আশ্বাসে কল্পতরু আদানি, বঙ্গ বিজেপির নৌকা টলোমলো?


ফাটা বাঁশেই শেষ পর্যন্ত আটকে গেল বঙ্গ-বিজেপি৷ অতিমারীর কারণে দু’বছর বন্ধ থাকার পর বুধবার রাজারহাটের বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে বসেছে দু’দিনের বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন। এই সম্মেলন নিয়ে যথারীতি সরব বিরোধী শিবির৷ এ-পর্যন্ত পাঁচবার এই ধরনের রাজসূয় যজ্ঞের আসর সাজিয়েছে রাজ্য সরকার ৷ আগের পাঁচটি সম্মেলনে মোট ১২.৩৫ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাবের কথা বলা হয়েছিল সরকারের তরফে৷ বিরোধীদের প্রশ্ন, বিপুল অঙ্কের যে লগ্নির দাবি সরকার করছে, আদপে এসেছে তার কতখানি? রাজ্যে তৃতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার পরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, এবারের লক্ষ্য খুব স্পষ্ট৷ শিল্পায়নের মাধ্যমে রাজ্যে বিপুল কর্মসংস্থানই অগ্রাধিকার। তৃতীয় দফায় বড় শিল্পের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ টানতে মরিয়া উদ্যোগ নেবে তাঁর সরকার, তা স্পষ্ট করেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার আবহেই এবারের এই বাণিজ্য সম্মেলন।

এ বছর কত লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব আসবে, তা এখনও স্পষ্ট না হলেও একটা বিষয় সামনে এসেছে, এই সম্মেলন চরম অস্বস্তিতে ফেলেছে বঙ্গ-বিজেপিকে৷ শিল্প সম্মেলনের মঞ্চ আলো করে এবার হাজির আদানি গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানি। শিল্প মহল তথা রাজ্য সরকারের আশা, রাজ্যে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ আসতে পারে তাজপুর গভীর সমুদ্র বন্দরকে ঘিরে। আগেই প্রস্তাবিত এই সমুদ্র-বন্দরে রেকর্ড বিনিয়োগ করার কথা জানিয়েছে আদানি গোষ্ঠী। বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দিয়ে রাজ্য সরকারকে নিরাশ করেননি গৌতম আদানি৷ আদানি গ্রুপের সেরা প্রকল্প বাংলার জন্যই গড়ে তোলা হবে৷ এদিনের বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চে এই ঘোষণাই করেছেন গৌতম আদানি। তিনি বলেছেন, বাংলায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হবে, ২০ থেকে ২৫ হাজার নতুন কর্মসংস্থান হবে। মোদি-ঘনিষ্ঠ আদানির এই ঘোষণায় রাজ্য সরকার যতখানি খুশি, তার শত গুণে মুষড়ে পড়েছে রাজ্য বিজেপির নেতানেত্রীরা।

গৌতম আদানি এবং তাঁর পুত্র দফায় দফায় নবান্নে এসে ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় কথা সেরেছেন। সেই বৈঠকগুলির পর রাজ্য সরকারের ধারণা হয়েছে, তাজপুর ছাড়া আরও একাধিক ক্ষেত্রে আদানিদের বড় বিনিয়োগের সম্ভাবনা প্রবল। এই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর আসার কথা ছিল বলে সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়েছিল। যে কোনও কারনেই হোক, প্রধানমন্ত্রী আসেননি। গোটা দেশ জানে, গৌতম আদানি দীর্ঘদিন ধরেই প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বিজেপি-বিরোধী শিবির প্রায় প্রতি মুহূর্তেই মোদি-আদানি সখ্যের প্রসঙ্গ তুলে কেন্দ্রকে তোপ দাগে। প্রধানমন্ত্রী না এলেও আদানি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। মোদির 'অনুমতি' ছাড়া আদানি গোষ্ঠী বাংলায় বিনিয়োগের কথা ভাবছে, এটা হজম করা কষ্টকর। গৌতম আদানি ধুরন্ধর ব্যবসায়ী। মোদির কাছে অপ্রিয় হতে হবে, এমন কোনও কাজই তিনি করতে যাবেন না।

আরও পড়ুন: মমতার স্বপ্নের তাজপুর বন্দর কি আদানির হাতে? আদৌ লাভ হবে রাজ্যের?

আর ঠিক এখানেই বিপাকে পড়েছে বঙ্গ-বিজেপি। বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর আসা ঠেকিয়ে দেওয়ার বিষয়ে বিজেপির বাংলার নেতাদের কোনও ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু আদানির যোগদান আটকানোর ক্ষমতা এই নেতাদের নেই। ফলে, চরম অস্বস্তিতে বিজেপি।

বাণিজ্য সম্মেলনের পাল্টা হিসেবে এদিনই জোড়া রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েছে বিজেপি। বিজেপির তরফে জানানো হয়েছে, সিঙ্গুরের খাসের ভেড়ি এলাকা এদিনই পরিদর্শন করবেন দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। সেখানে স্থানীয়দের সঙ্গেও কথা বলবেন। ওদিকে বীরভূমের দেউচা-পাঁচামিতে গিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। দুই কর্মসূচিই আসলে নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার মরিয়া চেষ্টা বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। আসলে বাণিজ্য সম্মেলনে এসে বিজেপি-র 'ঘরের ছেলে' গৌতম আদানি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূয়সী প্রশংসা করে যাবেন, এটা মেনে নিতে পারছে না রাজ্য বিজেপি। তারা বেশ বুঝতে পারছে, আদানি-সফরের পর রাজ্য বিজেপির তৃণমূল- বিরোধিতা হবে নেহাতই কসমেটিক। রাজ্য নেতৃত্বের বোধগম্য হচ্ছে না, দিল্লি কেন তাঁদের সঙ্গে এমন বিমাতৃসুলভ আচরণ করল?

এমন পরিস্থিতি এই রাজ্যে এই প্রথম হল, এমন নয়। এর আগেও এমন সব কাণ্ডই হয়েছিল। বামফ্রন্ট আমলে বারবার কেন্দ্রের এমন প্যাঁচে ফেঁসেছিল তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস। ১৯৭৭ থেকে টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল বামেরা। ওই সময়ের মধ্যে কেন্দ্রে যতদিন কংগ্রেস সরকার ছিল, ততদিনই প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা ধারাবাহিকভাবে প্রধানমন্ত্রীদের কাছে বাংলার বাম সরকারকে 'টাইট' দেওয়ার, এমনকী উৎখাত করার দরবার করে যান। প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি পদে তখন রাজনীতির নক্ষত্ররা।গনিখান চৌধুরি, অজিত পাঁজা, আনন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, সোমেন মিত্র, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিদের মতো রাজনীতিকরা পর পর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির আসনে। বাংলাজুড়ে হানাহানি। খুন, জখম, আগুন তখন নিত্যদিনের ঘটনা। শ'য়ে শ'য়ে কংগ্রেস নেতা-কর্মী অকালে প্রাণ হারান। ওই সময়জুড়ে এই স্তরের নেতারা তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার বা এআইসিসি-র কাছে বারবার আর্জি জানান, পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। দাবি ওঠে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার। কেন্দ্র তথা এআইসিসি প্রতিবার প্রদেশ নেতৃত্বের বক্তব্য মন দিয়ে শুনতেন, আশ্বাস দিতেন ব্যবস্থা নেওয়ার। সেসব শুনে বাড়তি অক্সিজেন নিয়ে দিল্লি থেকে ফিরতেন কংগ্রেস নেতারা। জানাতেন, এবার বাম সরকারের দিন শেষ, দিল্লি এবার সক্রিয় হচ্ছে।

আরও পড়ুন: ভারতের প্রথম পাঁচ ধনকুবের কারা? আম্বানি-আদানি আর…?

তেমন কোনও ঘটনাই শেষ পর্যন্ত ঘটেনি। কেন্দ্রের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার এ রাজ্যের বাম সরকারকে বিন্দুমাত্র 'বিরক্ত' করেনি। বরং বলা ভাল, বাম সরকারকে 'বন্ধু' হিসেবেই দেখত। ফলে প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের কোনও আর্তিতেই দিল্লির চিঁড়ে ভেজেনি। শেষ পর্যন্ত বামফ্রন্ট সরকারের 'ন্যাচারাল ডেথ' হয় ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে‌। রাজনৈতিক মহল এবারও সেই ইতিহাসের সঙ্গেই মিল খুঁজে পাচ্ছে। বদল হয়েছে শুধু কুশীলবদের রংয়ের। রাজ্যে সেদিনের প্রদেশ কংগ্রেসের ভূমিকায় এখন বঙ্গ-বিজেপি। সেদিন প্রদেশ কংগ্রেসকে আমল দেয়নি এআইসিসি ও কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার৷ আজ রাজ্য বিজেপিকে পাত্তা দিচ্ছে না বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তথা মোদি সরকার। গৌতম আদানির নবান্নে এসে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দফায় দফায় লগ্নি-বৈঠক করে যাওয়া এবং মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বাণিজ্য সম্মেলনে হাজির হয়ে সকলের নজর কেড়ে নেওয়ার পর সেদিনের প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আজকের বঙ্গ-বিজেপি নেতাদের মধ্যে কি একটা মিল দেখা যাচ্ছে না? আদানি-গোষ্ঠী বাংলায় প্রস্তাবিত প্রকল্পের কাজ শুরু করামাত্রই কার্যত খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দেবে বঙ্গ-বিজেপি নেতাদের৷ এমনিতেই রাজ্য বিজেপি এখন শতধাবিভক্ত। এক একজন নেতার এক একটা বিজেপি। প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বর্তমানে দলের এক্সট্রা প্লেয়ার। মর্নিংওয়াকের সময় বাণী দেওয়া ছাড়া আপাতত আর কোনও কাজ দিলীপবাবুর নেই। দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির গুরুত্ব কতখানি, দিলীপবাবু আজ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন‌। ওদিকে বর্তমান সভাপতি এখনও রাজ্য রাজনীতি বা দলীয় সংগঠনের প্যাঁচ-পয়জার, কিছুই বোঝেন না‌। প্রবেশনে আছেন বলা যায়। বোঝাই যায়, সাইডলাইনের ধারে বসে থাকা রিজার্ভ প্লেয়ারকে সরাসরি দলের ক্যাপ্টেন করে দিল্লি বিজেপি এ-রাজ্যের সংগঠনে ব্রেক কষেছে।

দিল্লিতে এখন জল্পনা চলছে, সুকান্তবাবুকে সরিয়ে সভাপতির আসনে নাকি বসতে চলেছেন সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়। অন্যদিকে, রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা ক্রমশই মেদিনীপুরের নেতা হয়ে যাচ্ছেন। যে বিধায়কদের তিনি নেতা, সেই বিধায়কদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আজ আর তাঁকে 'নেতা' হিসাবে মানতে নারাজ। এই তিনজনের বাইরে রাজ্য বিজেপি-তে আলোচনাযোগ্য চতুর্থ মুখ রাজ্যে কোথায় ?

মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গৌতম আদানির বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দেওয়া, লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়ার পর বঙ্গ-বিজেপি তাই ফাঁপরে। মোদিজি বা শাহজির কাছ থেকে সবুজ সংকেত না পাওয়া সত্ত্বেও আদানি কলকাতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে সুর মিলিয়ে বাংলার সার্বিক উন্নয়ণের কথা বলছেন, অতি বড় মূর্খও একথা বিশ্বাস করেন না। এর আগে নবান্নে বৈঠক সেরে ফেরার পথে আদানি বলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তিনি খুশি। টুইটে তিনি লিখেছিলেন, "মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আনন্দিত। বাংলার প্রভূত সম্ভাবনা এবং লগ্নি নিয়ে আলোচনা হল। ২০২২-এর এপ্রিলে বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটে যোগ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছি।"

বিজেপির রাজ্য নেতারা আজ ভাবতেই পারেন, এসব হচ্ছেটা কী? বাংলার বিজেপিকে এভাবে পিছনের বেঞ্চে কেন পাঠাচ্ছে দলের শীর্ষ স্তর? একুশের বিধানসভা নির্বাচনে মোদি-শাহ জোর ধাক্কা খেয়েছেন। ওদিকে আসানসোল উপনির্বাচনে তিন লক্ষাধিক ভোটে হাতছাড়া হয়েছে গেরুয়া-আসন। এসবেরই কি বদলা নিচ্ছে দিল্লির বিজেপি? বঙ্গ- বিজেপির নেতাদের আজ সম্ভবত দিল্লি আর এদের পাত্তা দিতেই নারাজ। সেই বার্তাই প্রতি পদে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।

রাজনীতি সবসময়ই সম্ভাবনার শিল্প৷ আগামী দিনে যদি দেখা যায়, হলদিয়া বন্দরটি সম্পূর্ণতই পোর্ট ট্রাস্টের হাত থেকে নিয়ে গৌতম আদানি'র হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, কী বলবে বিজেপি? বাংলার প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বঙ্গ-বিজেপি তার বিরোধিতা করতে পারবে? তাজপুর গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পে যদি আদানিরা সত্যিই অংশ নেয়, পারবে বিজেপি আপত্তি জানিয়ে পথে নামতে? অথবা দেউচা পাঁচামি যদি আদানিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, রাজ্য বিজেপি একটা শব্দ করারও সাহস দেখাতে পারবে? অসম্ভব। বঙ্গ-বিজেপিকে সেদিন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করতে হবে৷ কিন্তু আদানি না হয়ে এই বরাতগুলি যদি নবান্ন-ঘনিষ্ঠ কোনও শিল্পপতি পেতেন, কী করত বঙ্গ-বিজেপি? নীরব থাকতেন গেরুয়া নেতারা? কখনওই নয়।

More Articles