উড়ন্ত গোল করতে করতেই মারাত্মক সংঘর্ষ, বাইসাইকেল কিক কেড়েছিল ফুটবলারের প্রাণ

History of Football Bicycle Kick : চিলের তালকাহুয়ানো বন্দরের মাঠে রামোন উনসাগা বল নিয়ে এই কসরতের আবিষ্কর্তা।

অলিম্পিক গোল

১৯২৪-এর অলিম্পিকে সোনা জিতে দেশে ফেরার পর উরুগুয়েকে একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে ডাকে আরহেন্তিনা। বন্ধুত্বের খুব একটা অবকাশ অবিশ্যি ছিল না, কার্যত চ্যালেঞ্জই ছিল। খেলা হয়েছিল বুয়েনস আইরেসে, উরুগুয়ে সেদিন ১-০ হারে। লেফট উইং সেসারিয়ো ওনসারি সেই ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেছিল। সেদিন ওনসারির নেওয়া একটা কর্নার কিক ইতিহাস হয়ে আছে। বলটা কাউকে না ছুঁয়ে সোজা নেটে জড়িয়ে যায়। ফুটবলের ইতিহাসে এর আগে এরকম গোল কখনও হয়নি। এমন বেমক্কা একটা গোল খেয়ে উরুগুয়ের খেলোয়াড়রা কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। জিভে সাড় ফিরে পেতেই তারা আপত্তি শুরু করে। তাদের দাবি, বল যখন হাওয়ায় ভাসছিল তখন গোলকিপার মাসালিকে ধাক্কা মারা হয়েছে। কিন্তু রেফারি সেকথায় কর্ণপাত করেনি। তারা ফের রেফারিকে ঘিরে হল্লাহাটি শুরু করে বোঝাতে যায় যে, ওনসারি আদপেই গোলে বল ঢোকাতে চায়নি, ওটা হাওয়ার কেরামতিতেই হয়েছে।

শ্রদ্ধাবশতই হোক বা ব্যজস্তুতিতে, সেদিনের পর থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় এই বিরল ধরনের গোলকে ‘অলিম্পিক গোল’ বলে। এখনও এমন গোল কালেভদ্রেই হয়। ওনসারি ওই গোলটা করার পর যতদিন বেঁচেছিল সবাইকে কেবল বুঝিয়েই গেছে যে গোলটা ফাঁকতালে পড়ে পাওয়া ছিল না। তারপর কতগুলো বছর কেটে গেছে মনে মনে হিসেব করে দেখুন, মানুষের অবিশ্বাস কিন্তু এখনও একই মাত্রায় থেকে গেছে। যতবার কর্নার ফ্ল্যাগের সামনে বল বসিয়ে খেলোয়াড়েরা বাঁকানো শট জালে জড়িয়ে দিয়েছে, মাঝে কাউকে বলটি ছুঁতেও হয়নি, ততবার ওই অসামান্য দৃশ্যে দর্শকে উল্লসিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি।

পিয়েনদিবেনের গোল

হোসে পিয়েনদিবেনে ১৯২৬ সালে একবার গোল করেও কোনও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি। পিয়েনদিবেনের মতো দুর্দান্ত ফুটবলার খুব কমই দেখা যায়, তার চেয়েও বিরল ছিল মানুষটির বিনয়ী স্বভাব। অন্যে যদি মনে আঘাত পায়, এই ভেবেই সে জীবনে কখনও গোলের পর উচ্ছ্বাস করেনি। উরুগুয়ের পেনারল একবার মন্তেভেদিয়োতে বার্সেলোনার এস্পানোল ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলছিল। গোলে দাঁড়িয়েছিল সামোরা, ফলে বারবার মাথা খুঁড়ে মরলেও পেনারল গোলের দরজা খুলতে পারছিল না। এমন সময় পিছন দিক থেকে খেলা তৈরি হল। এস্পানোলের দুই খেলোয়াড়ের সামনে ঘাসের উপর হড়কে এসে আনসেলমো কোণাকুনি পাস বাড়াল সাফিয়াতিকে, তারপর অপেক্ষা করতে থাকল ফিরতি পাসটা পাওয়ার জন্য। কিন্তু পিয়েনদিবেনে বলটা চেয়ে নিল। বলটা ধরেই উরকিসুকে কাটিয়ে সে একেবারে গোলের সামনে চলে আসে। সামোরা দেখে পিয়েনদিবেনে ডানদিকের কোণে মারতে যাচ্ছে, তাই সে স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে ওদিকে চলে যায়। কিন্তু বল তখনও পিয়েনদিবেনের পায়েই ঘুমিয়ে আছে, শেষ পর্যন্ত পায়ের পাতার আলতো টোকায় পিয়েনদিবেনে বাঁ দিকের ফাঁকায় বলটা ঠেলে দেয়। সামোরা বেড়ালের ক্ষিপ্রতায় ফের বাঁ দিকে ঝাঁপায়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বল তার আঙুল ছুঁয়ে জালে জড়িয়ে যায়।

আরও পড়ুন- এক হাতে রিভলবার, অন্য হাতে চিঠি! মাঝমাঠেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন ফুটবলার

বাইসাইকেল কিক

চিলের তালকাহুয়ানো বন্দরের মাঠে রামোন উনসাগা বল নিয়ে এই কসরতের আবিষ্কর্তা। শরীর শূন্যে ভাসিয়ে রেখে, পিঠটা মাটির দিকে, আচমকা পায়ের চেটো দিয়ে শট নেওয়া ঠিক যেন কাঁচির ধারালো ফলার মতো।

১৯২৭-এ চিলের কোলো-কোলো ক্লাব ইওরোপ সফরে যায়। ওদের স্ট্রাইকার দাভিদ অরেলিয়ানো হিস্পানি দেশের স্টেডিয়ামগুলোয় যখন একের পর এক দড়বাজিকরের মতো আশ্চর্য সক্ষমতায় বাইসাইকেল কিক মারতে থাকে, তখন লোকমুখে এটা চিলের খেলোয়াড়দের কেতা বলে চালু হয়ে যায়। সাংবাদিকেরা মুগ্ধ হয়ে যায় লাফিয়ে মারা এই আশ্চর্য শটের সৌন্দর্যে, তারা একে ‘চিলের শট’ ডাকনাম দিয়ে দেয়, ঠিক যেমন স্ট্রবেরি আর কোয়েকা নাচকে চিলের জিনিস বলা হয়। এমন বেশ কিছু উড়ন্ত গোল করতে করতে, সেই বছরই অরেলিয়ানো মারা যায়। বাইয়াদোলিদ স্টেডিয়ামে সেদিন খেলা চলছিল। বিপক্ষের ফুলব্যাকের সঙ্গে মারাত্মক সংঘর্ষে আহত হওয়ার পর তাকে কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

স্কারোনে

ব্রাজিলের পেলে বা কোচিনহোর (কুটিনহো) বছর চল্লিশ আগে, স্কারোনে আর সেআ প্রতিপক্ষের রক্ষণ চিরে ঢুকে পড়ত আঁকাবাঁকা পাস খেলত খেলতে। একে অপরের পায়ে পায়ে আগুপিছু করতে করতে সেই অতুলনীয় সব পাসের খেলা শেষ পর্যন্ত গোলে পৌঁছত। তুই-আমি, এদিকে এই কাছটায়-ডান পাশে রে, প্রশ্ন-উত্তর, উত্তর-প্রশ্ন। এক পলকের জন্য থমকে থেকে বল ফের নিজেদের পায়েই ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসত, যেন কোনও দেওয়ালে ধাক্কা খেল। রিভার প্লেটের দলগুলোর আক্রমণের এই শৈলীকে তখনকার দিনে সেজন্য বলা হতো ‘ওয়াল খেলা’।

হেকটর স্কারোনে অঞ্জলি দেওয়ার মতো উপরের দিকে বল ঠেলে আনত, গোলও করত দেদার। অনুশীলনের সময় তিরিশ মিটার দূর থেকে শট মেরে মেরে এন্তার বোতল ভেঙে ও নিজেকে ধারালো করে তুলেছিল। লম্বায় সে ছিল খানিক খাটো, কিন্তু হেড করার সময় লাফ মেরে অন্য সবার মাথার উপরে দিব্যি উঠে যেত। ও খুব ভালো করে জানত মাধ্যাকর্ষণের নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কীভাবে হাওয়ায় ভেসে থাকতে হয়। স্কারোনে বলের জন্য ঝাঁপাত, প্রতিপক্ষের সব বাধা টপকে গিয়ে গোলের দিকে মুখ ফেরাতে লাট্টুর মতো পাক খেত। তারপর, তখনও হয়তো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতেই, সে হেড করত।
সবাই তাকে বলত জাদুকর, সে মনে হয় টুপির তলা থেকেও গোল বের করে আনতে পারত! ট্যাঙ্গোর রাজা কার্লোস গারদেলের কথা মাথায় রেখে তাকে ‘ফুটবলের গারদেল’ও বলা হত। আর হবে নাই বা কেন, সে যখন খেলত তখন তার পায়ের ছন্দে যে স্বরলিপি ফুটে উঠত, তার ধারে কাছে কেউ কখনও ছিল না।

স্কারোনের গোল

ঘটনাটা ১৯২৮-এর অলিম্পিক ফাইনালের। উরুগুয়ে আর আরহেন্তিনার সেই ম্যাচ তখনও পর্যন্ত গোলশূন্য। হঠাৎ তারাহ্‌কোনির দিকে কোণাকুনি বল ঠেলে দিয়ে পিরিস নিজে এগিয়ে গেল পেনাল্টি বক্সের দিকে। বলটা যখন বোরহার কাছে পৌঁছল, বোরহা সেইসময় গোলের দিকে পিছন ফিরে আছে, সে হেড করে স্কারোনেকেই দেয়, কিন্তু চিৎকার করে বলে "আবে, হেকটর বলটা ধর"! সেই সুযোগে স্কারোনে উড়ন্ত অবস্থায় গোলে শট নেয়। আরহেন্তিনার গোলকিপার বোসিয়ো যতক্ষণে ঝাঁপায় ততক্ষণে খেল খতম। বল গোলে ঢুকে গেছে। এমন গোলার মতো শটে গোল হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বলটা জালে ধাক্কা খেয়ে ফের মাঠে ঢুকে আসে। উরুগুয়ের স্ট্রাইকার ফিগুয়েরোয়া তখন এগিয়ে গিয়ে ফের বাঁকানো শটে বলটাকে গোলে পাঠিয়ে শাস্তি দেয়। গোলের বাইরে বলটার বেরিয়ে আসা খুব খারাপ দেখাচ্ছিল।

আরও পড়ুন- মহিলাদের যাতে অসম্মান না হয়, তাই সর্বাঙ্গ ঢাকা জামা পরে মাঠে নামতেন ফুটবলাররা!

আধিদৈবিক শক্তি

উরুগুয়ের খেলোয়াড় আদেমার কানাভেসি নিজেকে অপয়া ভেবে বিরাট এক আত্মত্যাগ করে। দলের ভালোর জন্য আমস্টারডামে ’২৮-এর অলিম্পিকের ফাইনাল ম্যাচে সে নিজেকে দল থেকে স্বেচ্ছায় সরিয়ে নেয়। ফাইনালে উরুগুয়ের প্রতিপক্ষ ছিল আরহেন্তিনা। কিন্তু তার আগে যতবার কানাভেসি আরহেন্তিনার বিরুদ্ধে খেলেছে, উরুগুয়ে হেরেছে। এমনকী শেষ ম্যাচে সে একটা সেমসাইড গোলও করে বসে। ফাইনালের দিন খেলোয়াড়রা যখন টিম বাসে করে স্টেডিয়ামের দিকে যাচ্ছিল, তখন কানাভেসি চুপচাপ বাস থেকে নেমে যায়। আমস্টারডামে সেই ম্যাচে উরুগুয়েই জেতে।

আগের দিন কার্লোস গারদেল আরহেন্তিনার টিম হোটেলে গিয়ে খেলোয়াড়দের গান শুনিয়ে এসেছে। ওদের সাফল্য-কামনায় গারদেল ‘ড্যান্ডি’ বলে নতুন একটা ট্যাঙ্গো বানিয়ে শোনায়। দু'বছর পরে, ১৯৩০-এর বিশ্বকাপ ফাইনালের ঠিক আগে, আবারও একই ঘটনা ঘটল। গারদেল ফের ‘ড্যান্ডি’ গাইল আরহেন্তিনাকে তাতাতে, কিন্তু উরুগুয়ে আবারও ফাইনাল জিতল। অনেকেই তারপর গারদেলকে তেড়ে খিস্তি করেছিল, কেউ কেউ তো ওর কোনও দূর পূর্বপুরুষ কোনওকালে উরুগুয়েতে থাকত কিনা সে আলোচনাও শুরু করেছিল।

নোলোর গোল

সেটা ১৯২৯, আরহেন্তিনা খেলছিল প্যারাগুয়ের সঙ্গে। নোলো ফেরেইরা ডান দিক দিয়ে একেবারে পেছন থেকে বল নিয়ে উপরে উঠে আসে। সোজা রাস্তা তৈরি করে সে এগিয়ে চলে, পেছনে ছেড়ে যায় ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে যাওয়ার পর লাটাইয়ের সুতোর মতো নেতিয়ে পড়ে থাকা বিপক্ষের খেলোয়াড়দের। সে দৌড়েই চলে, যতক্ষণ না খেয়াল করে প্রতিপক্ষের গোটা রক্ষণ ভাগটা জমাট দেওয়ালের মতো সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। নোলো তখন কিছুক্ষণের জন্য থামে। নিজেরই এক পা থেকে অন্য পায়ে বলটা চালাচালি করে, ইনস্টেপ করে এ পা থেকে অন্য পায়ে নেয়, কিন্তু বল মাটিতে ঠেকে না। বিপক্ষের খেলোয়াড়রা এমন কাণ্ড দেখে কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে গিয়ে বলের পেন্ডুলামের দিকে তাকিয়ে থাকে। একবার ডানদিক থেকে বাঁ দিকে মাথা ঘোড়ায়, ফের বাঁ দিক থেকে ডান দিকে। সেদিন নোলো এমন আগুপিছুর খেলা প্রায় এক শতাব্দী ধরে চালিয়ে যায়, যতক্ষণ না দেওয়ালে একটা ছিদ্র আবিষ্কার করে বেদম জোরে শট নেয়, বলও দেওয়ালের ছিদ্র গলে জালে জড়িয়ে যায়।

ঘোড়সওয়ার পুলিশরাও ঘোড়া থেকে নেমে এসে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে যায়। সেদিন মাঠে কুড়ি হাজার দর্শক ছিল, কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন আরহেন্তিনার সবাই বলবে তারা নাকি সেদিন মাঠে ছিল!

 

More Articles