রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর স্বপ্ন বিশ্বভারতী

ভারত তৃতীয় বিশ্বের দেশ। আর্থসামাজিক দিকে তথাকথিত বড় দেশগুলির থেকে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও শিক্ষা এবং উন্নতির দিকে থেকে ভারত গোটা পৃথিবীকে এক হাত নিতে শুরু করেছে গত কয়েক দশকে। সারা পৃথিবী থেকে যেমন ভারতে জন্মে, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েদের ডাক পড়ছে কাজের সুত্রে, তেমনই এই দেশের বুকে দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে রোজ, গর্বিত করছে এই মাটিকে। এই নক্ষত্রদের এই প্রতিষ্ঠা, এই সাফল্যের পেছনে ভূমিকা থেকেছে এই দেশেরই শিক্ষক শ্রেণীর তথা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির। আজ আলোচনা করবো এমনই একটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যার শিক্ষাব্যবস্থা দেশের অন্য সকল ইউনিভার্সিটির তুলনায় অনেকটা আলাদা, যার ভাবনা আলাদা এবং যা বাঙালি ঐতিহ্যকে নিজের মত বয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে গত একশো বছর ধরে। বিশ্বভারতী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজে হাতে তৈরি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।

সারা ভারতে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এক হাজারের একটু বেশি। এঁদের মধ্যে সম্ভবত ৬৯ তম স্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই শতাব্দী প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৬৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের তালুকদার ভুবনমোহন সিংহের থেকে বাৎসরিক ৫ টাকায় কুড়ি একর জমি পান। এই জমিতে একটি ভবন তৈরি করে তার নাম রাখেন শান্তিনিকেতন। প্রথমে এই জায়গার নাম ভুবন মোহন বাবুর নাম অনুসারে ভুবনডাঙ্গা ছিল, পরে আস্তে আস্তে নাম বদলে হয়ে যায় শান্তিনিকেতন। প্রাথমিকভাবে সেখানের ছাতিম গাছের নিচে একটি আশ্রম স্থাপিত হয়, এখানে মানুষ আসতেন যোগ সাধন করতে, মনের শান্তির জন্য। ১৯০১ সালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই আশ্রমের ভেতর একটি স্কুল স্থাপন করেন। রবীন্দ্রনাথ খোলা আকাশের নিচে, মুক্ত হাওয়ায় বসে শিক্ষায় বিশ্বাস করতেন, সেই মতো এখানে পড়াশোনা হতো গাছ তলায়। ছাত্রছাত্রীরা মাদুর বা বস্তা বিছিয়ে বসতো আর শিক্ষক বসতেন সামনে বেদীতে। ১৯২১ সালে স্থাপিত হল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯২৫ সালে আগের স্কুলটির নামকরণ করা হল পাঠভবন। মুক্ত প্রাঙ্গণে পড়াশোনা, দেশের স্বাধীনতার কার্যকলাপে অংশগ্রহণ, শিল্পচর্চা সংস্কৃতি সবকিছু নজর কেড়ে নিতে লাগলো ধীরে ধীরে। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাবসান হয় এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪ বছর পর, ১৯৫১ সালে জওহরলাল নেহেরুর উদ্দ্যেগ বিশ্বভারতী কে কেন্দ্র সরকার নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এই নিয়ম মেনে বিশ্বভারতীর পরিদর্শক হন ভারতের নির্দিষ্ট সময়কালীন রাষ্ট্রপতি, প্রধান হন রাজ্যের রাজ্যপাল, চ্যান্সেলর হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণে রয়েছে কলাভবন অর্থাৎ কলা বিভাগ নিয়ে পড়াশোনার জায়গা, সঙ্গীতভবন অর্থাৎ নাচ, গান এবং নাটক নিয়ে শিক্ষার জায়গা, চীনাভবন অর্থাৎ চাইনিজ পঠন পাঠনের জায়গা, পল্লী সংগঠন বিভাগ অর্থাৎ গ্রাম্য আচার এবং উন্নিকরণ নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ, হিন্দিভবন, নিপনভবন যেখানে জাপানি ভাষা সহ আরও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে পড়াশোনা হয়, শিক্ষাভবন, বিদ্যাভবন, ভাষাভবন, বিনয়ভবন এবং আরও অনেক জায়গা যেখানে ইউরোপীয় ভাষা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রীতিনীতিও শেখানো হয়। বিশ্বভারতীর মূল বিষয় হল প্রকৃতি। সময়ের সাথে সাথে কিছু পরিবর্তন এখানে করা হয়েছে অবশ্যই কিন্তু তবুও এখানের পরিবেশের

মূল স্বাদ একই রয়ে গেছে। ডিপার্টমেন্টগুলোয় এখন বেশিরভাগই ঘরের ভিতরে পঠনপাঠন চলে। পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রে এখনও গাছের নিচে ক্লাস হয়। ঠিক আগের মতোই ছাত্রছাত্রীরা মাটিতে, আসন পেতে বসে। মাস্টারমশাই বসেন বেদীতে। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন প্রকৃতির মধ্যে ছেলেমেয়েরা বড়ো হোক, তাই খোলা আকাশের নিচে ক্লাস নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। এই সম্পূর্ন ভাবনাকে আকৃতি দেওয়া হয়েছিল প্রাচীন তপোবনের আদলে। তাই শান্তিনিকেতনকে আশ্রম বলা হয়। এখানকার সাংস্কৃতিক দিক আজও ভারতের তাবড় তাবড় বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে দিতে পারে, একাধারে ছাত্রছাত্রীরা নাচ, গান, আঁকা, সেলাই, মাটির কাজ, কাঠের কাজ সহ নিজের মনের মতো যাবতীয় বিষয় নিয়ে কাজ শিখতে তথা পড়াশোনা করতে পারেন। শান্তিনিকেতনে প্রতিটি ঋতুকে বরণ করে নেওয়ার চল রয়েছে, শীতে পৌষ উৎসব, বর্ষায় বর্ষামঙ্গল, বসন্ত কালে বসন্ত উৎসব। এই সময় এখানে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে যা শুধু রাজ্য নয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। বসন্ত উৎসবের সময় আয়োজিত দোল উৎসবে শরিক হতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক ছুটে আসেন, মানুষ আসেন বিদেশ থেকেও। সাথে সাথেই এখানকার পৌষ মেলা ভারত বিখ্যাত। এই উৎসব গুলির সময় এখানে আয়োজন করা হয় গান, বাজনা, নাচের সাথে সাথে গীতিনাট্য, গীতি আলেখ্যরও। এছাড়াও স্কুলে, অর্থাৎ পাঠভবন, শিক্ষাসত্রে সাহিত্যসভা নামের একটি সভা হয় মঙ্গলবার করে। সেই সভায় স্বরচিত কবিতা, লেখা পাঠ করে ছেলেমেয়েরা।

বিশ্বভারতীতে কর্মসূত্রে অনেকেই আসেন। কেউ শিক্ষকতা করেন, কেউ কর্মী, ছাত্রছাত্রী, গবেষক তো আছেনই। তাঁরা সকলেই এখানে থাকেন, কেউ কোয়ার্টারে, স্টুডেন্টরা হোস্টেলে, কেউ আবার বাড়িতে। এখানের জল হাওয়া পরিবেশের সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন একটু একটু করে। এখানে কর্মরত ও কাজের সূত্রে বসবাস করা সকলকেই আশ্রমিক বলা হয়। যদিও শান্তিনিকেতনে থাকেন অথচ সরাসরি বিশ্বভারতীর সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁদের আশ্রমিক বলা হবে কিনা, এ এক বড় প্রশ্ন! কিন্তু যে এই জায়গার মূল ভাবনাটুকু আত্মস্থ করতে পারে, তাকে আশ্রমিক বলাই যায়, তাতে সরাসরি যোগ থাক বা না থাক।

বিশ্বভারতীর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ধীরে ধীরে এই দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠার গল্প অসম্ভব আকর্ষণীয়। যেই ধ্যান ধারণা রবীন্দ্রনাথ এখানে বপন করে গেছেন তা এখানকার শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, মানুষ আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন। এখানে সুযোগ পাওয়া এবং পড়াশোনা করা বহু পাঠরত ছেলেমেয়ের স্বপ্ন। আর হবেই না কেন! এখানের মতো প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ দেশের অন্য কোথাও পাওয়া তো মুশকিল।

Source :

  • https://en.m.wikipedia.org/wiki/Visva-Bharati_University
  • https://www.tagoreweb.in/Essays/shikkha-73/ashromer-shikkha-6268
  • https://en.m.wikipedia.org/wiki/Shantiniketan

More Articles