হাঙর নদীর গ্রেনেড: সেলিনা হোসেনের কলমে নারীত্বের অনন্য আখ্যান

'বুড়ি রইসের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। জনযুদ্ধে উপেক্ষিত ছেলেটার উষ্ণ তাজা রক্ত হাত দিয়ে নেড়ে দেখে। রইসের ঠোঁটের কোণে লালা নেই। লালচে ক্ষীণ রেখা গড়াচ্ছে। রক্তের থোকায় কাত হয়ে পড়ে থাকা রইসের মাথাটা সোজা করে খুব আস্তে চোখের পাতা বুজিয়ে দেয় বুড়ি।' বড় অনিশ্চয়তায়  ফুরোয় সেলিনা হোসেনের 'হাঙর নদীর গ্রেনেড' উপন্যাস। বুড়ির এক ছেলে কলীম আগেই ঝাঁঝরা হয়েছেন পাকিস্তানি মিলিটারির গুলিতে। আরেক ছেলে সলীম যোগ দিয়েছেন মুক্তিবাহিনীতে। তিনি খোয়াব দেখেন স্বাধীন বাংলাদেশের। তাঁর শেষ পরিণতির কথা পাঠক জানতে পারেন না। যদিও পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে সলীমকে রক্ষা করতে বুড়ি আগেই রটিয়ে দিয়েছিল তাঁর মৃত্যুসংবাদ। 

শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল সলীমের সঙ্গে? স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর দেশের মানুষের যুদ্ধজয়ের আনন্দে কি তিনি সামিল হতে পেরেছিলেন, নাকি তার আগেই নৃশংসভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল? এ সমস্ত তথ্য লেখিকা দেননি। পাঠককে কল্পনার সমস্তরকম অবকাশ দিয়েছেন তিনি। তার উপর ভিত্তি করে পাঠক হয়ত নিজেই বানিয়ে ফেলতে পারবেন সলীমের অভ্যুত্থান পরবর্তী কোনও কাহিনি। সলীমের শেষ কিসসার কথা জানা না গেলেও যে ভূখণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে তিনি দেখেছিলেন শৃঙ্খলমুক্তির স্বপ্ন তার পরিণতি কী হয়েছিল তা আমরা জানি। নৃশংস হত্যালীলার বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পদপ্রান্তে অস্ত্র নামিয়ে রেখে তাঁকে সম্মান জানিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের বীর যোদ্ধা টাইগার সিদ্দিকী (কাদের সিদ্দিকী)। 

এর ঠিক পাঁচ বছর পর ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হচ্ছে সেলিনা হোসেনের 'হাঙর নদীর গ্রেনেড'। ততদিনে দুষ্কৃতীদের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে বঙ্গবন্ধুর। নবগঠিত দেশের শরীর থেকে তখনো  রক্তদাগ পুরোপুরি মুছে যায়নি । শফি আহমেদ তাঁর লেখায় দেখাচ্ছেন কী ভাবে ৭৭ বা ৭৮ সালেও বাংলাদেশের অসংখ্য বাড়িঘরের দেওয়ালে পাওয়া যেত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বা মুক্তিসেনাদের আঘাতের চিহ্ন। তিনি বলছেন, 'সেদিনও সারা বাংলাদেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে যুদ্ধের শহিদ বা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া অনেক সন্তানের মা দূর পথের দিকে তাকিয়ে থাকতেন এই আশায়- হয়ত তাঁদের সন্তান- সালাম, হরিপদ, গোমেজ বা মুরং ফিরে আসবে।' 

কোন রাজনৈতিক বিবর্তনের ফলাফল এই বীভৎসতা? খুব সংক্ষেপে ইতিহাসটা দেখে নেওয়া যাক। ১৯৪৭ সালে ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্রকে অস্বীকার করে পূর্ববাংলাকে প্রতিষ্ঠা করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের  উপনিবেশ হিসেবে। বাঙালি মুসলমানদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বিদ্বেষ প্রকাশ পায় অল্পদিনের মধ্যেই। ১৯৫২ সালে ফিরোজ খাঁ নুন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের 'আধা মুসলিম' আখ্যা দেন। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ জিন্নাহ সাহেব উর্দুকে ঘোষণা করেন সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা করে তোলার দাবি ওঠে এ সময় থেকে। অবশেষে ১৯৫২ সালের ২১ এবং ২২ ফেব্রুয়ারি গুলি চলে ঢাকার একদল প্রতিবাদী ছাত্রের উপর। এই ঘটনার পর থেকেই জোরদার হয় পূর্ববঙ্গের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি। তারপর ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা দখলের আগে ঘটে গেছে নানান ঘটনা। ১৯৫৪-র নির্বাচনে ফজলুল হকের কাছে পরাজিত হয়েছে মুসলিম লীগ। ফজলুল সাহেবের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে এবং বাতিলও হয়েছে অগণতান্ত্রিকভাবে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সংবিধান বাতিল করেছেন প্রেসিডেন্ট ইসকন্দর মীর্জা, সামরিক শাসনের প্রকোপে পড়েছে দেশ। ইয়াহিয়া খানের আমলে ভাবি নির্বাচনের আশা কিছুটা দেখা যায়, যদিও ১ মার্চ জানা যায়, সে গুড়ে বালি। ওই দিনই বাতিল করা হয় ৩ মার্চের জাতীয় অধিবেশন। ২ মার্চ থেকে শুরু হয় সামরিক আইন, তারপর ২৫ মার্চ থেকে যুদ্ধ পরিস্থিতি।

এই সমগ্র ঐতিহাসিক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠেছেন 'হাঙর নদীর গ্রেনেডে'র প্রধান চরিত্র  বুড়ি। পার্টিশন থেকে ৭১ এর স্বাধীনতালাভের বিস্তীর্ণ যাত্রাপথের পথিক হয়ে তিনি যেন হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। এ উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে প্রাথমিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে এক নারীত্বের আখ্যান। তিন সন্তানের মা বুড়ি নিজের দুই ছেলেকে কুরবানী দিয়েছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। তাঁর তিন নম্বর ছেলে রইস বিকলাঙ্গ। মস্তিষ্কের পরিণতি হয়নি তাঁর। এমন ভাঙা দেশে তাঁকে নিয়ে একলা বুড়ি যাবেন কোথায়? ঔপনিবেশিক শত্রুদের আক্রমণে তাঁর অর্ধেক গ্রাম ফাঁকা হয়ে গেছে। মানুষ ঘটি বাটি ফেলে রেখে প্রাণভয়ে পালিয়েছেন অন্যত্র। ফেলে রেখে গেছেন শুধু বুড়ি আর তাঁর অবশিষ্ট সন্তানকে। বুড়ির তখন বয়স হয়েছে। শরীর আর দেয়না। তিনি ঠিক করলেন কোথাও যাবেন না। যতদিন দেহে আছে প্রাণ, শিশুর মতো ছেলেটাকে নিয়ে একাই ভিটে পাহারা দেবেন। খুব বেশিদিন অবশ্য প্রতিরোধ চালাতে পারেননি তিনি। অল্প কিছুদিনের মাথায় পাকিস্তানী সেনা জঘন্যভাবে অত্যাচার করে হত্যা করেন রইস কে। বুড়ির চোখে তখন খাঁ খাঁ শূন্যতা। সমগ্র বিশ্বসংসারে তিনি একা বেঁচে রইলেন আহত বাঘিনীর মতো। এমন কুয়াশাচ্ছন্ন দৃষ্টি সেদিন আরেক মায়ের চোখে ফুটে উঠেছিল। নাম তাঁর জাহানারা ইমাম। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মানুষ যাঁকে চিনেছিলেন 'শহীদ জননী' নামে। তাঁর বড় ছেলে রুমি গানে, কবিতায় ভরিয়ে রাখতেন বাড়িঘর। তারপর একদিন 'বর্গী এলো দেশে'। শক্ত মুঠোয় অস্ত্র ধরে দেশকে স্বাধীন করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন ঘর ছেড়ে। আর ফিরলেন না। 

 প্রান্তিকের অভিজ্ঞতাই হয়ে উঠেছে 'হাঙর নদীর গ্রেনেডে'র প্রধান বিষয়বস্তু। কেন্দ্র থেকে প্রান্তবাসী বুড়ির অবস্থান যোজন মাইল দূরে। কোনোদিন শহর দেখেননি তিনি। তার গল্প শুনেছেন কেবল। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু বা হেনরি লেফেব্রে যাকে বলছেন 'centre of decision making', সেখানে কী ঘটছে না ঘটছে তা তাঁর পক্ষে জেনে ওঠা সম্ভব নয়। চোখের সামনে নানান বিক্ষিপ্ত ঘটনা দেখে নিজের মতো করে জাতীয়তার একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে তাঁর। বুড়ি শুনেছেন সেই দূর শহরে একজন মানুষ আছেন যাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে চোখের দেখা দেখা হয়নি কোনোদিন। সেই সেবার ৭ মার্চ শহরে তাঁর সভা হল, গাঁয়ের মানুষজন সব রেডিও চালিয়ে শুনলেন, সেখানে শুধু তাঁর গলাটা শুনেছিলেন তিনি। সেই কন্ঠস্বরের মাধুর্যও তাঁর রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে কালে কালে মিশ খেয়ে গেল। গণ অভ্যুত্থানের নেতা শেখ মুজিবের জন্য এখন তাঁর জানকবুল।

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রান্তিকের এই বিবিধ অভিজ্ঞতা নিয়ে স্বয়ং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও একটা উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন। যদিও মধ্যবিত্ত নিয়ন্ত্রিত জাতীয়তাবাদের গড্ডালিকাপ্রবাহে তিনি গা ভাসাতে চাননি। জনযুদ্ধের সময়ে গ্রাম গঞ্জের যে সকল মানুষের অন্যত্র পালাবার সুযোগ ছিল না তাঁরা পাকিস্তানী সৈন্যের বিরুদ্ধে কী ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সে গল্পই বলতে চেয়েছিলেন তিনি। পরিকল্পনা মতো তার মাল মশলা জোগাড় করাও আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু বাধ সাধল ক্যানসার। দুরারোগ্য সেই ব্যাধির প্রকোপে পড়ে ১৯৯৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। সেলিনা হোসেনও সম্ভবত প্রান্তিকের প্রতিরোধ কাহিনিকে তলা থেকেই বোঝার চেষ্টা করছিলেন। জবরদস্তি কোনও জাতীয়তার ধারণা তাঁর চরিত্রদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি তিনি। 

কাকে বলে দেশ? বিভিন্ন মানুষের দিন যাপনের অভিজ্ঞতার উপর কীভাবে তৈরি হয় তার ধারণার ইমারত? আমহমদ ছফার 'ওঙ্কার' উপন্যাসে কথকের আজন্ম বোবা স্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিমিছিল দেখে সংজ্ঞা হারিয়ে মেঝেতে পড়ার আগে জীবনে প্রথম এবং শেষবারের মতো স্পষ্ট উচ্চারণে বলে উঠেছিলেন 'বাংলা'। দেশ কি তাহলে রাষ্ট্রীয় সীমান্ত নির্দেশিত কোনও তুরীয় বিষয়, নাকি নানান মানুষের নানান যাপনিক অভিজ্ঞতার এক বিক্ষিপ্ত খণ্ডসমগ্র? সাম্প্রতিককালে ভারতবর্ষে উগ্র জাতীয়বাদের  হুজুগ দিনে দিনে যেভাবে দানা বাঁধছে, সেই আবহাওয়ায় প্রশ্নগুলো থেকেই যায়। 


তথ্যঋণ: শফি আহমেদ: যুদ্ধ, নারী ও স্বদেশপুরাণ, সেলিনা হোসেনের হাঙর নদীর গ্রেনেড
অভীক সরকার সম্পাদিত: বাংলা নামের দেশ

More Articles