তিন শর্তে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন বাংলার এই প্রথম মহিলা জমিদার

Rani Bhabani: খুবই অল্প বয়সে তাঁর বিবাহও সম্পন্ন হয় নাটোরের জমিদার রমাকান্তের সঙ্গে। নাটোরের জমিদার জঙ্গলে শিকার করতে গেলে, তাঁর ভবানী দর্শন হয়।

আঠারো শতকে যখন ভারতের বেশিরভাগ মহিলাই দিনযাপন করতেন পর্দার আড়ালে, বাড়ির অন্দরমহল‌ই ছিল তাঁদের দৈনিক আনাগোনার স্থান, সেই সময়ে রানি ভবানী বিরাজ করেছেন রাজশাহীর জমিদাররূপে। বাংলার প্রথম মহিলা জমিদার রানি ভবানীর কাহিনিই তাক লাগাবে আজও। রানি ভবানীর জন্ম বগুড়া জেলার তৎকালীন আদমদিঘী থানাধীন ছাতিয়ান নামক গ্ৰামে। জন্ম সাল ১৭১৬। বাবা আত্মারাম চৌধুরী ছিলেন ছাতিয়ানার জমিদার, মায়ের নাম জয়দুর্গা। শৈশবকাল থেকেই প্রজাহিতৈষী মনোভাব প্রকাশ পায় এই জমিদার কন‍্যার মধ‍্যে। খুবই অল্প বয়সে তাঁর বিবাহও সম্পন্ন হয় নাটোরের জমিদার রমাকান্তের সঙ্গে। নাটোরের জমিদার জঙ্গলে শিকার করতে গেলে, তাঁর ভবানী দর্শন হয়। জমিদার দৃঢ় সংকল্প করেন তিনি এই মেয়েকেই বিয়ে করবেন।

অন‍্য দিকে আত্মারাম জমিদার হলেও তাঁর প্রতিপত্তি রমাকান্তের মতো  ছিল না । ফলে তিনি এই বিয়েতে সম্মতি জানান। তবে নাটোরের জমিদারের কাছে ভবানী তিনটি শর্ত রেখেছিলেন। এক, বিয়ের পর তাঁকে একবছর পিতৃগৃহে থাকতে দিতে হবে। দুই, এলাকার দরিদ্র মানুষদের জমিদান করতে হবে। তিন, বাবার জমিদারি ছাতিয়ানা থেকে নাটোর অবধি রাস্তা বানিয়ে তা লালশালু দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, যার উপর দিয়ে তিনি শ্বশুরবাড়ি যাবেন । বলা বাহুল্য, রমাকান্ত এই তিনটি শর্ত‌ই মেনে নিয়েছিলেন।

মুর্শিদকুলী খাঁয়ের সময় রাজশাহী জমিদারির পত্তন হয়। রাজশাহী জমিদারির আদিপুরুষ ছিলেন জনৈক কামদেব রায়। তিনি ছিলেন পুঠিয়ার জমিদার দর্পনারায়ণের অধীন লস্করপুকুর পরগনার অন্তর্গত বরাইহাটির তহসিলদার। কামদেবের তিনপুত্র রামজীবন, রঘুনন্দন ও বিষ্ণুরাম– এর মধ‍্যে রঘুনন্দন ছিলেন সর্বাপেক্ষা সম্ভবনাময় ও উদ‍্যমী পুরুষ। যদিও রঘুনন্দনের উত্থানের পিছনে জমিদার দর্পনারায়ণ এবং নবাব মুর্শিদকুলী খাঁয়ের যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা ছিল। পুঠিয়ার জমিদার জাহাঙ্গীরনগরে (বর্তমানে ঢাকা) নিজের প্রতিনিধি হিসাবে রঘুনন্দনকে নিযুক্ত করেন। ঢাকায় সেইসময় বাংলার নবাবের সঙ্গে সুবাহদার আজিম-উস-শানের বিবাদ চলছিল। রঘুনন্দন নবাবের পক্ষ নিলে তিনি তাঁর বিশেষ বিশ্বাসভাজনে পরিণত হন। ১৭০৬ সালে রঘুনন্দন প্রথম নিজের ভাই রামজীবনের নামে রাজশাহীতে একটি জমিদারির বন্দোবস্ত করাতে সক্ষম হন। এরপর আর এই পরিবারকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রশাসনিক দক্ষতা এবং বিচক্ষণতার জন‍্য একের পর এক অংশ রাজশাহী জমিদারির সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। ক্রমে রামজীবন এক বিশাল এলাকার জমিদার হয়ে ওঠেন। বলো হতো, বর্ধমান জমিদারির পর দ্বিতীয় বৃহৎ জমিদারি ছিল রাজশাহীর। শোনা যায়, এই জমিদারির আয় ছিল ৫২ লক্ষ টাকা।

আরও পড়ুন- অবাক করা এই দুই চিড়িয়াখানা চিরতরে হারিয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ থেকে

১৭২৪ সালে রঘুনন্দন অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। ১৭৩০সালে রামজীবন‌ও পরলোক গমন করেন। রামজীবনের মৃত‍্যুর আগেই তিনি রমাকান্তকে দত্তক নেন এবং সমস্ত জমিদারি তাঁর নামে লিখে দিয়ে যান। মাত্র ১৮বছর বয়সে রামকান্ত রাজশাহীর জমিদারি লাভ করেন। রমাকান্ত জমিদার হলেও তিনি ছিলেন ধার্মিক প্রকৃতির মানুষ। তাই বিবাহের পর রাজশাহীর জমিদারি সামলাতেন রানি ভবানী, তাঁকে সাহায‍্য করত বিশ্বস্ত এবং দক্ষ দেওয়ান দয়ারাম।  রমাকান্তের জমিদারিকালীন বিঘ্ন ঘটায় রামজীবনের ছোট ভাই বিষ্ণুরামের পুত্র দেবীরাম। এই চক্রান্তের জন‍্য রমাকান্ত কিছুদিন জমিদারিচ‍্যুত‌ও হয়েছিলেন। অবশেষে দয়ারামের প্রচেষ্টায় আলিবর্দী খানের দপ্তর থেকে জমিদারির সনদ ফিরিয়ে আনা হয়। ১৭৪৮ সালে রমাকান্তের জীবনাবসান ঘটে। রানি ভবানী তিন সন্তানের জন্ম দিলেও তাঁর দুই পুত্র সন্তান অতি শৈশবেই মারা যায়, এক কন‍্যা তারাসুন্দরী জীবিত ছিলেন । শোনা যায় তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লা তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। রমাকান্ত মৃত‍্যুর আগে ভবানীকে আদেশ দিয়ে যান এক পুত্র দত্তক নিতে। সেই মতো রমাকান্তের মৃত‍্যুর পর রানি পুত্র রামকৃষ্ণকে দত্তক নিয়েছিলেন।

১৭৪৮ সালে রাজশাহী জমিদারির সমুদয় কর্তৃত্বের অধিকারী হন রানি ভবানী। তিনি যখন জমিদারির সিংহাসনে বসেন সেইসময় এবং তার আগের কিছু সময় ধরে সমগ্ৰ ভারত তথা বাংলার রাজনীতি বিশেষ টালমাটাল অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল। এইসময় তাঁর জমিদারি সন্নিহিত এলাকায় ঘটতে থাকে ইতিহাসের পালাবদলের ঘটনা। ১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেবের মৃত‍্যুর পর দিল্লি সাম্রাজ্যের পতন ঘটতে শুরু হয়। এইসময় দিল্লির মসনদ নিয়ে যেমন দিল্লিতে দ্বন্দ্ব সংঘাত দেখা যায়, অন‍্যদিকে বাংলার রাজনীতিতেও চরম অস্থিরতা দেখা যায়। শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। সুতানুটিসহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে অবৈধভাবে জমিদাররা জমি দখল করে কুঠি নির্মাণ করছিলেন। অন‍্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেশে অবাধ বাণিজ‍্য শুরু করে। দিল্লি থেকে নিত‍্যনতুন ফরমান নিয়ে এসে তারা তার প্রয়োগ ঘটাতে থাকে বাংলায়। এসময় বাংলায় উত্তর প্রান্তে শুরু হয় মারাঠা আক্রমণ, আবার দক্ষিণ পূর্বাংশে চলেছিল ফিরিঙ্গি ও মগধের জলদস‍্যুতা। বাংলা যে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, একথা বলার অবকাশ থাকে না। এইরকম প্রতিকূল এক পরিস্থিতির মধ‍্যেও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চার দশক জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন।

আরও পড়ুন- কেন ইনকিলাব ধ্বনি দিচ্ছেন ইরানের মেয়েরা! কীভাবে পাড়ি দিল ভগতের স্লোগান

 এক বিশাল সম্পত্তির মালিকানা তাঁর হলেও রানি ভবানী কিন্তু অতি অনাড়ম্বর জীবনযাপনে বিশ্বাসী ছিলেন। দান আর ভালোবাসা এই মন্ত্রেই তিনি প্রজাদের মধ‍্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনি বাংলায় শত শত মন্দির, চিকিৎসালয়, সরাইখানা, অতিথিশালা নির্মাণ করেন। প্রজাদের জলের কষ্ট দূর করার জন‍্য তিনি অসংখ‍্য পুকুর ও দিঘি খনন করেন। দাতব‍্য চিকিৎসালয় এবং অবলা পশুপাখিদের সুরক্ষার জন‍্য তিনি মুক্ত হস্তে দান করে গেছেন।

১৭৫৩ সালে তিনি ভারতের বেনারসে একটি শিবমন্দির স্থাপন করেন। তিনি কাশীতে ভবানীশ্বর শিব ও দুর্গাবাড়ি, দুর্গাকুণ্ড, কুরুক্ষেত্রতলা নামক জলাশয় খনন করেন। বাংলার তীর্থযাত্রীদের কথা ভেবে হাওড়া থেকে কাশী অবধি সড়কপথ নির্মাণ করেন । যা ভবানী রোড এবং পরবর্তীতে বেনারস রোড নামে বিখ‍্যাত ছিল। বর্তমানে এটি বম্বে রোডের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও মুর্শিদাবাদের নিকট ভাগীরথী নদী তীরবর্তী অঞ্চলে তিনি ১০০টি শিবমন্দির নির্মাণ করেছিলেন যা কালের প্রবাহে ধ্বংসপ্রায়। তিনি নাটোর থেকে ভ‌ওয়ানিপুর পর্যন্ত ‘রানি ভবানীর জঙ্গল’ নামে একটি রাস্তা নির্মাণ করেন। এই সমস্ত কাজের জন‍্য প্রজারা তাঁকে মহারানি ভবানী তকমায় ভূষিত করে। পলাশির যুদ্ধের সময় তিনি কোম্পানির বিপক্ষে লড়বার জন‍্য সিরাজদৌল্লাকে সৈন‍্য প্রেরণ করেছিলেন। হল‌ওয়েলের লেখা জানা যায়, তিনি নবাবের কোষাগারে বার্ষিক প্রায় ৭০ লক্ষ সিক্কা রূপি রাজস্ব দিতেন। দিল্লির কাছে থেকে ১৭৬৫সালে কোম্পানি বাংলার রাজস্ব আদায়ের দেওয়ানি লাভ করলে তারাও রাজশাহী জমিদারির প্রতিপত্তি সম্পর্কে অবগত হয় এবং জমিদারিতে কোনওরকম হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে। ব্রিটিশ গবেষক ও সার্ভেয়ার ও’ম‍্যালি জানিয়েছেন, রানি ভবানী মোট ৩৮০টি প্রার্থনালয়, অতিথিশালা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কোম্পানির আমলে উত্তরবঙ্গে রেল যোগাযোগ বাস্তবায়নে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্রাহ্মণদের তিনি জমি দান করেছিলেন।

১৭৮৮ সালে চল্লিশ বছরের রামকৃষ্ণকে তিনি জমিদারি হস্তান্তর করে মুর্শিদাবাদে চলে আসেন এবং কন‍্যাসহ বড়নগরে বাস করতে থাকেন। ১৭৯৫ সালে ৭৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত‍্যু হয়।

 

তথ্য সূত্রঃ  

 

More Articles