চাঁদে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ? যে অসম্ভবকে সম্ভব করছে চিন

চিন নিজেদের এই স্পেস স্টেশনটিকে মহাকাশে সাধারণ মানুষের ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত করে তোলারও পরিকল্পনা করছে।

গত এপ্রিলেই চিনের তিনজন মহাকাশচারী চাঁদে ছ’মাস কাটানোর পর পৃথিবীর বুকে পা রাখলেন। পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী, গত ৫ জুন ফের চিনের আরও তিন মহাকাশচারী পাড়ি জমালেন চাঁদে। এবার চাঁদে পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে চাঁদের কক্ষে যে আউটপোস্টটি তৈরি করা হয়েছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় তদারকি করা।

চিনের জি়ংহুয়া নিউজ় এজেন্সির তরফে জানা যাচ্ছে, চিনের তিন মহাকাশচারী, চেন ডং, লিউ ইয়াং এবং কাই জু়ঝে়কে নিয়ে লং মার্চ টুএফ রকেট এবং শেনজো়-১৪ স্পেসক্র্যাফ্ট, একত্রে পাড়ি দিয়েছে চাঁদে।

গত ২৯ মে গোবি মরুভূমির বুকে অবস্থিত জিউকান স্যাটেলাইট লঞ্চ সেন্টারের লঞ্চিং প্যাডে পাঠানো হয়েছে লং মার্চ টুএফ রকেট। যার দৈর্ঘ্য ৬২ মিটার। এদিকে যদি আপৎকালীন অবস্থায় প্রয়োজন পড়ে, তাই একটি লঞ্চার এবং শেনজো়-১৪ নামের একটি স্পেসক্র্যাফ্ট একত্র করে দীর্ঘ ২৪০ দিন ধরে স্পেস স্টেশনটিতে রাখা ছিল।

আরও পড়ুন: চাঁদের মাটিতে গাছ, সম্ভব চাষবাসও? অসম্ভবকে সম্ভব করলেন বিজ্ঞানীরা

এই তিন মহাকাশচারী থাকবেন ষোলো মিটারের বেশি লম্বা, এবং প্রায় চার মিটার ব্যসযুক্ত একটি কোর মডিউলের ভেতর। যে মডিউলটির নাম তিয়ানহে। চায়না ম্যানেজড স্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসের আধিকারিক হাও চুং একটি সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন, জুলাই এবং অক্টোবর মাসে তিন মহাকাশচারীর জন্যে আবার পাঠানো হবে দু'টি মডিউল। ওয়েনশিয়ান এবং মেংগশিয়ান নামের এই দু'টি মডিউলের ওজন কুড়ি টনেরও বেশি।

মডিউলগুলো দক্ষিণ চিনের ওয়েন চ্যাং থেকে লং মার্চ ফাইভ-বি রকেটের সঙ্গে লঞ্চ করা হবে। চিনের জিউকান হল একমাত্র লঞ্চিং সাইট, যেখান থেকে মহাকাশচারী-সমেত রকেট উৎক্ষেপন করা যায়।

অন্যদিকে নতুন দু'টি মডিউল তিয়ানহের সামনের দিকে পোর্টের সঙ্গে যুক্ত হবে, প্রযুক্তির পরিভাষায় যাকে বলে ডকিং। এই ডকিং-এর জন্য ব্যবহৃত হবে একটি বৃহদাকৃতির রোবটিক আর্ম। পাশাপাশি এর জন্য প্রয়োজন তিন মহাকাশচারীর সাহায্য।

ওয়েনশিয়ান মডিউলটিতে থাকছে একটি এয়ারলক কেবিন, যেটি মূলত মহাকাশযানের বাইরে কাজ করার জন্যে ব্যবহৃত হবে, জ্যোতির্বিদ্যার পরিভাষায় যাকে বলে এক্সট্রাভেহিক্যুলার অ্যাকটিভিটি।

এক্সট্রাভেহিক্যুলার অ্যাক্টিভিটির সময়, ওয়েনশিয়ান মডিউলের নতুন একটি এয়ারলক কেবিনকেই মুখ্য প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

আর এই এয়ারলক হল একটি ছোট কক্ষ, যেগুলি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল করতে পারে। এদের অভ্যন্তরীণ বায়ুচাপ বা এয়ার প্রেশারও মূল মডিউলের থেকে আলাদা হয়। তবে শুধু মহাকাশযানই নয়, এয়ারলক সাবমেরিনেও থাকে।

ওয়েনশিয়ানে উপস্থিত একটি ছোট রোবটিক আর্মের সাহায্যে পরবর্তীকালে মহাকাশচারীদের স্থানান্তর করার সময় প্রয়োজন হবে। এই স্থানান্তরকরণের পদ্ধতিকে বলে ক্রিউ হ্যান্ডওভার। এই সময় মহাকাশে সদ্য আসা মহাকাশচারীরা নিজেদেরকে মহাকাশের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেন, যার জন্য বেশ কয়েকদিন সময়ের প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি ক্রিউ হ্যান্ডওভারের সময় সদ্য আসা মহাকাশচারীরা, এতদিন মহাকাশে থাকা বাকি মহাকাশচারীদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। আর এতদিন যাঁরা মহাকাশে ছিলেন, তাঁরা আবার পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেন এবং পৃথিবীতে ফেরা কিংবা স্প্ল্যাশডাউন অপারেশনের জন্য রিফ্রেশার ট্রেনিং শুরু করেন।

সমগ্র এই প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে, যখন পরবর্তী ক্রিউ হ্যান্ডওভারের সময় শেনজো়-১৪-র মহাকাশচারীরা পৃথিবীতে ফিরবেন, শেনজো়-১৫-র মহাকাশচারীরা চাঁদে পা রাখবেন। আশা করা হচ্ছে, শেনজো়-১৫-র মহাকাশচারীরা এই বছরের ডিসেম্বরেই চাঁদে পাড়ি দেবেন। ক্রিউ হ্যান্ডওভারের সময়টিতে টিয়াংগং মডিউলেই থাকবেন মোট ছ'জন মহাকাশচারী।

তিয়ানজো়-৪ কার্গোতে মূলত থাকছে শেনজো়-১৪-র মহাকাশচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, খাবারদাবার। এছাড়াও তিয়ানজো়-৪ কার্গোতে মহাকাশে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, মহাকাশবিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য প্রয়োজনীয় একটি রেফ্রিজারেটর, যেখানে নমুনা সংরক্ষণ করা হবে।

তিয়াংগং-এর প্রথম মডিউল চাঁদে পাঠানো হয়েছিল ২০২১ সালের এপ্রিলে। প্রথম এই মডিউলটির নাম ছিল তিয়ানহে কোর মডিউল। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে এই মডিউলটি তিনটি কার্গো এবং মহাকাশচারী-সহ দু'টি মহাকাশযানকে গ্রহণ করেছে।

টিয়াংগং-কে এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছে, যাতে এটি আগামী দশ বছর অন্তত সক্রিয় থাকতে পারে। পরিকল্পনা করা হচ্ছে, এটির সঙ্গে আরও ছ'টি মডিউল যোগ করা হবে ভবিষ্যতে। পাশাপাশি টিয়াংগং-এ যাতে পরবর্তী প্রকল্পগুলির জন্য অন্যান্য দেশ থেকে আসা মহাকাশচারীরাও থাকতে পারেন, তার জন্যও এটিকে প্রস্তুত করা হচ্ছে।

চায়না এরোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড কর্পোরেশন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই জানিয়েছিল, তারা এই বছরই পঞ্চাশটিরও বেশি লঞ্চিং-এর পরিকল্পনা করছে এবং ১৪০টির বেশি মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করার লক্ষ‍্যে হাঁটছে। উদ্দেশ্য, চাঁদের কক্ষে স্পেস স্টেশনটির নির্মাণ সম্পূর্ণ করা।

চিন চাইছে, এই বছরের মধ্যেই এই স্পেস স্টেশনটির নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ করতে। আর যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে পৃথিবীর মধ্যে চিনই হবে সর্বপ্রথম দেশ, যার সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব একটি স্পেস স্টেশন থাকবে। চিনই এই মুহূর্তে একমাত্র দেশ, যা অন্য দেশের সাহায্য ছাড়া বা অন্য দেশের সঙ্গে গাঁটছড়া না বেঁধে, সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে এই স্পেস স্টেশনটি বানাচ্ছে।

রাশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনটি আদতে বহু দেশের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে রাশিয়া তৈরি করেছে। তাই কোনওমতেই এই স্পেস স্টেশনটিকে সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব বলা যায় না। অবশ্য ইতিমধ্যেই এই স্পেস স্টেশনটি কার্যকর।

এমনও আশা করা হচ্ছে, চায়না এরোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড কর্পোরেশন, রাশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের প্রতিযোগী হয়ে উঠবে খুব শীঘ্রই। চিন নিজেদের এই স্পেস স্টেশনটিকে মহাকাশে সাধারণ মানুষের ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত করে তোলারও পরিকল্পনা করছে। পরবর্তীতে টিয়াংগং-কে বাণিজ্যিক উদ্দ্যেশ্যেও কাজে লাগানোর কথা ভাবছে চিন।

More Articles