ভোজ কয় যাহারে! জামাইষষ্ঠীর ভুরিভোজে যে যে পদ রাখতেই হবে

শ্বশুরবাড়িতে জামাই পা রাখামাত্রই শুরু হয়ে যায়, ‘জামাই আদর’।

কথাতেই আছে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ, এই বৈশাখ থেকে চৈত্র মাস অবধি চলা ‘পার্বণ’গুলির মধ্যে কিন্তু বাঙালির জামাইষষ্ঠীও পড়ে আর পড়বে না-ই বা কেন, সারা বছরে এই একটিবারই তো কেবল শাশুড়িরা জামাইকে ডেকে, বসিয়ে খাওয়ানোর সুযোগ পেয়ে থাকেন। শত কাজ থাকলেও আজকের দিনে শাশুড়ির কাছে জামাইরা যেন বড়ই বাধ্য ছেলে!

এই জামাইষষ্ঠী পর্ব কবে শুরু হয়েছিল, তা ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু যা বোঝা যায়, তা হল, সনাতন সময়ে এই দিনে যে কেবল শাশুড়িরা নিজেদের জামাইকে নিজের কাছে পেতেন তা নয়, বরং তিনি হয়তো অনেক বেশি উৎসুক হয়ে থাকতেন, নিজের মেয়ের মুখটাও বছরে অন্তত একবার দেখবেন বলে। সেই ছোটবেলায় যে নিজের ঘরের লক্ষ্মীকে সঁপে দিয়েছিল পরের হাতে, জামাইষষ্ঠী সেই লক্ষ্মীকে একবার ফিরে পাওয়ার দিনও বটে। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জামাইষষ্ঠীর অনেক পরিবর্তন ঘটলেও বাঙালি বাড়িতে কিছু রীতি আজও মেনে চলা হয়। শ্বশুরবাড়িতে জামাই পা রাখামাত্রই শুরু হয়ে যায়, ‘জামাই আদর’। সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসা জামাইদের প্রথমেই বসতে দেওয়া হয়, বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর নকশা করা আসনে, জামাইয়ের ঘাম জুড়োনোর জন্য আগেকার দিনে শাশুড়িরা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতেন। কিন্তু আজকের শাশুড়িকে এত কষ্ট করতে হয় না, ফ্যান কিংবা এসি আজকের সেই হাতপাখার স্থান কেড়েছে। এরপরেই আসে সরবতের পালা। আগের সময়ে পাথরের গেলাসে নানাবিধ সরবৎ পরিবেশন করা হতো, তারপরে আসে কাঁসা, এবং বর্তমানে কাঁসার পরিবর্তে এসেছে নানা আকারের কাচের গেলাস আর সরবতের বদলে এসেছে স্কোয়াশ কিংবা কোল্ড ড্রিংক অথবা প্যাকেট লস্যি। এরপরেই আসে আশীর্বাদের পালা।

আরও পড়ুন: বাঙালির প্রিয় এই সন্দেশের সৃষ্টি জামাই ঠকাতে! বাড়িতেও বানাতে পারেন এই মিষ্টি

ষষ্ঠী দেবীর আশীর্বাদী তালপাতার পাখায় একশো আটটি দূর্বা এবং বাঁশের কুড়ুল, ধান, ফুল, ফল আর করমচা দিয়ে, জামাই বাবাজীবনের মাথায় ছুঁইয়ে তিনবার ‘ষাট, ষাট, বালাই ষাট’ বলে স্নেহাশিস দান করেন শাশুড়িরা। যদিও বর্তমান বাজারে এসি কিংবা ফ্যানের দৌলতে তালপাতার পাখা প্রায় বিলুপ্ত বললেই চলে। কথাতেই আছে, জৈষ্ঠের গরমে আম-কাঁঠাল পাকে। তাই আগেকার দিনে এই আশীর্বাদ পর্বের পর বড় কাঁসার থালায় জামাইকে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচু ইত্যাদি ফল সাজিয়ে দেওয়া হতো, এই ছিল জামাইয়ের জলখাবার। শোনা যায়, তখনকার দিনে জামাইদের কাঁঠাল খাওয়া নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। কিন্তু আজকের দিনে জলখাবারে ফলের পরিবর্তে বেশিরভাগ বাড়িতেই লুচি এবং ছোলার ডাল কিংবা জামাইয়ের পছন্দমতো কিছু তরকারি খেতে দেওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে থাকে কিছু গোনাগুনতি কেটে দেওয়া ফল।

এরপর মধ্যাহ্নভোজের পালা। সেই সময় পঞ্চব্যঞ্জনে ভরিয়ে দেওয়া হতো জামাইয়ের পাত, এছাড়াও থাকত বাড়ির পুকুরের মাছের মুড়ো এবং পাঁঠার মাংস, আর শেষের পাতে থাকত পায়েস, মিষ্টি। চাটনি খাওয়ার চল তখন কেমন ছিল, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। খাবার শেষে থাকত পান-সুপারি। বর্তমানে এই খাবারের নানা পরিবর্তন দেখা যায়। সবশেষে একটি শান্তিপুরী ধুতি, ফিনফিনে পাতলা আদ্দির কাপড়ে তৈরি পাঞ্জাবির সঙ্গে মানানসই চিকন উত্তরীয় আর কোলাপুরী চপ্পল দিয়ে ডালি সাজিয়ে শাশুড়ি জামাইদের আশীর্বাদ করতেন। এই উপহার-পর্ব থেকে কিন্তু বাদ পড়ত না কন্যাও। গোটা একখানা হইহই রইরই উৎসবে এইটুকুই যা তার প্রাপ্তি।

একথা স্বীকার করতেই হবে, আগেকার দিনের মানুষের মতো আজকাল মানুষ এত খেতে পারে না, এবং সত্যি বলতে হয়তো চায়ও না। সকলেই আজকাল নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ চিন্তিত। নিত্যকার ডায়েট মেপে চলা জামাইরা একদিনে এত কিছু খেয়ে যাতে অসুস্থ না হয়ে পড়েন, তাই জামাইষষ্ঠীর আগে বিভিন্ন সংবাদপত্রে পালা করে প্রকাশিত হতে থাকে ডায়েট টিপস। তাই হয়তো আধুনিক শাশুড়িরা জামাইয়ের চাওয়া-পাওয়ার কথা ভেবে চলতেই আজকাল বেশি পছন্দ করে থাকেন। আবার কর্মব্যস্ততাময় জীবনে অফিসগামী শাশুড়িদের পক্ষে হয়তো সময় ব্যয় করে পঞ্চব‍্যঞ্জন রান্না করাও সম্ভব নয়। তাই তো বাঙালির জামাইষষ্ঠীর নতুন ঠিকানা হয়ে উঠেছে বড় বড় রেস্তোরাঁগুলি, এতে কিন্তু জামাইরাও বেশ খুশি আর শাশুড়িও পরিবারের সঙ্গে ভালোভাবে কাটানোর জন্য খানিক সময় পান।

এই পার্বণে যেহেতু নানাবিধ পদ একটি বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে, সেই কথা মাথায় রেখে শহর কিংবা মফসসলের তামাম রেস্তোরাঁগুলি ‘থালি’-র ব্যবস্থা করে থাকে এবং বেশ কিছুদিন আগে থেকেই চলতে থাকে দফায় দফায় বিজ্ঞাপন, অনেক ক্ষেত্রে আবার অগ্রিম বুকিংও করে রাখতে হয়, নয়তো সিট পাওয়াই দুষ্কর হয়ে যায়। সিট না পাওয়ার বিষয়টি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, আজ কত লোক এই রেস্তোরাঁর জামাইষষ্ঠীতে অভ্যস্ত।

চলুন এবার দেখে নেওয়া যাক, কেমন হতে পারে ক্লাসিক জামাইষষ্ঠীর আদর্শ থালি‌।

 

১। গন্ধরাজ লেবুর সরবৎ

২। দেরাদুন চালের ভাত

৩। স্যালাড

৪। সোনা মুগের ডাল

৫। পাঁচ পদের ভাজা

৬। তপসে মাছ ভাজা

৭। ভেটকি পাতুড়ি

৮। বাসন্তী পোলাও

৯। গলদা চিংড়ির মালাইকারি

১০। কচি পাঁঠার ঝোল

১১। চাটনি

১২। পাঁপড়

১৩। মিষ্টি দই

১৪। মিষ্টি

বর্তমান সময়ে আরও একটি খাবার কিন্তু এই তালিকায় যোগ হয়েছে, সেটি হলো আইসক্রিম। জৈষ্ঠের গরমে এত কিছু খাবারের পর একটু আইসক্রিম না হলে যেন ঠিক জমে না গোটা বিষয়টা। তবে সত্যি বলতে, বর্তমানে ‘আদর্শ থালি’ কথাটা কতখানি যুক্তিযুক্ত, তা সঠিক করে বলা যায় না। ওই যে আগেই বললাম, আজকালকার শাশুড়িরা জামাইয়ের পছন্দকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বিরিয়ানি বলতে গেলে প্রায় সবারই প্রিয় খাবার, তাই প্রায়শই দেখা যায়, থালির বদলে জামাইয়ের পছন্দমতো মটন বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ দিয়েই সেরে ফেলা হচ্ছে মধ্যহ্নের ভুরিভোজ। তা মোগলাই খাবারে যখন এসেই পড়া গেছে, তখন মাছের কিংবা মাংসের রেজালা আর বাদ থাকে কেন? এই গরমে দই দিয়ে তৈরি এই পদগুলি কিন্তু আজকের ছিমছাম জামাইদের জন্য বেশ মানানসই।

এ তো গেল, দুপুরের কথা। জামাইকে তো অন্তত সন্ধের খাবারটা খাইয়ে বাড়ি পাঠাতে হবে, তাই না? সারাদিন একেবারে বাঙালি কিংবা মোগলাই আইটেমগুলি খাওয়ার পরে, ক্লান্ত হয়ে যখন আবার কিছু নতুন করে বানাতে ইচ্ছে করবে না, তখন অর্ডার করে ফেলাই যায় কিছু ইতালিয়ান কিংবা মেক্সিকান খাবার। এখন তো প্রত্যেকের হাতের মুঠোয় ফোন আর ফোনেই রয়েছে ফুড ডেলিভারি অ্যাপ। তবে এতেও যদি আপনার জামাই-আদর অসম্পূর্ণ থেকে যায়, আরও নতুন কিছু খাওয়াতে ইচ্ছা হয় জামাইকে, তাহলে কিন্তু আধুনিক শাশুড়িদের ইউটিউবই ভরসা। সব শেষে বলতেই হবে, ট্যাঁকে জোর থাকলে সেকালের জামাইষষ্ঠীতেও ভাটা পরেনি, আজকের জামাই আদরেও পড়বে না।

 

 

More Articles