এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিবলিঙ্গ রয়েছে এই বাংলাতেই

ইতিহাসে উপেক্ষিত, প্রচারের অন্তরালে থাকা এই সুবৃহৎ শিবলিঙ্গ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তথা পূর্ব ভারতের প্রথম স্থান অধিকার করে আছে।

ওঁ ত্রম্বকম্ যজামহে সুগন্ধিম্ পুষ্টি বর্ধনম্।

ঊর্বারু কমিব বন্ধনাৎ মৃত্যুমক্ষীয় মামৃতাৎ।।

বাংলার কাশী শিবনিবাস। কিংবদন্তি শোনা যায়, "শিবনিবাস তুল্য কাশী,ধন্য নদী কঙ্কনা।" ১৭৫৭ (মতান্তরে ১৭৫৪) খ্রিস্টাব্দে (১৬৭৬ শকাব্দ) মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজধানী মাজদিয়ার সুরক্ষার জন্য ইছামতি নদী ও চূর্ণী নদীকে একত্রে জুড়ে জনপদ দ্বারা বেষ্টিত করে দিয়েছিলেন। সেই খালটি বর্তমানে কঙ্কনা নদী নামে খ্যাত। এই নদীটি পেরিয়ে 'শিবনিবাস' মন্দিরে পৌঁছতে হয়। নদিয়া জেলার মাজদিয়া থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রয়েছে পূর্ব ভারতের সর্ববৃহৎ এবং এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিবলিঙ্গটি। প্রচারের আলোয় আসেনি কখনও এই মন্দির। সেই কারণে অজানা রয়ে গেছে।

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এই শিবলিঙ্গটি প্রতিষ্ঠা করেন।এর উচ্চতা ১১ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং বেড় ৩৬ ফুট। সিঁড়ি বেয়ে উঠে তবেই শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালা যায়। এই শিবলিঙ্গ অত্যন্ত জাগ্রত বলে বিশ্বাস করেন স্থানীয় লোকজন। ভীম একাদশীতে প্রতি বছর একটি সুবিশাল মেলা বসে। দূরদূরান্ত থেকে আসে বহু ভক্ত। মনোবাসনা নিয়ে পুজো দিতে আসেন। শিবরাত্রি পর্যন্ত চলে এই মেলা। প্রায় ২৬৫ বছরের পুরনো এই মন্দির। এই মেলার বৈশিষ্ট্য হলো 'খই'। এই মেলার বিশেষত্ব হলো সধবা এবং বিধবা, সব মহিলারাই ভগবান শ্রীরাম ও সীতার কাছে অর্ঘ্য নিবেদন করেন। সধবারা প্রার্থনা জানান, তাঁরা যাতে সধবাই হয়ে থাকেন এবং বিধবারা প্রার্থনা জানান আগামী জন্মে তাঁরা যেন বিধবা না হন। এই মেলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য 'খই'। বিভিন্ন জায়গা থেকে দোকানদারেরা 'খই' নিয়ে আসেন। খই দিয়ে ভীম একাদশীতে শিবের পূজা দেওয়া হয় এবং প্রসাদ হিসেবে সেই 'খই' বাড়িতেও নিয়ে যাওয়া হয়।

জটাটবী গলজ্জলপ্রবাহ পাবিতস্থলে।

গলেহ বলম্ব্যলম্বিতাং ভুজঙ্গতুঙ্গ মালিকাম্।।

আরও পড়ুন: ব্যাধ ও শবরদের প্রাচীন দেবী আজও হাজার হাজার ভক্তর আশ্রয়

জনশ্রুতি শোনা যায়, এই শিবলিঙ্গে পুজো দিয়ে প্রার্থনা জানালে শত্রু নিধন হয়, পরিবারের সুখসমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায় এবং শান্তি বজায় থাকে। স্থানীয় মানুষের মতে, মহাদেব দুই হাত দিয়ে রক্ষা করেন সমগ্র কৃষ্ণনগরকে। শ্রাবণ মাসের প্রতিদিন, বিশেষত সোমবার পূণ্যার্থীর ঢল নামে এই মন্দিরে।

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বর্গী দস্যু নুসরৎ খাঁ-র হাত থেকে নিজেকে, প্রজাদের এবং পরিবারকে বাঁচাবার জন্য কুলপুরোহিত রঘুনাথ মিশ্রর কাছে পরিত্রাণের উপায় জানতে চান। কুলপুরোহিত রঘুনাথ মিশ্র হোম-যজ্ঞ করে মহারাজাকে বলেন, শিবনিবাসে মহাদেবের লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করলে দস্যু নুসরৎ খাঁ আক্রমণ করতে পারবে না। কারণ দস্যু নুসরৎ খাঁ ছিলেন শিবের অন্ধ ভক্ত। এছাড়া শিবনিবাসে যদি রাজত্ব স্থাপন করা যায় তাহলে সেই রাজ্য হবে শৌর্য-বীর্যে পরিপূর্ণ। কুলপুরোহিত রঘুনাথ মিশ্রর কথা অনুযায়ী মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র শিবনিবাসে একটি সুবিশাল শিবলিঙ্গ স্থাপন করলেন এবং সপরিবারে সেখানেই বসবাস শুরু করলেন। শিবের সন্তুষ্টির জন্য মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নবদ্বীপ থেকে জল নিয়ে এসে শ্রাবণ মাসের প্রতিটি দিন শিবের পূজা করতেন এবং এখনো সেই প্রথা মেনে শ্রাবণ মাসের প্রতিটি সোমবার শিবের মাথায় জল ঢালে অগণিত ভক্ত। স্থানীয় মানুষ বলেন 'বুড়ো শিব'। পূর্বে এই শিবনিবাসে ১০৮ শিবের মন্দির ছিল। কালের গর্ভে সবই হারিয়ে গেছে। বর্তমানে সবই ধ্বংসের পথে,শুধু চিহ্ন রয়ে গেছে। একমাত্র তিনটি মন্দির এখনও অবশিষ্ট আছে। শিবনিবাসের মন্দিরটি দেখলে হঠাৎ করে মনে হবে একটি গির্জা। চূড়াসহ এই মন্দিরের উচ্চতা ১২০ ফুট। আটটি কোণবিশিষ্ট এই মন্দিরের প্রতিটি কোনায় মিনারের মতন সরু থাম রয়েছে। মন্দিরটি 'রাজরাজেশ্বর শিবমন্দির' নামে খ্যাত। এই মন্দিরের ডান দিকে আরেকটি মন্দির রয়েছে। ১৭৬২ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রর দ্বিতীয় রানি। তিনি তাঁর পুত্রের নামকরণও করেন 'শিবচন্দ্র'। মন্দিরটির নাম 'রাজ্ঞীশ্বর মন্দির'। এখানে লিঙ্গের উচ্চতা সাড়ে ৭ ফুট। ডানদিকে আছে আরও একটি মন্দির নাম 'রাম সীতা' মন্দির।

কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির প্রতিষ্ঠা করার সময় 'অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী যজ্ঞ' সম্পন্ন করেছিলেন (সেদিন থেকে মহারাজ 'অগ্নিহত্রী বাজপেয়ী' উপাধি পান) এবং কাশী থেকে ধর্মীয় পুরোহিত ও পণ্ডিতরা এসে এই মন্দির দর্শন করে আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, "এই মন্দির কাশীর সমতুল্য হবে।" সেই থেকে শিবনিবাস 'বাংলার কাশী' নামে খ্যাতি লাভ করে। শ্রীশ্রী শশীভূষণ বিদ্যালঙ্কার সংকলিত 'জীবনীকোষ'-এর (ভারতীয় ঐতিহাসিক) দ্বিতীয় খণ্ডে এর উল্লেখ আছে।

ইতিহাসে উপেক্ষিত, প্রচারের অন্তরালে থাকা এই সুবৃহৎ শিবলিঙ্গ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তথা পূর্ব ভারতের প্রথম স্থান অধিকার করে আছে।

More Articles