আকবরের সময় থেকেই চলছে পয়লা বৈশাখ উদযাপন!

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন। তাই উৎসবমুখর বাঙালি পয়লা বৈশাখী আনন্দে গা ভাসাবে না তা হয় নাকি! তবে সংস্কৃতি বদলেছে। এককালে গৃহিনীর হাতে তৈরি ইশিল ভাপা আজ অনলাইনে কনভার্ট করেছে। স্মার্ট ফোনের এক ক্লিকে অনলাইনে বাঙালির রসনা বিলাস। সে যাই হোক পয়লা বৈশাখের কথা যখন উঠল, তখন বলে রাখা দরকার বাংলার সনগণনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুঘল সম্রাট আকবরের নাম। কী ভাবে? 

সম্প্রীতির উৎসব পয়লা বৈশাখের সূচনাও হয়েছিল মুঘল আমল থেকেই। 'দ্য হিস্টোরিক্যাল ডিকশিনারি অফ বেঙ্গলিস'-এ উল্লেখ রয়েছে খাজনা আদায়ের সমস্যা হওয়া নিয়ে বাংলায় প্রথম সন গণনা শুরু। সেই সময়ে চৈত্র মাসের শেষের দিন খাজনা আদায়ের শেষ দিন বলে ধরা হত। সেই সঙ্গে বছরের প্রথম দিন নতুন হালখাতা নিয়ে নতুন ভাবে খাজনা আদায়ের হিসেব তুলে রাখা হত। সম্রাট আকবরই প্রথম বাংলায় নতুন ক্যালেন্ডার তৈরির করা ভেবেছিলেন। যা পরে বাস্তবায়িত করা হয়।
পয়লা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা নববর্ষ। দিনটি সকল বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সঙ্গে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশে জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত।

পয়লার ইতিহাস

সৌরপঞ্জিকা অনুসারে বাংলার বারো মাস অনেক কাল আগে থেকেই পালিত হত। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হত গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বাংলা, কেরল, মনিপুর, নেপাল, ওড়িশা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু  এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার কারণে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুকালীন উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ, কারণ প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।

মুঘল যোগ


ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী  ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। 


গাজন ও গ্রাম বাংলার পার্বন


চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুব সংক্রান্তির দিন পালিত হয় গাজন উৎসব উপলক্ষ্যে চড়ক পূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এই দিনেই সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। এদিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসী বা ভক্তগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে আরাধ্য দেবতার সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা এবং সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকেন।
পয়লা বৈশাখের সঙ্গে মেলার স্মৃতি বাংলার গায়ে লেগে আছে। পয়লা বৈশাখের ভোরেই ঘুম ভেঙে অপেক্ষা, কখন মেলা শুরু হবে, কখন শোনা যাবে ঢাকের বাদ্য আর বাঁশির আওয়াজ। আর তখনই  অনেকে মিলে মেলায় যাওয়ার ধুম। স্মৃতির পাতা উল্টে দেখা যায়, অশ্বত্থতলা তখনও বেশ চওড়া, অনেক দোকান, অনেক লোক তার মধ্যে শিশু, কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা বোধ হয় বেশি। একটা টানাঢোল তো কিনতেই হবে, অন্ততপক্ষে একটা জাপানি বাঁশিও তারপর দেখেশুনে কেনাকাটা। সারা বছর জমানো পয়সায় অনেক কিছু কেনা। রঙিন ফিতা, নানা রঙের কাচের চুড়ি, আর বিশেষ করে পোড়ামাটির তৈরি ঘোমটাপরা ছোট্ট বউ আর বর-বউয়ের জোড়ামূর্তি।

আরও পড়ুন-বাজারে কাগজ বাড়ন্ত, এই নববর্ষে খেরোর খাতার ব্যবসায় ক্ষতি

 
হালখাতার অনুসঙ্গ


অনলাইন মার্কেটিংয়ের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির সাধের হালখাতা। পুরনো দিনে উঁকি দিলে দেখা যায়, পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যায় হালখাতা করতে যাওয়ার ধুম পড়ত বাঙালির ঘরে ঘরে। নতুন জামা গায়ে দিয়ে বাবা-মার হাতে ধরে দোকানে দোকানে হালখাতা করার সে কী ধুম!

তবে হালখাতার আসল ইতিহাস সম্পর্কিত কৃষিপ্রথার সঙ্গে। তখনকার দিনে হাল কিংবা লাঙল দিয়ে চাষের নানা দ্রব্য সামগ্রী তার হিসেব, বিনিয়োগ সবকিছুই একটি খাতায় লিখে রাখা হত, এটিকেই বলা হত হালখাতা। তাহলে নতুন বছরের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী ভাবে হল? সংস্কৃত ভাষায় হালের অর্থ লাঙল, কিন্তু ফরাসিতে এর অর্থ নতুন। 
এদিন বাংলার আনাচে কানাচে জাতি- ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে সিদ্ধিদাতা গণেশের পূজা করেন, ব্যবসায় সমৃদ্ধি লাভ করেন। অতিথিদের মিষ্টি, আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি রাখেন না তাঁরা। সাধারণত দিনের অমৃতযোগেই হালখাতা লেখার নিয়ম।

শেষ পাতে মিষ্টি

বাঙালির উৎসব আর তাতে  মিষ্টি মুখ হবে না তা হয় নাকি? পয়লা বৈশাখে মিষ্টির চাহিদা বেশি থাকে। মিষ্টি দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে বাঙালি। বউবাজারে নামকরা মিষ্টির দোকান ভীমচন্দ্র নাগ। সন্দেশের জন্য বিখ্যাত। শোনা যায়, ভীমচন্দ্র নাগের মিষ্টি খেয়ে কুক অ্যান্ড কেলভির বড়সাহেব মোহিত হয়ে একটি ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন। বাংলা হরফে লেখা সেই ঘড়ি নাকি এখনও বউবাজারের দোকানে রয়েছে। ট্র্যাডিশনাল সন্দেশের সঙ্গে ফিউশন মিষ্টিও এখন রাখা হচ্ছে। তবে নববর্ষে ভীম নাগের ট্র্যাডিশনাল সন্দেশের চাহিদা বেশি থাকে। এবারও তার ব্যতি হচ্ছে না। এছাড়া নানা রকম মিষ্টির পসরা সাজিয়ে ফেলেছে হিন্দুস্থান সুইটস, মনোহরা, রসায়নী, কামধেনু। ট্র্যাডিশনাল মিষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে ক্যাডবেরি সুইটসও।

তাহলে মিষ্টি মুখ দিয়েই এবার যাপিত হোক বাঙালির পয়লা বৈশাখ?

More Articles