ছয় আনা গ্রন্থাবলী সিরিজেই কলমে ছবি আঁকা শুরু পথের পাঁচালী, আরণ্যকের স্রষ্টার
সাক্ষর সেনগুপ্ত: প্রথম দু’দিন স্কুল কম্পাউন্ড পর্যন্ত গিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল একরত্তি ছেলেটি। ভয়ে, দ্বিধায় ভিতরে যাওয়ার মত মনের জোর পায়নি। লক্ষীর ঝাঁপি থেকে মায়ের দেওয়া সিঁদুর মাখানো টাকা মুঠোয় নিয়ে তৃতীয় দিনও কম্পাউন্ডের বাইরে থেকেই চলে আসছিল। কিন্তু ওইদিন তাকে ডেকে পাঠান প্রধান শিক্ষক। সিঁদুর মাখানো টাকা দেখে আসল ঘটনা জানতে চান এবং জানার পরে, ছাত্রের বেতন মাফ করে দেন। কোনও এক ইংরেজি বছরের মাঝামাঝি ওই ছাত্র ভর্তি হল স্থানীয় বনগ্রাম উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ে। প্রধান শিক্ষক চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কড়া নজরদারিতে পড়াশোনা চলতে থাকে। তার আগে বাবার কাছে পড়াশোনা থেকে হরি রায়ের পাঠশালা, অবশেষে পিতৃদেব মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতা বাসের কালে বৌবাজারের আরপুলি লেনের পাঠশালা— এত দীর্ঘ পথে শেষ হয় বিভূতিভূষণের প্রাথমিক শিক্ষা।
প্রবল অভাবের সংসারে ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করার আশা পোষণ করতেন না মা মৃণালিনী দেবী। এদিকে ছোট্ট বিভূতি দেখত, প্রতিবেশীর ছেলেরা বনগ্রামে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়। তারও খুব ইচ্ছে হল। অবশেষে দ্বিধা কাটিয়ে স্কুল কম্পাউন্ড চত্বরে রোজ হাজিরা দেওয়া, বাকিটা তো গল্পের মত। তাঁর যখন ক্লাস এইট, প্রয়াত হন মহানন্দ। সংসারের সব দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন বিভূতিভূষণ। ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টম্বর অবিভক্ত চবিবশ পরগনা জেলার কাঁচরাপাড়া নিকটবর্তী ঘোষপাড়া-মুরারিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবাস ওই জেলার ব্যারাকপুর গ্রামে। পিতৃদেব ছিলেন সংস্কৃত পন্ডিত, এজন্য পাঁচ বছর বয়স থেকেই বাবার কাছে সংস্কৃত এবং মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ পাঠ।
বরাবরই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এন্ট্রান্স (১৯১৪) ও আইএ (১৯১৬) পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ১৯১৮ সালে রিপন কলেজ থেকে ডিসটিংশন নিয়ে বিএ পরীক্ষায় পাশ করেন বিভূতিভূষণ। তার পরে কিছু দিন এমএ এবং ল ক্লাসে পড়েছিলেন। আইন পড়ার সময়ে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল নীরদচন্দ্র চৌধুরীর। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময়ে বসিরহাটের বাসিন্দা গৌরীদেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই বিসূচিকা রোগে মারা যান গৌরীদেবী। বিভূতিভূষণেরও পড়াশোনায় ইতি ঘটে। হুগলির জাঙ্গিপাড়ার মাইনর স্কুলে শিক্ষকের চাকরি নেন। পরে জাঙ্গিপাড়া থেকে সোনারপুরের হরিনাভি। কাজের সূত্রে অবশ্য ভুবনডাঙার নানা প্রান্তে বিভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতাই পেয়েছেন এই কালজয়ী কথাসাহিত্যিক। কিছুদিন তিনি ‘গোরক্ষিণী সভা’র ভ্রাম্যমাণ প্রচারক হিসেবে বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চল গিয়েছেন। পরে প্রখ্যাত ধনী খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে সেক্রেটারি ও গৃহশিক্ষক এবং তাঁর এস্টেটের ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজার হন। পরে শহর কলকাতার ধর্মতলায় খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর তিনি গোপালনগর স্কুলে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু সেখানেই কর্মরত ছিলেন।

ছবি সৌজন্যে : Google
অবশ্য সাহিত্যিক হয়ে ওঠার শুরুটা হরিনাভিতেই। ১৯২০ সালের জুন মাসে হরিনাভির দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ অ্যাংলো সংস্কৃত বিদ্যালয়ে পড়ানোর কাজে যোগ দিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। সেখানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বন্ধু ‘বালক-কবি’ পাঁচুগোপাল ওরফে যতীন্দ্রমোহন রায়ের। সে সময়ে কলকাতার এক প্রকাশক ‘ছয় আনা গ্রন্থাবলী’ নামে এক সিরিজ বার করত। তাদের গ্রন্থাবলি প্রকাশ শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা দিয়ে। স্থানীয় লাইব্রেরি থেকে তেমনই একটি বই বিভূতিভূষণকে দিয়ে যতীন্দ্রমোহন প্রস্তাব করেছিলেন— ‘‘আসুন আপনাতে আমাতে এইরকম একটা উপন্যাস সিরিজ বের করা যাক।’’ তার পরে বিভূতিভূষণের নামে স্কুলের নোটিস বোর্ড, দেওয়াল, নারকেল গাছের গায়ে পোস্টার পড়ল। বাধ্য হয়ে গল্প লিখলেন বিভূতিভূষণ— ‘পূজনীয়া’। সে নামে অবশ্য বেরোয়নি। প্রকাশিত হয়েছিল ‘উপেক্ষিতা’ নামে। সে-ই হল লেখার শুরু। তার পর আর কলম থামেনি। দু’চোখ ভরে আরণ্যকের আশ্চর্য্য মায়াবী আলোয় চরাচরকে দুচোখ ভরে দেখেছেন। তেপান্তরের পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছেন। এবং লিখেছেন পথের পাঁচালী থেকে অশনি সংকেত। ভাগলপুরে চাকরি করার সময় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি পথের পাঁচালী রচনা শুরু করেন এবং শেষ করেন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিগুলির মধ্যে অপরাজিত, চাঁদের পাহাড়, আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, অশনি সংকেত, ইছামতী অবশ্যই চিরস্মরণীয়।
বিভূতিভূষণের বোন জাহ্নবীদেবী মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরের সূত্রেই আলাপ হয় ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কন্যা রমাদেবীর সঙ্গে। পরে ২৯ বছরের ছোট রমাদেবীর আগ্রহে ও প্রবল ইচ্ছায় ১৯৪০ সালের ৩ ডিসেম্বর সম্পন্ন হয়েছিল শুভবিবাহ। সাত বছর পরে জন্ম হল পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
প্রিয় ফল ছিল আম আর কাঁঠাল। ভালবাসতেন চাঁপা, বকুল, শেফালি ফুল। বন্য ফুলের মধ্যে পছন্দ ছিল ঘেঁটু আর ছোট এড়াঞ্চি। ঋজু বনস্পতিতেও আকর্ষণ ছিল তাঁর। সাহিত্য ছাড়াও পড়তেন জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান আর উদ্ভিদবিদ্যা। শেষ জীবনে নাকি পরলোকতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন। তাই সারা বাড়িতে বইপত্র ছড়ানো থাকত। আলমারিতে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন না। দৈনন্দিন রুটিন ছিল এরকম। খুব ভোরে ঘুম থেকে উছঠে স্নান করতে যেতেন ইছামতীতে। ফিরে লিখতে বসতেন। প্রথমে দিনলিপি। তার পর চিঠিপত্রের উত্তর। ৭টা নাগাদ প্রাতরাশ। ৯টা নাগাদ স্কুলের পথে যাত্রা। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে জলযোগ। ইছামতী অথবা বাওড়ের ধারে শক্তপোক্ত গাছের ডালের উপরে গিয়ে বসতেন। খানিক বাদে আবার পড়ানো। প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে আসত তাঁর কাছে। পড়াতেন, গল্প বলতেন। রাতের খাওয়ার পরে কোনও কোনও দিন আড্ডা দিতে বাইরে যেতেন। বাড়ি ফিরতে হয়তো একটা বেজে যেত। আর এই পুরো সময়টাই প্রকৃতিকে নিরীক্ষণ করতেন।
পুজোর কয়েক দিন আগে ঘাটশিলা চলে যেতেন বিভূতিভূষণ। ফিরতেন মাঘের শেষে অথবা ফাল্গুনের গোড়ায়। পরে ঘাটশিলায় একটি বাড়ি কেনেন, গৌরীদেবীর নামে নাম দেন ‘গৌরীকুঞ্জ’। ১৯৪২ সালে ব্যারাকপুরে পুরোদস্তুর সংসারি হওয়ার পরেও ঘাটশিলায় গিয়ে মাসকয়েকের অবসর যাপন চলত। বছরের এই সময়ে সেখানে যেতেন তাঁর সাহিত্যিক বন্ধুরা। প্রমথনাথ বিশী, বিশ্বপতি চৌধুরী, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, প্রবোধকুমার সান্যালদেরও ছুটিটা ঘাটশিলাতেই কাটত। ফলে আড্ডা জমত। আর চলত প্রকৃতি দেখা। ফুলডুংরি পাহাড়ের পিছনে একটি পাথরের উপরে বসে উপাসনা করতেন তিনি। বাড়ির সামনেও তেমন একটা পাথরখণ্ড ছিল। কূর্মাকৃতি বলে বিভূতিভূষণ নাম দিয়েছিলেন, ‘কূর্মকূট’। ঘাটশিলা তাঁর এতই পছন্দ হয়েছিল যে গজেন্দ্রকুমার মিত্র, সুমথনাথ ঘোষ এবং বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়কে সেখানে বাড়ি কিনিয়েছিলেন।
সম্ভবত তাঁর "দেবযান" উপন্যাসে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, ‘‘অরণ্যই ভারতের আসল রূপ, সভ্যতার জন্ম হয়েছে এই অরণ্য-শান্তির মধ্যে, বেদ, আরণ্যক, উপনিষদ জন্ম নিয়েছে এখানে— এই সমাহিত স্তব্ধতায়— নগরীর কোলাহলের মধ্যে নয়।’’ ঠিক এতটাই দূরদৃষ্টি ছিল তাঁর। হয়তো সেজন্যই এইচএইচ জনস্টন, রোসিটা ফোর্বস-এর মতো কয়েক জন বিখ্যাত পর্যটকের বই পড়ে আফ্রিকার ভূপ্রকৃতি নিখুঁত বর্ণনায় সাজিয়েছিলেন ‘চাঁদের পাহাড়’। আসলে প্রায় উপাসকের মতই ত্যাগ-তিতিক্ষার আবেগপূর্ণ আবেদনকে পাথেয় করে লিখতেন বিভূতিভূষণ। জীবনের প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। শেষ দশ বছর, ব্যারাকপুরে থাকাকালীন লিখেছেন ‘অশনি সংকেত’ বা ‘ইছামতী’র মতো কালজয়ী উপন্যাস। মৃত্যুর ঠিক পাঁচ-সাত দিন আগে পুজোর ছুটিতে শেষ করেছিলেন জীবনের শেষ গল্প ‘শেষ লেখা’। পরে বিভূতিভূষণের লেখার বাক্স থেকে উদ্ধার হয়েছিল কথাসাহিত্যিকের সেই অমূল্য রচনা।
তথ্যসূত্র: বিভূতি-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড), আমাদের বিভূতিভূষণ: রমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৌসুমী পালিত, বিভূতিভূষণের অপ্রকাশিত দিনলিপি: সুনীলকুমার চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদিত)