অনলাইন স্কুল কি আদৌ পড়ুয়াদের শেখাতে পারছে?

করোনাভাইরাস থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের সুরক্ষিত রাখার জন্য সারা বিশ্বজুড়ে বর্তমানে চালু হয়ে গিয়েছে অনলাইন শিক্ষা। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা হোক কিংবা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এর শিক্ষা, সবকিছুই বর্তমানে অনলাইনে। প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল সারা বিশ্বে স্কুল-কলেজ বর্তমানে বন্ধ, এবং বিশ্বজুড়ে ১.২ বিলিয়ান ছাত্র-ছাত্রী স্কুল কলেজে যেতে পারছে না বিগত দেড় বছর ধরে। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে কয়জন পড়ুয়া করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকছে বটে। কিন্তু, এই অনলাইন শিক্ষার কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের যতটা না ভালো হচ্ছে, তার থেকে অনেক বেশি খারাপ হচ্ছে। এখানে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার সেই খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা।

বাড়িতে বসে অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের ফলে একাধিক সুবিধা পেয়ে যেতে পারে স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা। ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের স্বাস্থ্যের জন্য যে রকম ভাবে এই অনলাইন শিক্ষা উপকারী প্রমাণিত হচ্ছে, ঠিক একইভাবে, শিক্ষার্থীদের করোনা ভাইরাসের মত একটি ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করছে। ছাত্র-ছাত্রীরা গুগল মিট, মাইক্রোসফট টিমস, জুম ইত্যাদির মাধ্যমে অনলাইনে নিজেদের রেগুলার ক্লাস করতে পারছে। তার সঙ্গে সঙ্গেই, অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরা সঠিকভাবে সোশ্যাল ডিসটেন্স পালন করতে পারছে, যা তাদের শরীরের পক্ষে অনেকটাই লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গেই, স্কুল গুলির ক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষা অনেকটাই বেশি লাভজনক, কারণ অনলাইন শিক্ষার জন্য কোন স্কুলকে অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে না তাদের ট্রেনিং এর জন্য, অথবা ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট দেওয়ার জন্য।

অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একটি স্কুলের গভর্নিং বডি মেম্বাররা বললেন, " যেহেতু বাড়ি থেকেই হচ্ছে এবং খুব সহজে সমস্ত পড়াশোনা করানো যাচ্ছে, তাই স্কুলগুলির খরচ বেশ কিছুটা কমেছে। এছাড়াও ছাত্র-ছাত্রীদের কোন কিছু শেখানোর জন্য আলাদা রকম খরচ বহন করতে হতো, সেটাও এখন লাগছে না। " অবশ্যই এই অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার বেশ কিছু ভাল দিকও রয়েছে। কিন্তু তবুও, এই অনলাইন ব্যবস্থার এমন কিছু খারাপ দিক রয়েছে যা এই ভালো দিকগুলোকে ছাপিয়ে যেতে পারে। বলতে গেলে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার ভালো দিকের থেকে খারাপ দিকের সংখ্যা অনেক বেশি।

অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল মূলত সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে বাড়িতে বসে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। কিন্তু এই অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার আসল ব্যবহারের জায়গা থেকেই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। অনলাইনে শিক্ষার মাধ্যমে অনেক এমন জায়গা থাকে যেখানে ছাত্রছাত্রীরা সেই ব্যাপারটা বুঝতে পারেনা। আসলে এতদিন পর্যন্ত ভারতে অফ্লাইন শিক্ষাব্যবস্থা চলে এসেছে। প্রত্যেক শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর এতদিন পর্যন্ত অফলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। কিন্তু, হঠাৎ করে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে অনলাইন হয়ে যাওয়ার কারণে কিছুটা হলেও সমস্যার মধ্যে পড়েছেন ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা। একদিকে যেমন শিক্ষক-শিক্ষিকারা সেই নির্দিষ্ট বিষয়টি তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের সঠিক ভাবে বুঝাতে পারছেন না, ঠিক একইভাবে অনলাইনের মাধ্যমে কোন বিষয় বুঝতে সমস্যা হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের। মূলত বিজ্ঞানের ছাত্র ছাত্রীদের ক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা আরও বেশি সমস্যাজনক হয়ে উঠেছে কারণ, বিজ্ঞানের এমন বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যেখানে প্র্যাকটিকাল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু বাড়িতে বসে, প্র্যাকটিক্যাল কাজ করা, কিংবা কোনো ফিল্ড প্রজেক্ট করা কার্যত অসম্ভব। তাই এই জায়গায় অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা তেমন একটা লাভজনক নয়।

অন্যদিকে, সবকিছু বাড়িতে বসে এবং অনলাইনে হয়ে যাওয়ার কারণে, ছাত্র-ছাত্রীরা বাইরের জগতের সাথে ভালোভাবে কথা বলতে পারছে না। তাদের কমিউনিকেশন স্কিলের উপরে বেশ ভাল প্রভাব ফেলেছে এই অনলাইন ব্যবস্থা। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক বেশি সময় কাটানোর কারণে তাদের মস্তিষ্কের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলছে এই সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইট। পাশাপাশি, বিগত দেড় বছরে কম বয়সীদের মধ্যে পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। জনপ্রিয় একটি পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইট এর দ্বারা প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল, যবে থেকে এই অনলাইন ব্যবস্থা শুরু হয়েছে, তবে থেকেই, এই সমস্ত পর্ন ওয়েবসাইটে ভিজিটরের সংখ্যায় একটা বড় মাত্রার বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশের বয়স ২০ এর নিচে।

টেকনোলজি কিন্তু সম্পূর্ণরূপে এখনো পর্যন্ত অফলাইন ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করতে পারেনি। অনলাইনে কোন কিছু শেখার জন্য সবথেকে বেশি প্রয়োজন হয় সেটা হল হাই স্পিড ইন্টারনেট। কিন্তু ভারতের এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে হাই স্পিড ইন্টারনেট চলে না। অনেকেই ওয়াইফাই ব্যবহার করার খরচ দিতে পারেন না, তাই তাদেরকে মোবাইল ইন্টারনেট এর উপরে ভরসা করতে হয়। কিন্তু মোবাইল ইন্টারনেট কখনোই ততটা ভাল স্পীড দিতে পারবে না। তাই, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রয়োজনের সময় ছাত্র-ছাত্রীদের ইন্টারনেট চলছে না, আরো নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে, যার ফলে অনলাইন ক্লাস করাবে সমস্যার হয়ে যাচ্ছে।

সঙ্গেই বাড়িতে অনেক ধরনের এমন জিনিস আছে যা তাদের ফোকাস পড়াশোনা থেকে সরিয়ে দিতে পারে। এর ফলে, অনেকেই সঠিকভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে না। স্কুল এবং কলেজে এই ধরনের মনোযোগ নষ্ট করার জিনিস, অনেক কম। তাই স্কুলে যে ছাত্রছাত্রী আরো বেশি ভালোভাবে কোন বিষয় বুঝতে পারত, বাড়িতে সেরকম ভাবে হচ্ছে না। ফলে, একদিকে যেমন ছাত্র-ছাত্রীদের কনসেপ্ট ঠিক হচ্ছে না, তেমনি অনেকে বিষয়টি বুঝতেই পারছে না।

তার পাশাপাশি, এই বয়সেই শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বাড়িতে হয়ে যাবার কারণে, অনেক ক্ষেত্রে পড়ুয়ারা বাইরের জগতের সাথে মানিয়ে নিতে পারছে না। অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলা, তাদের সাথে বাইরের দুনিয়ায় মানিয়ে-গুছিয়ে চলা, অনেকেই শিখতে পারছে না। সোশ্যাল মিডিয়াতে হয়ত অনেকেই অনেক বেশি অ্যাকটিভ, কিন্তু আসলে, প্রকৃত জগতে অনেকেই কথোপকথন করতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ছে, যা তাদের পরবর্তী জীবনে তাদেরকে সমস্যার সম্মুখীন করতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে বলতে গেলে, এই অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার ভালো দিকের থেকে খারাপ দিক অনেক বেশি। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচাতে আপনাকে সাহায্য করলেও, কোন শিশুর মানসিক এবং শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে স্কুল এবং অফ্লাইন শিক্ষাব্যবস্থা অনেক বড় ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। পাশাপাশি, যারা কোন বিষয় শিখতে চায় ভালোভাবে, তাদের জন্য অবশ্যই স্কুলে কিংবা কলেজে গিয়ে শেখা অনেক বেশি জরুরী। অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা করোনাভাইরাস এর সময় আমাদের সাহায্য করেছে, কিন্তু এই জিনিসটির বহুল ব্যবহার সকলের পক্ষে ভালো না। বর্তমানে যেহেতু করোনাভাইরাস এর প্রভাব কিছুটা হলেও কম আছে, তাই অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যত শীঘ্র সম্ভব শিক্ষাব্যবস্থা আবারো অফলাইন নিয়ে আসা উচিত। তারা বলছেন, অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন ঠিক সেখানেই, যেখানে অফলাইনের পরিস্থিতি নেই, অথবা, অফলাইন যেখানে কাজ করবে না।

More Articles