গানপিছু পঁচিশ হাজার দর হেঁকেছিলেন বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব

ভোররাতের সূর্যর শরীর থেকে মেঘের আলগা আস্তরণ সরে যাচ্ছে ধীরে। আফতাবের কাল। যুবরাজ সলিম চলেছে আনারকলির গরিবখানায়, প্রভাতি প্রণয়ের নেশায়। সোহিনী রাগে রেওয়াজে বসেছেন মিয়াঁ তানসেন। পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি মুড়ে আছে তার স্বরধ্বনির অলঙ্কার। এ প্রভাত বড়ই মনোমুগ্ধকর। কিন্তু রেওয়াজের এ গুঞ্জন আসে কোত্থেকে? কে গায়? দৃশ্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এ অবিস্মরণীয় গল্পকথাকে আমরা মনে রাখিনি।

১৯৬০ সাল। বড় পর্দায় মুক্তি পাচ্ছে কে আসিফ পরিচালিত ‘মুঘল এ আজম’। সঙ্গীত পরিচালক নৌশাদ।  বিধি মেনেই নেপথ্য গায়িকা হিসেবে নাম নির্বাচন করা হল লতা মঙ্গেশকারের, বলিউডে তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। এ ছাড়া পুরুষকণ্ঠে মহাম্মদ রফি, অন্যান্য শিল্পীর তালিকায় শমসাদ বেগম। কিন্তু সাময়িক জ্যোতিচিহ্ন পড়ল বিশেষ এক নামে এসে, তানসেন। কোন এমন মহার্ঘ কণ্ঠ হিন্দুস্থানে আছে যে নির্দ্বিধায় এ চরিত্রের লিপে গলা দেবেন? ধন্দে পড়লেন ছবির পরিচালক এবং সঙ্গীত পরিচালক। মহল্লা শাসন করছেন তখন ওস্তাদ আমির খাঁ, ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের মতো শিল্পীরা।  কাকে বলা যায়? এমতাবস্থায় নৌশাদ প্রস্তাব করলেন বড়ে গোলাম আলি খাঁর নাম। প্রস্তাব তো করলেন, কিন্তু তাঁকে রাজি করানো তো আর যে সে লোকের কম্ম নয়, তদুপরি ফিল্মে গান করেন না তিনি। মাথায় রাখতে হবে, এ যুগ গলবস্ত্র হওয়ার নয়, তৎকালীন রীতি ছিল আহুতির।

রেডিওর আগমনের পরেই বিধি তৈরি হল, অনুষ্ঠান পেতে গেলে ওস্তাদদের ঢুকতে হবে পরীক্ষা দিয়ে। তাবড় ওস্তাদদের পরীক্ষাগারের কলমপেষা পরীক্ষার্থী করবেন এমন আস্পর্ধা আর কারই বা আছে? এর ফলস্বরূপ একাংশের গাইয়ে বাজিয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিওর নিয়মাবলীতে পদাঘাত করে জানালেন বেতারের ধারপাশ কদাচ মারাবেন না তাঁরা। খাঁ সাহেব খাস সেই যুগের ফসল। ফলত, অর্থ বা অন্য কোনও প্রলোভনে তাঁকে প্রলুব্ধ করা এক দুরূহ ব্যাপার। তা যাই হোক, দুয়ে মিলে তাঁর গৃহাভিমুখে যাত্রা করলেন।

আদাব পরবর্তী কুশল বিনিময়ের পর নৌশাদ সরাসরি খাঁ সাহেবকে প্রস্তাব দিলেন, “ওস্তাদজী, আমরা একটা ছবি বানাচ্ছি, মুঘল এ আজম, সেখানে তানসেনের চরিত্রে আপনার গলাটা যদি একটু ব্যবহার করতে দেন বড় মেহেরবানি হয়। আপনি ছাড়া এ গান আর কেই বা গাইবে?” খাঁ সাহেব নারাজ। জলসা ছাড়া আর কোথাও গান না তিনি। মাঝখান থেকে কে আসিফ তুড়ি মেরে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “খাঁ সাহেব, গান আপনিই গাইবেন, কিমৎ যা লাগে দেব, কিন্তু না শুনব না।” সব্বনাশের মাথায় বাড়ি। সিংহের ডেরায় বসে সোজা হুকুমদারি? খাঁ সাহেব বিস্মিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে নৌশাদকে বললেন, “ইনি কে ভাই? কাকে এনেছেন সঙ্গে করে?”

এবার নৌশাদের বিনয়ে কাঁকুইদানা হওয়ার পালা। করজোড়ে তিনি জানালেন, “খাঁ সাহেব, আপনি রাজি না হলে আমার লোকসান। আপনাকে দিয়ে যদি ফিল্মে গাওয়াতে পারি তাহলে আমার ইজ্জত কোথায় উঠবে একবার ভেবে দেখুন। রেহমত করুন।” এরপর দীর্ঘ টালবাহানা। অবশেষে পাতিয়ালা ঘরানার কুলসূর্য জানালেন, “বেশ, গাইব আমি, কিন্তু গানপিছু পঁচিশ হাজার করে নেব।”

এ যুগের নিরিখে বিচার করলে কারুর মনে হতেই পারে, “এ আর এমন কী, বোম্বের মতো জায়গায় পঁচিশ হাজার তো নস্যির কণাটুকুও নয়।” কিন্তু সময়টা আজ থেকে অর্ধ শতাব্দীরও ওপারে। রথী মহারথীরাও সে যুগে সিনেমায় গলা ফেলতে পাঁচশো-হাজারের বেশি দর হাঁকাতেন না।

শেষে সেই কথাই রইল। আসিফ বিনাযুদ্ধে পঁচিশ হাজারে রফা করলেন খাঁ সাহেবের সঙ্গে, তেহজিবের সঙ্গে এও জানালেন, “আপনার কোনো মূল্য হয়না খাঁ সাহেব। আপনি ওসবের ঊর্দ্ধে। এই নিন দশ হাজার অ্যাডভান্স রাখুন।” এই দাঁড়াল কিসসা। বাকি ইতিহাস। রেকর্ডিংয়ের সময় পরিচালক নৌশাদকে বললেন, “খাঁ সাহেবকে বলবেন তানগুলো যেন একটু হালকা অঙ্গের নেন। প্রেমের দৃশ্য তো।” তানসেনের সুরবলয়ে সলিম আনারকলির সেই বিখ্যাত প্রেমের দৃশ্যের রেকর্ডিংও ঠিক হালের এলুম, খেলুম, পালালুম ফ্যাশনে হয়নি। গাওয়ার আগে, যে দৃশ্যের জন্য গলা দিচ্ছেন, সেটা চেয়ে বসলেন খাঁ সাহেব। শুধুমাত্র তাঁর গাওয়ার সুবিধার্থে একদিনের মধ্যে সে দৃশ্য সম্পাদনার কাজ শেষ করে তাঁর সামনে এনে মজুত করা হল। অতঃপর, প্রোজেকশনে সে দৃশ্যের ঘটমান বর্তমানের দিকে তাকিয়ে সোহিনী রাগের কালজয়ী বন্দিশ, “প্রেম জোগান বন কে” গাইলেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ। এভাবেই তো সেলুলয়েড ইতিহাস নির্মাণ করে। দৃশ্যের ইতিহাস, শব্দের ইতিহাস, অবশিষ্ট থাকে কেবলমাত্র তার উপসংহারীয় সুগন্ধ। বড় চটজলদি আখ্যান বিস্মৃত হয়ে যাই আমরা।

More Articles