বিভীষিকার অভিজ্ঞতা, আর্তদের হাহাকার আর ভোপাল দুর্ঘটনাঃ ইতিহাসের ট্রাজেডি

সাক্ষর সেনগুপ্ত : প্রায় ৩৭ বছর আগের ঘটনা। কিন্তু এখনও যেন বিভীষিকার সেই অভিজ্ঞতা চেষ্টা করেও পুরোপুরি ভুলতে পারেননি সেই সময় আজকাল পত্রিকার রিপোর্টার অধুনা আনন্দবাজারের প্রাক্তন বার্তা সম্পাদক রজত রায়। আজও পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহ শিল্পদূষণের জেরে দুর্ঘটনার নিরিখে অবশ্যই প্রথম সারিতে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা। ১৯৮৪ সালের ৩ ডিসেম্বর ইউনিয়ন কার্বাইডের কারখানা থেকে বিষাক্ত গ্যাস মিশে যায় বাতাসে। রাসায়নিক ফ্যাক্টরির প্ল্যান্ট নাম্বার সি’ থেকে গ্যাস লিক করে ৷ দ্রুত হাজার হাজার মানুষ ভয়ঙ্কর শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের আইএলও-এর এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে অন্তত ৪০ টন মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস বাতাসে মিশে গিয়েছিল ইউনিয়ন কার্বাইডের রাসায়নিক কারখানা থেকে। প্রায় ৬ লক্ষেরও বেশি কর্মী স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।

দুর্ঘটনার পর যে তদন্ত হয়েছিল তাতে জানা যায়, ২ ডিসেম্বর রাতে কারখানার ‘সি প্ল্যান্ট’-এ সঞ্চিত মিথাইল আইসোসায়ানেটের ৬১০ নম্বর ট্যাঙ্কে কোনও ভাবে জল মিশে যায়। তাপদায়ী বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস। যার ফলে তৈরি হওয়া ভয়ঙ্কর তাপ ও চাপে ট্যাঙ্ক খুলে প্রায় ৪০ মেট্রিক টন মারণ মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। এজন্য চূড়ান্ত বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, মনে করেন রসায়নবিদ্যায় গবেষক সিদ্ধার্থ রায়। হয়েছিলও তাই। চোখজ্বালা, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের প্রদাহে আক্রান্ত হন প্রায় সাড়ে আট লাখ জনবসতির ভোপালের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। বাতাসে মিথাইল আইসোসায়ানেটের ০.৪ পিপিএম (পার্ট পার মিলিয়ন)-এর উপস্থিতিই বিপজ্জনক। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের রসায়নবিদ্যার শিক্ষক সিদ্ধার্থবাবুর মতে, তা ২১ পিপিএম এ পৌঁছলে মৃত্যু অনিবার্য। ভোপালে এর মাত্রা পৌঁছেছিল তারও কয়েক গুণ বেশি। তাই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অসহনীয় কষ্ট নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন প্রায় তিন হাজার মানুষ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভোপাল গ্যাসকাণ্ডে মোট মৃতের সংখ্যা ৩,৭৮৭, শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ৫,৫৮,১২৫ জন। যার মধ্যে ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হন ৩,৯০০ জন। তবে ভোপাল গ্যাসকাণ্ডের দুর্গতদের পক্ষে আন্দোলনকারীদের দাবি, অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা আট থেকে দশ হাজার।

বিভীষিকার অভিজ্ঞতা, আর্তদের হাহাকার আর ভোপাল দুর্ঘটনাঃ ইতিহাসের ট্রাজেডি

চিত্রঋণ : Google

২০০৬ সালে একটি হলফ নামায় তৎকালীন মধ্যপ্রদেশ সরকার জানায়, গ্যাস লিকের কারণে ৫ লক্ষ ৫৮ হাজার ১২৫ জন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন ৷ যার মধ্যে ৩৯০০ জন আংশিক ও পুরোপুরিভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যান ৷ গ্যাস লিকের কয়েক ঘণ্টার পরই শহরে যেন মৃত্যু নগরীতে পরিণত হতে থাকে ৷ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য অসংখ্য্ মানুষের ভিড় জমে যায় ৷ শ্বাসকষ্ট, চোখ ও ত্বকের সমস্যা, বুকের জ্বালায় অসহনীিয় কষ্টে স্থানীয় বাসিন্দার ছটফট করতে থাকেন ৷ আজকালের তরফে ঘটনাস্থলে ৫ ডিসেম্বর গিয়ে পৌঁছান রিপোর্টার রজত রায়। তিনি জানাচ্ছেন, চিকিৎসকরা প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি এই অসহনীয় কষ্টের কারণ। রাজধানীর দুটি সরকারি হাসপাতালে প্রথম দু’দিনে ৫০ হাজার মানুষ ভর্তি হন৷ পরে সরকারের তরফ থেকে দূর্ঘটনায় মৃত ও আহতদের পরিবারকে মোট ৭১৫ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। আর দেশের শীর্ষ আদালতের রায়ে ইউনিয়ন কার্বাইডকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয় ৪৭০ মিলিয়ন ডলার। ভোপাল কাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, মৃত ও ক্ষতিগ্রস্থদের বিপর্যয়ের অনুপাতে ওই ক্ষতিপূরণ কিছুই নয়।

দুর্ঘটনার অভিঘাতের বিচারে হয়তো চেরনোবিল কাণ্ড অনেক উপরে, কিন্তু মৃত ও আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের বিষয়ে ভোপাল বিপর্যয়ের নীচে চলে যাবে চেরনোবিল। জানালেন ভোপাল দুর্ঘটনার পর থেকেই ক্ষতিগ্রস্থদের পক্ষে সরব হওয়া পরিবেশ আন্দোলনকারী নব দত্ত। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্ণধার নববাবু জানালেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও অনেকেই উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবিতে মামলা করেন। যার ফলে দুর্ঘটনার ৩৫ বছর পরেও ২০১৯ সাল পর্যন্ত আদালতের চৌহদ্দিতে থাকে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা। তাঁর অভিযোগ, এত বড় বিপর্যয়, কিন্তু ইউনিয়ন কার্বাইডের একজনও শীর্ষস্থানীয় কর্তা ওই ঘটনায় গ্রেফতার হননি। বিবিসি-র প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইউনিয়ন কার্বাইডের কোনও শীর্ষ কর্তাব্যক্তিকে ভূপালের ওই ঘটনার জন্য বিচারের কাঠগড়ায় তোলা যায়নি। সংস্থার তৎকালীন চেয়ারম্যান, ওয়ারেন অ্যান্ডারসন, দুর্ঘটনার কয়েকদিন পরই কারখানা দেখতে ভূপালে গেলে তাকে ভারতীয় পুলিশ গ্রেফতার করে, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি জামিন পেয়ে যান, এবং তড়িঘড়ি ভারত ত্যাগ করেন। তাঁকে সরকারিভাবে 'পলাতক' ঘোষণা করা হয়। তবে ভারত সরকার তাঁকে বিচারের জন্য ভারতে পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্রের উপর কখনও যথাযথভাবে চাপ দেয় নি। 

বিভীষিকার অভিজ্ঞতা, আর্তদের হাহাকার আর ভোপাল দুর্ঘটনাঃ ইতিহাসের ট্রাজেডি

চিত্রঋণ : Google

নববাবু জানিয়েছেন, পরবর্তীতে তদন্ত রিপোর্টে এই গ্যাস দূর্ঘটনায় প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষের প্রচুর গাফিলতি ধরা পড়ে ৷ জানা যায়, প্ল্যান্টের অ্যালার্ম সিস্টেম ঘণ্টার পর ঘণ্টা অকেজো হয়ে পড়েছিল ৷ ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষ সবকিছু জেনেও কোন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেননি ৷ এও জানা যায়, বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে উদাসীনতা আর অসতর্কতা এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। যেমন, ছোট ছোট ড্রামের বদলে রাসায়নিক রাখা হত বড় বড় ট্যাঙ্কে। ক্ষয়ে যাচ্ছিল পাইপলাইনও। ঘাটতি ছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং বিপর্যয় মোকাবিলার পরিচালন ব্যবস্থাতেও। ওই ঘটনার পর একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল, ১৯১৯ পরবর্তী সময়ে গত ১০০ বছরে শিল্পদূষণের ফলে হওয়া প্রধানতম দুর্ঘটনার অন্যতম ভোপাল গ্যাস কাণ্ড। গত তিন দশকেরও বেশি হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর বিচার চেয়ে প্রতিবাদে পথে নেমেছেন বহু সমাজকর্মী। তাঁদের আরও অভিযোগ ছিল বহু শিশু ওই গ্যাস দুর্ঘটনার কারণে আজও জন্মানোর সময় জন্মগত ত্রুটি, সেরিব্রাল পালসি এমনতী ক্যানসার নিয়েও জন্মায়। মারণ গ্যাস থেকে রেহাই পায়নি গর্ভস্থ সন্তানেরা। গর্ভাবস্থায়ই শতকরা ৪৩ জন মায়ের সন্তান মারা যায়, ঘটে গর্ভপাতও। যারা পৃথিবীর মুখ দেখতে পেয়েছিল তাদের শতকরা ১৪ জনের মৃত্যু হয় জন্মের এক মাসের মধ্যে। মারা যায় হাজার হাজার পশুপাখি, পাতাহীন হয়ে পড়ে গাছেরা, হলুদ হয়ে যায় ঘাস, জল দূষিত হয়ে পড়ে।

কারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল ওই দুর্ঘটনায় ? ভোপাল কাণ্ডের পনেরো বছর পরে ২০১০ সালে মধ্যপ্রদেশের এক আদালতে ইউনিয়ন কার্বাইডের আটজন সাধারণ কর্মচারীদের দুই বছরের জন্য কারাবাস ও এক লাখ টাকা জরিমানা ধার্য করে। আর হবে নাই বা কেন ? ১৯৮৯ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টে ইউনিয়ন কার্বাইড কর্তৃপক্ষ জানায়, এই গোটা বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কিছু অসন্তুষ্ট কর্মচারীর অন্তর্ঘাত। অর্থাৎ ওই কর্মীরা অন্তর্ঘাত করলেন আর কর্তৃপক্ষ তাঁর কোনও ইঙ্গিতই টের পেলেন না। দীর্ঘদিন যাবৎ ভোপাল কাণ্ড বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায় থেকে নাগরিক আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকা ডাঃ পুন্যব্রত গুনের মত ব্যক্তিত্বরা যাকে মনে করেন, ইতিহাসের ট্রাজেডি।

বিশেষজ্ঞদের যাবতীয় বক্তব্য প্রতিবেদকের নেওয়া

More Articles