হিন্দুদের পবিত্র তীর্থে মারাত্মক দূষণ! আবার কি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে চারধামের এই ধাম?

হিমালয় এখনও ভূতাত্বিক হিসেবে নবীন, এবং যথেষ্ট ভঙ্গুর। এখনও এটি যথেষ্ট সক্রিয় এবং এই খামখেয়ালিপনার ফল যে কত মারাত্মক হতে পারে, তার আন্দাজ আমাদের আছে।

চারদিকে ছড়িয়ে আবর্জনা। খাবারের প্যাকেট, ব্যাগ, বোতল... কী নেই! স্তূপাকার হয়ে পড়ে রয়েছে আবর্জনা। মিল পাওয়া যেতে পারে শহরাঞ্চলের ভ্যাটের সঙ্গেও। আমাদের শহরে তো অলিতে-গলিতে এই দৃশ্য দেখেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এই ছবি শহরের নয়। কোনও সাধারণ পর্যটন কেন্দ্রেরও নয়। এই ছবি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক তীর্থস্থানের। স্থানটির নাম কেদারনাথ। হিন্দুদের চারধামের এক ধাম। প্রকৃতির দ্বারা সৃষ্ট এক অপরূপ সৌন্দর্যময় স্থান, যা মানুষ, তার স্বভাববশতই চূড়ান্তভাবে কলুষিত করে ফেলেছে।

 

কেদারনাথ বললেই সেই ২০১৩ সালের ভয়াবহ স্মৃতি ফিরে আসে। মেঘ ভেঙে সর্বনাশা সেই বৃষ্টি, তার জেরে ধস, বন্যা। জুন ১৬, ২০১৩-র সেই বিপর্যয়ে কী ক্ষতি হয়েছিল, তার একটা ছোট্ট তালিকা দিই।

 

প্রায় ৪,৫০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ৪২০০টি গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যু হয়েছিল ১১,০০০ গবাদি পশুর। ১৩০৯ হেক্টর জমি বন্যার জলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২১৪১টি বিল্ডিং ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। শতাধিক হোটেল ধ্বংস হয়েছিল। ন'টি জাতীয় সড়ক, ৩৫টি রাজ্য সড়ক, ১৭২টি বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০০৪ সালে সুনামির পর ভারতের মাটিতে ঘটা সবথেকে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিল এটি। এগুলো সব সরকার-প্রদত্ত তথ্য। সুতরাং, সংখ্যাগুলো আরও বড় হতে পারে।

 

এক দশক কেটে গেল। সেই ক্ষতির ভার আজও গোটা উত্তরাখণ্ড রাজ্য বহন করে চলেছে। অর্থনৈতিক, পরিকাঠামোগত এবং সবথেকে বড় কথা, পরিবেশগত যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছিল ২০১৩ সালে, তা আজও পূরণ হয়নি। কিন্তু কোনও শিক্ষা নেওয়া গেছে কি?

 

২০১৯ সালে কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী এবং যমুনোত্রী- এই চার তীর্থস্থানে তীর্থযাত্রীরা শেষবার গিয়েছিলেন। তার পর দু'বছর এই যাত্রা বন্ধ থাকে অতিমারীর কারণে। এই দু'বছর বন্ধ থাকার কারণে যেমন উত্তরাখণ্ড রাজ্যের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তেমন ব্যাকুল হয়েছেন ভক্তরাও। তাই এইভাবে জনস্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছেন তাঁরা, তাঁদের প্রিয় চারধামকে। এখনও পর্যন্ত প্রায় আট লক্ষ যাত্রী সেখানে গিয়ে পৌঁছেছেন, এবং এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, কেউ বলতে পারছেন না।

 

স্বাভাবিকভাবেই প্রবল চাপ পড়ছে এই পাহাড়ে ঘেরা রাজ্যের ওপর। রাতের বেলাও রাস্তা গাড়িতে পরিপূর্ণ, যেখানে-সেখানে ক্যাম্প, এবং পাল্লা দিয়ে সেই সঙ্গে জমা হচ্ছে সমস্ত আগত দর্শনার্থীদের আবর্জনার স্তূপ। সেই আবর্জনার স্তূপ কোথায় গিয়ে শেষমেশ জমা হবে, কীভাবে তাকে সরানো যাবে, কেউ জানে না। কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে এখনই বিশেষজ্ঞরা একপ্রকার নিশ্চিত। আবারও এক বিপর্যয় থেকে খুব বেশি দূরে নেই দেবলোক।

 

এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের জমা হওয়ার সবথেকে বড় বিপদ হল, এটি মাটির ক্ষয়ে যাওয়ার অন্যতম বড় কারণ। এছাড়াও প্লাস্টিক যেখানেসেখানে গিয়ে জমা হয়ে বড়সড় বিপদ ঘটাতে পারে।

 

২০১৩ সালের বিপর্যয়ের পরেই বিশেষজ্ঞদের কমিটি বারবার করে সরকারকে পর্যটক, যাত্রীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার সুপারিশ দেয়। কিন্তু তাঁরা সেকথা শোনেননি। তাঁদের যুক্তি এটাই যে, পর্যটনের মাধ্যমে এই রাজ্যের অনেক অর্থ উপার্জন হয়, অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। তাঁরা পর্যটনকে শিল্পের মর্যাদাও দেয়, যাতে এই পেশায় যুক্ত মানুষেরা অনেক সরকারি সুবিধা পেতে পারেন। কিন্তু পরিবেশের দিকটি একেবারেই পিছনের সারিতে চলে গেছে। তাঁরা একথা একবারও ভেবে দেখছেন না যে, পরিবেশের স্বাস্থ্য ঠিক না রাখলে ২০১৩ সালের মতো ঘটনা বারবার ঘটবে। তাতে আখেরে ক্ষতি রাজ্যের মানুষেরই। তখন কী করে চলবে পর্যটন? কীভাবে আয় হবে সরকারের?

 

তাছাড়া এই চারধাম তীর্থের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। যেখানে পুণ‍্যার্থীরা ধ্যান করতেন, নিজেদের মতো করে পুজো করতেন। কিন্তু এখন মুনাফার লোভ এতটাই বেড়ে গেছে যে, গ্রীষ্মকালের সমুদ্রসৈকতের মেলার সঙ্গে বিশেষ তফাৎ আর নেই চারধামের। আর পর্যটকের ভিড় যত বাড়বে, তত বাড়বে পরিকাঠামোর ওপর চাপ, ততই প্রয়োজন পড়বে নতুনভাবে সড়ক, সেতু বানানোর। যে কারণে কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই একটি প্রকল্প নিয়েছেন, ৮৮০ কিলোমিটার রাস্তা আরও চওড়া করার। এই সবকিছুর প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে, পাহাড়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে, খোদাই করা হচ্ছে, যার ফলে মাটি আলগা হতে থাকছে।

 

দেবভূমির ওপর এহেন অত্যাচারের ফল কী হতে পারে, তা ২০১৩ সালে মানুষ দেখেছেন। তা সত্ত্বেও কোনও সদর্থক ব্যবস্থা সরকার নিচ্ছে না। অথচ, কিছু দূরে, গঙ্গোত্রী, গোমুখেই পরিবেশরক্ষার্থে দুরন্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দিনে মাত্র ১৫০ জন যাত্রীই এখন সেখানে যেতে পারেন এবং একটুকরো প্লাস্টিকও যদি তাদের সঙ্গে থাকে, তাহলে সেটা ফেরত নিয়ে আসা বাধ্যতামূলক। এই ধরনের কোনও ব্যবস্থাই কি চারধামে করা সম্ভব নয়? আর কবে চোখ খুলবে প্রশাসনের?

 

হিমালয় এখনও ভূতাত্বিক হিসেবে নবীন, এবং যথেষ্ট ভঙ্গুর। এখনও এটি যথেষ্ট সক্রিয় এবং এই খামখেয়ালিপনার ফল যে কত মারাত্মক হতে পারে, তার আন্দাজ আমাদের আছে। হাতে সময় খুব কম। বড় বিপদ আসন্ন। এখনই যদি এক পা না পিছনো যায়, তাহলে আর কোনওদিনও এগোনো সম্ভব হবে না।

 

More Articles