বঙ্গ বিজেপির কাহিল অবস্থা বেআব্রু সংঘের রিপোর্টে, বড় বিপদ অপেক্ষা করছে?
সংঘ পরিবারের এই সমীক্ষা রিপোর্টের মূল বক্তব্যে বিজেপির শীর্ষ স্তর নিশ্চিতভাবেই মুষড়ে পড়েছে। ১৬ সাংসদ, ৬৯ বিধায়ক থাকা দলের এই হাল দেখে আশ্চর্যই হয়েছেন বিজেপির শীর্ষ স্তরের পোড় খাওয়া নেতৃত্ব।
এসেছিলেন অনেক আশা নিয়ে। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন বিজেপির পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওই নির্বাচনে বাংলায় জেতা সব আসন ধরে না রাখা গেলেও, দলের রাজ্য শাখা আশ্বস্ত করেছিল, কমপক্ষে ১২-১৪টি আসন তো মিলবেই। তাই দলের রাজ্য নেতাদের যতখানি দম লাগানো প্রয়োজন, তেমনই করেছেন বিজেপি-র জাতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। কিন্তু, সূত্রের খবর, একবুক হতাশা নিয়েই ফিরেছেন নাড্ডা সাহেব।
এই হতাশার কারণ, সংঘ পরিবারের একটি রিপোর্ট। কলকাতা সফরের সময়ই নাকি এটি বিজেপি সভাপতির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। রাজ্য বিজেপির সাংগঠনিক পরিস্থিতি নিয়ে তৈরি সংঘ পরিবারের ওই রিপোর্টে বঙ্গ বিজেপি-র যে চেহারা তুলে ধরা হয়েছে, তাতে কার্যত বিচলিতই হয়েছেন নাড্ডা। দিল্লিতে তিনি নিশ্চয়ই দলের শীর্ষ স্তরে কথা বলবেন সংঘের এই রিপোর্ট নিয়ে। আশা করা যাচ্ছে, রিপোর্টের ভিত্তিতে দ্রুত কোনও ব্যবস্থাও নিতে পারে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
প্রথমে অমিত শাহ, পরের বার জেপি নাড্ডা। একুশের ভোটে 'মহাপতনের' পর এতদিনে ঘুম ভেঙেছে বিজেপির শীর্ষ স্তরের। আসলে '২৪-এর লোকসভা নির্বাচন যে কুসুমাস্তীর্ণ পথে হবে না, ইতিমধ্যেই তা বুঝতে পেরেছেন মোদি-শাহ। তাই নতুনভাবে ঝাঁপাতে বাধ্য হয়েছেন। ওদিকে, গোটা দেশের প্রতিটি আসন ধরে ধরে খুঁটিনাটি বিচার করছে বিজেপি-র 'অভিভাবক' রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। লোকসভা নির্বাচনের আগে নাগপুরের নির্দেশে প্রতিটি রাজ্য বিজেপি কমিটিতে সংঘের তরফে সংগঠন দেখার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরাই কেন্দ্রওয়ারি সমীক্ষা করছেন। এ-রাজ্যেও এই কাজ চলছে। বাংলার এই সমীক্ষার প্রাথমিক রিপোর্টে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে দিল্লির পদ্ম-শিবিরের চোখ প্রায় কপালে।
আরও পড়ুন: বাংলায় আবার শূন্য থেকে শুরু! শাহি পরিকল্পনায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বঙ্গ বিজেপির দাপুটে নেতারাই
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এ-রাজ্যে ১৮ আসনে জয়ী হলেও বাবুল সুপ্রিয় এবং অর্জুন সিং দল ছাড়ার পর এখন তা দাঁড়িয়েছে ১৬-তে। লোকসভা ভোটের পর একুশের বিধানসভা নির্বাচন, কলকাতা-সহ রাজ্যের শতাধিক পুরসভার নির্বাচন এবং একাধিক উপনির্বাচনে গেরুয়া শিবির যে ফল করেছে, তাতে সাধারণভাবেই বলা যায় '২৪-এর নির্বাচনে বিজেপি-র পক্ষে জেতা আসন ধরে রাখা কার্যত অসম্ভব। আগামী বছর রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন। এই ভোট চলতি বছরেই এগিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের আগে এ-রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটেও বিজেপি-র বড়সড় ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
পরিস্থিতি এমন হওয়া সত্ত্বেও বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় দিনকয়েক আগে দাবি করেছেন, ২০১৯-এ জেতা আসন ধরে রাখাই শুধু নয়, বাংলায় বিজেপি বাড়তি আরও ৭-৮টি আসন পাবে। এমন দাবি বিজেপি-র আরও একাধিক নেতাও করেছেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে ঠিক যেভাবে ২০০ আসন পাওয়ার দাবি করা হয়েছিল, অনেকটা সেভাবেই দলের একটা অংশ লোকসভা ভোটেও ১৮-২৫ আসন লাভ করার আওয়াজ তুলেছেন। ব্যক্তিগতভাবে একাধিক গেরুয়া নেতা সেই বার্তা-ই পৌঁছে দিয়েছেন দলের শীর্ষ স্তরেও। বিধানসভা ভোট শেষ হওয়ার পর থেকে বাংলার সঙ্গে কার্যত সম্পর্ক না-রাখা দিল্লির নেতারাও এই বার্তায় আস্থা রেখে অনেকটা খুশিই ছিলেন। দিল্লির শীর্ষ নেতাদের বাংলায় আসা-যাওয়াও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আর তখনই সংঘ পরিবারের রিপোর্টে বাংলায় গেরুয়াবাহিনী ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে, তা তুলে ধরা হয়েছে।
সূত্রের খবর, নাড্ডাকে জানানো রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২৫ আসনের স্বপ্ন না দেখাই ভালো। গতবারের জেতা ১৮ আসন ধরে রাখাই এবার সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে বঙ্গ- সংগঠন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ফুটিফাটা। গোষ্ঠী কোন্দলে জর্জরিত রাজ্য কমিটিও। নিচুতলার সংগঠনের অবস্থা বেহাল। বহু পরিচিত নেতা দলের দফতরে আসা বন্ধ করেছেন মর্যাদা না পাওয়ার অভিযোগ এনে। অফিসিয়াল কমিটির সমান্তরাল সংগঠন চালাচ্ছে একাধিক গোষ্ঠী। প্রতিটি জেলা সংগঠনে চলছে নেতা-ভিত্তিক টুকরো টুকরো বিজেপি। এখনও রাজ্যের বিস্তীর্ণ অংশে দলের কোনও বুথ কমিটিই নেই। সাংসদ বা বিধায়কদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রকট হয়েছে। এই পরিস্থিতির আমূল উন্নতি না হলে লোকসভা নির্বাচনে ৫ -৮ আসনের বেশি আশা করা ঠিক হবে না। তাও নির্ভর করছে বেশ কিছু শর্তের ওপর। সম্ভাবনাপূর্ণ আসনের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং এবং আলিপুরদুয়ার আসনে দল ভালো অবস্থায় রয়েছে। ঠিকমতো লড়াই হলে কোচবিহার বা বালুরঘাট আসন আসতে পারে৷ তবে লড়াই হবে কঠিন৷ দক্ষিণবঙ্গে পুরুলিয়া আসন বিজেপি পেতে পারে৷ দলের পরিস্থিতি ভালো৷ সিএএ বিধি লাগু হলে বনগাঁ এবং রানাঘাট আসনদু'টিও বিজেপি-র ঝুলিতে আসতে পারে৷ সিএএ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া না হলে এই দু'টি আসনই হাতছাড়া হবে।
এছাড়া নিজের জোরে মেদিনীপুর আসন ধরে রাখতেও পারেন দিলীপ ঘোষ। এর বাইরে জেতা সব আসনের ক্ষেত্রেই নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি বা তমলুক আসন নিয়ে দলের একাংশ আশাবাদী হলেও, রিপোর্টে তা নস্যাৎ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত এই দুই আসনে তৃণমূলের টিকিটে নির্বাচিত দুই সাংসদ বর্তমানে বিজেপি-ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন বলেই রাজনৈতিক মহলের ধারণা।
সংঘ পরিবারের এই সমীক্ষা রিপোর্টের মূল বক্তব্যে বিজেপির শীর্ষ স্তর নিশ্চিতভাবেই মুষড়ে পড়েছে। ১৬ সাংসদ, ৬৯ বিধায়ক থাকা দলের এই হাল দেখে আশ্চর্যই হয়েছেন বিজেপির শীর্ষ স্তরের পোড় খাওয়া নেতৃত্ব। বঙ্গ বিজেপির কর্তারা কতখানি অযোগ্য, সেই ব্যাপারেও একটা নিশ্চিত ধারণা তৈরি হয়েছে। এখন দেখার, প্রায় ভেন্টিলেশনে যাওয়া বাংলার বিজেপিকে 'নিজের পায়ে' দাঁড় করাতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কোনও বিশেষ 'প্রেসক্রিপশন'-এর কথা ভাবেন কি না। অবশ্য এসব দেখে এবং শুনে হতাশ হওয়া দিল্লি বাংলাকে আলোচনার বাইরেও করে দিতে পারে, এমন আশঙ্কাও প্রবলভাবেই রয়েছে।