বিয়াাল্লিশ পর্যন্ত উদ্দাম জীবন, বিয়েই বদলে দিয়েছিল ইমরানকে

ইমরান খান– ক্রিকেটের ইতিহাসে নামটি উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাসে? ইমরান খান বিতর্কে আরেকবার সরগরম আন্তর্জাল দুনিয়া। সকলেরই এক প্রশ্ন। রাজনীতির ইনিংস এত তাড়াতাড়ি কি ফুরিয়ে গেল কাপ্তানের? আসলে রাজনীতি তো ঠাসবুনোট নয়, তার অনিশ্চয়তার ভাঁজে ভাঁজে থেকে যায় ফিরে আসার আশ্বাস। অনুরাগীরা সেই খড়কুটোটুকু ধরে ভাসতে চান। তবে রাজনীতিক ইমরানের অনুরাগী আদৌ বাকি রয়েছে কি না– সেটা জরুরি প্রশ্ন। সমর্থনহীন, পরিত্যক্ত এই পথে কি হাঁটতে পারবেন ইমরান খান? যদি না পারেন, তবে রাজনীতিক ইমরান কি বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবেন? যে প্রধানমন্ত্রীকে সরে দাঁড়াতে হয়, রাজনীতির মতো ভাবমূর্তিসর্বস্ব জায়গায় তিনি আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন তো? একদা ক্রিকেটে লক্ষ মানুষের মন জয় করা এই ব্যক্তিত্বের কি তবে রাজনীতিতে আসাটাই ভুল হয়েছিল? প্রশ্ন অনেক। এইসব প্রশ্নদের ভিড়ে এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক ইমরানের জীবনের নানা বর্ণময় ঘটনা।

রাজনীতিতে আসার আগে একবার এক সাক্ষাৎকারে অসাবধানী ইমরান বলেছিলেন, “প্লেবয়টা একটু বাড়িয়ে বলাই, তবে সন্ন্যাসীও আমি নই!” পাকিস্তানের এক জমিদার বংশে ইমরান খান নাজির জন্ম। প্রাথমিক পড়শোনা পাকিস্তানেই, এইচিশন কলেজে। পরে অক্সফোর্ডের ওয়রচেস্টার গ্রামার স্কুল ও কেবল কলেজে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা। পড়াশোনায় কপাল তেমন না খুললেও ক্রিকেটটা হয়ে গেল হঠাৎ করেই। ’৭১ সালে পাকিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট দলে যখন টেস্ট খেলা শুরু করলেন, তখন তাঁর বয়স ১৮। ব্যাটিং এবং বোলিং– দুইয়েই দক্ষ ছিলেন। ১৯৭৪-এ ওয়ান ডে খেলা শুরু করছেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই। আবার অক্সফোর্ডে থাকাকালীন ‘অক্সফোর্ডস ব্লুজ’–এ খেলেছেন ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ অবধি। অক্সফোর্ড থেকে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে পাকাপাকি ফিরে আসছেন পাকিস্তানে। জাতীয় দলে নিয়মিত খেলা শুরু হচ্ছে ১৯৭৬-এই। এরপরে খ্যাতির চূড়ান্ত। সেই পথেই ১৯৯২-এর বিশ্বকাপ। পাকিস্তানকে কাপ জিতিয়ে দিয়েছিল ‘কাপ্তান’-এর নেতৃত্বই। 

বিচিত্র ছিল তাঁর যাপন। সবথেকে পরিচিত ছবিগুলির মধ্যে একটি, ‘বিগ বয়েজ প্লে অ্যাট নাইট’ লেখা একটি টি-শার্ট পরে পোজ দিচ্ছেন ইমরান। তখন জীবনের নেশা তুঙ্গে। প্রায় রোজ নাইটক্লাবে দেখা যেত তাঁকে। সঙ্গে কোনও মডেল বা অভিনেত্রী বা অভিজাত নারী। ব্যাপারটা উপভোগ করতেন ইমরান। লর্ড গর্ডি হোয়াইটের কন্যা সীতা হোয়াইটের সঙ্গে প্রেম ছিল একদা। লাইমলাইটের নানা নাম আকছার জড়িয়ে পড়ত ইমরানের সঙ্গে। প্রথম থেকেই ‘পলিঅ্যামোরাস’ ঝোঁক তাঁর ছিল। জীবনের নেশায় প্রথম বিয়াল্লিশটি বছর বিয়ে করেননি ইমরান। সম্ভবত, এই সময়টুকু তাঁর জীবনের, তাঁর ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ পর্যায় বলা চলে। ১৯৯৫ সালে প্রথম বিবাহবন্ধনে জড়ালেন ইমরান। ব্রিটিশ সমাজবাদী জেমাইমা গোল্ডস্মিথের বয়স তখন ২১ মাত্র। ক্রিশ্চান জেমাইমা ইসলাম নিলেন। সংসারে জড়ালেন। এই বিয়ের যখন বছরদশেক বয়েস, ২০০৪-এ, মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে গেল। আবারও একা ‘কাপ্তান’। তবে ১৯৯৬ থেকে রাজনীতির আশপাশে দেখা যাচ্ছিল তাঁকে। সেই কারণে আগের জীবনে ফিরে যাওয়ার কিছু বাধাবিপত্তি ছিল। ফলে, গতিবিধি আলো থেকে অন্ধকারে এল।

২০১৫-য় ব্রিটিশ-পাকিস্তানি সাংবাদিক রেহম নাইয়ার খানের সঙ্গে দ্বিতীয় বিবাহ। কিন্তু এই বিয়ে দশ মাসের মাথায় ভেঙে গেল। বিবিসি-র বিখ্যাত আবহাওয়া বার্তা উপস্থাপক রেহম ইমরানের যাপন একদমই পছন্দ করলেন না। নিজের আত্মজীবনীতে ইমরানের বহুবিধ সম্পর্কের কথা খোলাখুলি লিখলেন তিনি। এমনকী, রেহমের দাবি অনুসারে পাঁচটি অবৈধ সন্তানও রয়েছে ইমরানের। যদিও এই ঘটনা আলোয় থাকা মানুষদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্বাভাবিক। প্রায় প্রতি বছরই কোনও না কোনও খেলোয়াড় এই অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তবে রেহমের বইতে ইমরানের বহুনারীসঙ্গের পাশাপাশি কোকেনের নেশার কথাও উঠে এসেছে। একের পর এক এইসব অভিযোগে নালে-ঝোলে অবস্থা সামাল দিতে রাজনীতিক ইমরান পরের চালটি চাললেন। বিয়ে করলেন তাঁর আধ্যাত্মিক উপদেষ্টাকেই। বুশরা ওয়াট্টুকে সম্পূর্ণ ইসলামি আদবকায়দায় বিবাহ করেন ইমরান। এবং হিজাব বা বুরখা না পরে কখনও বেরতে দেখা যেত না তাঁকে। সেই সময় বহু কাগজে খবর হয়েছিল, স্বপ্নাদেশ পেয়েই বুশরা বিবিকে নাকি বিবাহ করেছেন ইমরান। গুজবে এও রটেছিল, স্বয়ং মুহম্মদ নাকি ইমরানকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে নিজের জীবন ও দেশের উন্নতির জন্য বুশরাকে বিবাহ করতে আদেশ দিয়েছিলেন। কুসংস্কারগ্রস্ত বলেও ইমরানের পরিচিতি ছিল। ফলে, সেই স্বপ্নাদেশ রাখতেই নাকি ইমরানের বিবাহ এই প্রিনিকে। সুন্নি মহিলা আধ্যাত্মিক উপদেষ্টাকে ‘প্রিনি’ বলা হয়। বুশরা পাঁচ সন্তানের জননী। সত্তরের কাছাকাছি ইমরানকে এই বিয়ে নিয়ে বারবার বলতে শোনা গেছে, এ কেবল আধ্যাত্মিক যোগ, শারীরিক আকর্ষণের তেমন ভূমিকা ছিল না এতে।

২০১৮-র নির্বাচনে বিপুল জয়ের পরে ইমরানের ওপর বুশরার প্রতিপত্তি আরও বাড়ে। গোঁড়া ঐতিহ্যপন্থী হয়ে পড়েন ইমরান এবং সাতের শতকে মদিনা যেমনটি ছিল, পাকিস্তানকেও তিনি তেমনটি করেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

যদি খেয়াল করা যায়, প্রতিটি বিয়ে ইমরানকে আরও গোঁড়া করে তুলেছে। ইমরানের তিনজন স্ত্রীর মধ্যে ক্রমানুসারে রক্ষণশীলতাও বেড়েছে। জেমাইমা ইসলাম গ্রহণ করার পরেও মাথা ও কেশ খোলা রাখতেন, রেহম ক্বচিৎ-কদাচিৎ দোপাট্টা ব্যবহার করতেন, সেখানে বর্তমান স্ত্রী রীতিমতো পর্দা মেনে চলেন। কেউ কেউ বলে থাকেন, যত জীবন এগিয়েছে, রাজনৈতিক চিন্তাধারাও তত প্রতিক্রিয়াশীল হয়েছে ইমরানের। ক্রিকেটার ছিলেন, রাজার মতো বাঁচতেন, দলীয় রাজনীতির তেমন সম্যক ধারণা ইমরানের কোনওদিনই ছিল না, এবং তা বজায় রাখার ক্ষমতাও ছিল না তাঁর। এখন রাজ্যের অপবাদ-অপমান মাথায় নিয়ে যখন মাথা নিচু করে সরে দাঁড়াতে হল, তখন কি এই কথা আদৌ ভাবছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী? ক্রিকেট মাঠের অনবদ্য সাফল্যের কথা কি তাঁর মনে পড়ছে একবারও?

More Articles