই দুর্গাপুজোকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা নেন ব্যারিস্টার বীরেন শাসমল, রাজা দেবেন্দ্র লাল খান, সাতকড়ি পতিয়ার, অতুল বসু প্রমুখ দেশপ্রেমিকরা। এভাবেই ৮৭ বছর আগে গ্রিফিতের চোখ এড়িয়ে মেদিনীপুরে চালু হয় বাঙালির প্রাণের উৎসব। এই পুজো আজও আদি সর্বজনীন পুজোরূপে খ্যাত। এই ছিল সেদিনকার দুর্গাপুজো।   

তথ্যসূত্রঃ

১. https://www.sangbadpratidin.in/pujo/pujo2018/this-durga-puja-in-midbapore-linked-to-freedom-movement/

২.https://m.dailyhunt.in/news/india/bangla/prothom+kolkata-epaper-protomk/durgapujo+itihaser+hat+dhare+pichiye+yaoya-newsid-134446534?listname=topicsList&index=0&topicIndex=0&mode=pwa

৩. https://bengali.news18.com/news/kolkata/durga-puja-during-british-period-372189.html

৪. শ্রীপান্থ রচিত ‘কলকাতা’

More Articles