মুখে ‘বেঙ্গল ফার্স্ট’, মমতায় আস্থা, এবার কি তৃণমূলে ‘ঘর ওয়াপসি’ অর্জুনের?

বিধানসভা থেকে পুরসভা নির্বাচন, ধারাবাহিক ব্যর্থতা রয়েইছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘরোয়া কলহ। তার মধ্যেই বঙ্গ বিজেপি-তে (BJP) এবার বিদ্রোহের সুর বাঁধলেন ‘বাহুবলী’ অর্জুন সিং (Arjun Singh)। বিতর্কিত কৃষি আইনের মধ্যে কিছু গলদ না পেলেও, বাংলার পাটচাষি এবং চটকল কর্মীদের দুর্দশা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারলেন না তিনি। তাই বিজেপি-তে থেকেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে পথে নামার হুঁশিয়ারি দিয়ে বসলেন। আর তাতেই অশনি সংকেত দেখছেন রাজ্য বিজেপি-র নেতা-কর্মীরা। কারণ প্রকাশ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেই শুধু ক্ষান্ত হননি অর্জুন, বরং সরাসরি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী (TMC) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Mamata Banerjee) পাশে চেয়েছেন তিনি, যা তৃণমূলে তাঁর ‘ঘর ওয়াপসি’-র ইঙ্গিত বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।

একদিন আগেও অর্জুনের টুইটার হ্যান্ডল থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবি এবং ভিডিও পোস্ট হতে দেখা গিয়েছে। টুইটার প্রোফাইলে এখনও লেখা রয়েছে তিনি রাজ্য বিজেপি-র সহ সভাপতি। প্রোফাইল পিকচারেও বিজেপি পরিবারের সদস্য বলে উল্লেখ রয়েছে নিজের। তাই অর্জুন বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারেন বা নিজের দলের সরকারের বিরুদ্ধে পথে নামতে পারেন, আগে থেকে তা আঁচও করতে পারেননি কেউ। বরং রাজ্য বিজেপি-র প্রাক্তন এবং বর্তমান সভাপতির মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়েই বিচার-বিশ্লেষণে মগ্ন ছিলেন সকলে। সেই পরিস্থিতিতে সোমবার কার্যত বিস্ফোরণ ঘটান অর্জুন। কোনওরকম রাখঢাক না করেই জানিয়ে দেন, বাংলার পাটচাষি এবং চটকল কর্মীদের নিয়ে উদাসীন কেন্দ্র। বারবার সেই নিয়ে তদবির করেও লাভ হয়নি। তাই পথে নামা ছাড়া কোনও উপায় দেখছেন না তিনি।

অর্জুনের সাফ বক্তব্য, মানুষের জন্যই নেতা হতে পেরেছেন তিনি। সেই মানুষই যদি পাশে না থাকে, কোনও দল বা আদর্শের পরোয়া করেন না তিনি। বিজেপি চাইলে তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের পদক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু কোনওরকম অন্যায় সইবেন না তিনি। তার জন্য নিজের দলকেও ছেড়ে কথা বলবেন না। এখানেও থেমে গেলে পারতেন হয়ত অর্জুন। তা না করে, আরও এক কদম এগিয়ে জানিয়ে দেন, কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা না নিলে পথে নেমে আন্দোলন করবেন তিনি। এব্যাপারে মমতার হস্তক্ষেপও চাইবেন, যাতে সকলে মিলে কেন্দ্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়। অর্জুনের এই মন্তব্যই তৃণমূলে তাঁর ‘ঘর ওয়াপসি’-র সম্ভাবনা জোরালো করে তুলেছে। জল্পনা ওড়ানোর বদলে অর্জুন নিজেও তাতে ইন্ধন জুগিয়েছেন। জানিয়েছেন, এখনই কিছু বলবেন না তিনি। ধাপে ধাপে এগোবেন।

আরও পড়ুন: প্রশান্ত কিশোর: ‘ছেড়ে রেখেই ধরে রাখা’-র সিদ্ধান্ত তৃণমূলের?

রাজনীতিতে যোগদানের আগে চটকলে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে অর্জুনের। তার জন্যই পাটচাষি এবং চটকল শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা অনুভব করতে পারছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তাঁর দাবি, কেন্দ্রীয় সরকার কাঁচা পাটের দামের সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেওয়াতেই ধুঁকছে পাটচাষ এবং চটকলগুলি। ১৪টি জুটমিল বন্ধ হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। আরও ১০টি বন্ধ হওয়ার পথে। তাতে পাটশিল্পের সঙ্গে যুক্ত আড়াই কোটি মানুষ এবং ৪০ লক্ষ কৃষক সংকটে পড়েছেন। একথা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন তিনি। বস্ত্রমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের কাছেও স্মারকলিপি জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি। বরং বস্ত্রমন্ত্রী জানিয়ে দেন, পাটের বদলে কেন্দ্র প্লাস্টিক কিনে নেবে। তাই পাটচাষি এবং চটকল কর্মীদের জন্য পথে নামা ছাড়া আর উপায় নেই তাঁর কাছে।

কিন্তু আচমকা পাটচাষি এবং চটকল কর্মীদের জন্য অর্জুনের দরদ উথলে উঠল, সেকথা মানতে নারাজ রাজনৈতিক মহল। এর নেপথ্যে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে কড়া বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি, তিক্ততা ভুলে মমতাকেও অর্জুন শান্তির বার্তা দিতে চেয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকেই। তাঁদের মতে, পাটচাষি বা চটকলকর্মীদের দুর্দশা নয়, অর্জুন আসলে নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন। কারণ তৃণমূলের কাছ থেকে টিকিট না পেয়ে ২০১৯ সালে বিজেপি-তে গিয়েছিলেন। সেই সময় রাজ্যব্যাপী গেরুয়া হাওয়ার দাপটে ভর করে ব্যারাকপুরের সাংসদও হয়ে যান তিনি। কিন্তু ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে লাগাতার বিজেপি-র সাফল্যের গ্রাফ যেভাবে নীচে গিয়েছে, তাতে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে নিজেকে নিরাপদ জায়গায় রাখতে চাইছেন তিনি। তার জন্য তৃণমূলই যে একমাত্র আশ্রয়, তা জেনেই হিসেব কষে এগোচ্ছেন।

কিন্তু অর্জুন চাইলেও, তৃণমূল কি তাঁকে দলে ফেরত নেবে? কারণ অতীতে ‘মমতা বাংলাকে পাকিস্তান বানাতে চাইছেন’, ‘তৃণমূল আসলে পিসি-ভাইপো প্রাইভেট লিমিটেড’, ‘মা-মাটি-মানুষ, নয় তৃণমূলের আসল স্লোগান মানি-মানি-মানি’, এমন হাজারও মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। তার ওপর জানুয়ারি মাসে ইছাপুরে তৃণমূল নেতা গোপাল মজুমদারের খুন হওয়ার ঘটনায়ও অর্জুনের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হচ্ছিল তৃণমূলের তরফেই। বাড়ি ফেরার পথে রাতের অন্ধকারে প্রথমে গুলি চালিয়ে এবং পরে কুপিয়ে খুন করা হয় গোপালকে। সেই ঘটনায় বিজয় মুখোপাধ্যায় নামের একজনকে আটক করে পুলিশ। বিজয় অর্জুন-ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত এলাকায়। তার জন্য মহাত্মা গান্ধী স্মরণ অনুষ্ঠানে অর্জুনের সঙ্গে এক মঞ্চে পর্যন্ত থাকতে রাজি হননি রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। প্রকাশ্যেই জানিয়ে দেন, একজন ‘খুনি’-র সঙ্গে কিছুতেই মঞ্চ ভাগ করবেন না বলে।

কিন্তু এসবের পরেও, অর্জুনের তৃণমূলে ‘ঘর ওয়াপসি’-র সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, বিজেপি-তে গিয়ে মমতা-অভিষেককে কুকথা বলার পরেও ‘সসম্মানে’ তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে মুকুল রায়, সব্যসাচী দত্ত, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়দের। তৃণমূলের তরফে যদিও এই নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি, তবে কংগ্রেস ছেড়ে আসার পর ২০০১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তৃণমূলের বিধায়ক ছিলেন অর্জুন। ব্যারাকপুর আসন থেকে লোকসভার টিকিট পাওয়া নিয়ে বিরোধ বাঁধলে বিজেপি-তে যোগ দেন তিনি। সেই সময়ই অর্জুন জানিয়ে রেখেছিলেন, "রাজনীতিতে সম্মান বলে কিছু হয় না, রাজনীতি মানেই সমঝোতা।" তাই ২০২৪-এর কথা মাথায় রেখে তৃণমূল এবং অর্জুন নিজেদের স্বার্থেই পরস্পরের সঙ্গে সমঝোতা করলে, আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই বলে মনে করছেন অনেকেই।   

More Articles