বরিসের আগমনে কি আদৌ লক্ষ্মীলাভ হবে ভারতের?

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে ভারতে আসছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ২১ এপ্রিল দু'দিনের সফরে ভারতে আসছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর বৈঠক রয়েছে। ব্রিটেন সূত্রে জানা গেছে, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এই বৈঠকের মূল লক্ষ্য। দুই রাষ্ট্রনেতার বৈঠকের ফলে বাণিজ্যে লক্ষ্মী বসবে কি না, সেই দিকে তাকিয়ে বিশ্ব। যদিও জনসনের অফিস এক বিবৃতিতে বলেছে, আমার সফরে সেইসব বিষয় গুরুত্ব পাবে, যার সঙ্গে দুই দেশের নাগরিকদের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি। 


এই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, জনসনের এই বৈঠকের প্রধান উদ্দেশ্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সমঝোতা তরাণ্বিত করা। ২০৩৫ সালের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমান ২৭.৯১ লক্ষ কোটির লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করা। সেই লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে দুই রাষ্ট্রনেতার আলোচনা হওয়ার কথা। বরিসের উদ্দেশ্য- ভারতের সঙ্গে পাঁচহাজার কোটি পাউন্ডের বাণিজ্যচুক্তি পাকা করা। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সূত্র থেকে এমনই খবর পাওয়া গিয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলা যুদ্ধ, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল সম্পর্কিত বিষয় ও বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হতে পারে‌।

আহমেদাবাদ থেকে ভারত সফর শুরু করবেন বরিস জনসন। এটাই তাঁর প্রথম ভারত সফর। দেশের প্রথম সারির ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেখা করবেন এবং ব্রিটেন ও ভারতের সমৃদ্ধশালী বাণিজ্য এবং জনগণের সংযোগ নিয়ে আলোচনা করবেন। এই প্রথমবার কোনও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গুজরাত সফর করবেন। প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ ও ভারতীয়দের বেশ কিছু জনসাধারণের পৈতৃক বাড়িও রয়েছে ব্রিটেনে। 

আরও পড়ুন: মমতার স্বপ্নের তাজপুর বন্দর কি আদানির হাতে? আদৌ লাভ হবে রাজ্যের?


সফরের আগে বরিস বলেন, যেহেতু স্বৈরাচারী রাষ্ট্রগুলোর থেকে আমাদের শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে হুমকি আসে, সেই কারণে গণতন্ত্র এবং বন্ধুদের সঙ্গে থাকা অত্যাবশ্যক। ভারত একটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি এবং বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে যুক্তরাজ্যের কৌশলগত অংশীদার।


গুজরাতে, বরিস ব্রিটেন এবং ভারত উভয়ের মূল শিল্পে একটি বড় বিনিয়োগের ঘোষণা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ঘরে বসে চাকরি বৃদ্ধি পাশাপাশি অত্যাধুনিক বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তিতে নতুন সহযোগিতার কথা বলবেন।

মাথায় রাখতে হবে, ব্রেক্সিটের পর এই প্রথম কোনও দেশে সফর করবেন জনসন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য। ব্রেক্সিটের পর দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে অঙ্ক সাজাতে হচ্ছে জনসনকে। বরিস জানিয়েছেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাণিজ্যের নতুন সমীকরণ তৈরি করতে চাইছেন তিনি। এবং সেখানে ভারত গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী। আগামী এপ্রিলে সেই বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। সার্ক দেশগুলির সঙ্গেও জনসন সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চান বলে মনে করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যের ব্যাপ্তিও বাড়বে।

রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের জেরে বিশ্বরাজনীতির অনেক হিসেবই ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারতের অবস্থান নিয়ে কিছুটা ক্ষুব্ধ আমেরিকা। আবার যুদ্ধের আবহে ইউরোপ, আমেরিকার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মস্কোর সঙ্গে সখ্য বাড়িয়েছে নয়াদিল্লি। এমন পরিস্থিতে চলতি মাসে ২ দিনের সফরে আসছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। শনিবারই তাঁর ভারত সফরের দিনক্ষণ জানিয়েছেন জনসন। কূটনীতিকদের ধারণা, এবার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা ছাড়াও মোদি-জনসনের আলোচনার সিংহভাগ জুড়ে থাকবে কিয়েভ-মস্কোর সংঘর্ষ। সম্প্রতি যুদ্ধবিধ্বস্ত কিয়েভ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন জনসন। সেখানে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে রাস্তায় ঘুরতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ভারত সফরে তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথাই মোদির কাছে তুলে ধরতে পারেন জনসন। উল্লেখ্য, রাশিয়া সফরের জন্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীকে ইতিমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে রাশিয়া।

২০২১ সালের  শুরুতেই ভারতে আসার কথা ছিল জনসনের। সাধারণতন্ত্র দিবসের প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন তিনি। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতির জেরে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। সেই সময়ে ভারতে সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ব্রিটেনে দাপাচ্ছিল কোভিড-১৯। পরে ঠিক হয়, এপ্রিলে ভারতে আসবেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ওই সময় থেকেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছিল ভারতে। পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে বাতিল হয় সেই সফরও। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, সফর কাটছাঁট হবে। পরে তা পুরোপুরি বাতিল করে দেয় ব্রিটেন প্রশাসন। অবশেষে এবার মোদির ডাকে সাড়া দিয়ে ভারতে আসছেন জনসন। 


মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল বা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল হল একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এমন একটি এলাকা যেখানে শুল্ক কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই পণ্য অবতরণ, বহন, উৎপাদন বা পুন:সংযোজন, এবং পুন:রপ্তানি করা যায়। এটি বিদেশি বাণিজ্য অঞ্চল নামেও পরিচিত। মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলগুলো সাধারণত বাণিজ্যের জন্য ভৌগোলিকভাবে সুবিধাজন স্থান, যেমন, প্রধান সমুদ্রবন্দর, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, এবং জাতীয় সীমান্ত- প্রভৃতি এলাকায় গড়ে তোলা হয়। এটি এমন একটি এলাকা, যেখানে কিছু দেশ বাণিজ্যিক বাধাসমূহ কমাতে বা দূর করতে সম্মত হয়েছে।


রাশিয়ার ইউক্রেনে আগ্রাসন নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে ভারত। অন্যদিকে, মস্কোর ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে লন্ডন। এমনকী, কিয়েভে অস্ত্র সরবরাহও করেছে। মোদি সরকার সরাসরি ক্রেমলিনের পদক্ষেপের নিন্দা করেনি। তবে, ইউক্রেনকে মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে। ভারতের বক্তব্য, রাশিয়া দীর্ঘদিনের বন্ধু। এছাড়া দেশের বিদেশনীতির অন্যতম ভিত্তি। জাতীয় নিরাপত্তাতেও মস্কো কৌশল-সঙ্গী।


এই আবহে অনেকবার থমকে যাওয়ার পর অবশেষে ভারতে আসছেন জনসন। ২১ এপ্রিল আমেদাবাদ পরিদর্শন করবেন জনসন। গুজরাতের অন্যতম প্রধান শহর এবং ব্রিটেনে বসবাসকারী অর্ধেক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের পৈতৃক বাড়ি এখানে। ডাউনিং স্ট্রিট সূত্রের খবর, ব্রিটেনে প্রধান বিনিয়োগ নিয়ে গুজরাতে কোনও ঘোষণা করতে পারেন জনসন। 


এর পাশাপাশি ব্রিটেন ও ভারতের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য নিয়ে পারস্পরিক সমঝোতার চেষ্টা করবেন তিনি। কাজেই, জনসনের এই সফর নিয়ে প্রত্যাশার পারদ চড়ছে। তাকিয়ে আছে বিশ্ব।

More Articles