প্রতিদিনের দূষণে দায় আছে আপনার পোশাকেরও, তাহলে উপায়!

পরিবেশ সংক্রান্ত  অজস্র প্রশ্নের বিশ্ববাসীর কাছে অধরা রেখেই ২০২১-এর নভেম্বরেই শেষ হল COP26। এই চুক্তি কতটা আশাপ্রদ হবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিধ্বংসী প্রভাব থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে, তা সত্যি-ই প্রশ্নের মুখে। তবে খুব বেশি সময় যে আমাদের হাতে নেই, তা দেরিতে হলেও আমরা বুঝতে শুরু করেছি, আর সেই জন্যেই ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে বিভিন্ন সংস্থা-এটুকুই ইতিবাচক।

এ যাবৎ আমরা ভেবে দেখিনি কী ভাবে জামাকাপড়ে বিপুল ভাবে ব্যবহৃত পলিমার (Polymer), পলিয়েস্টার (Polyester), নায়লন (Nylon) বা অন্যান্য প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের বিকল্প কী হতে পারে কিংবা এই পদার্থগুলোকেই আবার পুনর্ব্যবহারের (recycle) উপযোগী  করা যেতে পারে কি-না। এই দ্রব্যগুলিই কিন্তু যথেচ্ছভাবে জল এবং মাটির দূষণের কারণ। যতবারই ধোয়া হয় এদের থেকে মাইক্রোফাইবারের (Microfibre) আকারে, মাইক্রোপ্লাস্টিক (Microplastic) বের হয় আর জল, মাটি, এমনকী বাতাসে গিয়েও মেশে। ফলে এদেরকে বাতিল করে  ফেলে দেওয়ার পরে যে তা যথেচ্ছ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে বাদ যায় না সামুদ্রিক প্রাণী থেকে মানুষ, কেউই। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, শিশুদের মলে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দশগুণ বেশি পলিয়েস্টার (বা পলিইথিলিন টেরেফথ্যালেট) পাওয়া যায় মাইক্রোপ্লাস্টিক রূপে। শিশুদের দুধ খাওয়ার বোতল বা প্লাস্টিকের খেলনা ছাড়াও জামাকাপড় এবং বাতাসে ভাসমান মাইক্রোপ্লাস্টিক-এর অন্যতম উৎস।

দুই রক্ষক

নজর দেওয়া যাক  টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি বা বয়ন শিল্পের দিকে। কী ভাবে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি থেকে দূষণ হয়, কী ভাবে তা রোধ করার জন্যে এগিয়ে আসছে বিভিন্ন সংস্থা? এনএফডাব্ল্যু (NFW) নামের একটি সংস্থা ক্ল্যারাস (Clarus) নামের একপ্রকার সুতির কাপড় বানাচ্ছে। এই কাপড়গুলি বানানোর সময়, সুতির জৈব অংশ খানিকটা ভেঙে যায়, যার ফলে কাপড়টি আরও শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে। সুতোগুলির ঘনত্ব বাড়ে। এবং এর ফলে কাপড়টি সিন্থেটিক ফাইবারের মতই হয়ে ওঠে। ফলে খুব সহজেই সিন্থেটিক ফাইবার, পলিস্টার বা অন্যান্য পলিমার ব্যবহার না করে, কেবল জৈব পদার্থ থেকেই কাপড় তৈরি করা যায়। কী ভাবে ভাঙা হচ্ছে এই সুতির তন্তুগুলিকে (Cotton Fibre), উত্তর দিচ্ছেন মেটেরিয়ালসায়েন্টিস্ট এবং রসায়নবিদরা। এই কাজে ব্যবহার হচ্ছে বেশ কিছু আয়নিত তরল, যেগুলি মূলত গলিত লবণ। আর এই লবণই সুতোর তন্তুর মধ্যে অবস্থিত সেলুলোজকে ভেঙে, আর তারপরে সুতোর সেই তন্তুগুলোকে একটির সাথে আরেকটি পাশাপাশি জোড়া লাগিয়ে তন্তুগুলোকে সিন্থেটিক ফাইবারের রূপ দেওয়া হয়। এবং এরা হুবহু সিন্থেটিক ফাইবারের মতই কাজ করে।

এনএফডাব্ল্যুরই আরেকটি দ্রব্য মাইরাম (Mirum)। এটি চামড়ার উদ্ভিজ বিকল্প এবং এটি তৈরি করা হয় নারকেলের ছোবড়া, প্রাকৃতিক রাবার, কিংবা কর্ক থেকে। এই উদ্ভিজ দ্রব্যগুলো থেকে যখন চামড়ার অনুরূপ পদার্থ তৈরি করা হয়, তখন এদের আরও টেকসই বানানোর জন্যে কোনো পেট্রোকেমিক্যাল জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা হয় না। আর বর্তমানে যেহেতু চামড়ার বিকল্প হিসেবে পলিমারের ব্যবহারই যথেচ্ছ ভাবে হয়ে থাকে, তাই বলার অপেক্ষা রাখে না মাইরাম সেক্ষেত্রে কতটা পরিবেশ-বান্ধব হবে।

এত গেল প্লাস্টিক, পলিমার, পলিয়েস্টার প্রভৃতির বিকল্প পদার্থ ব্যবহারের আলোচনা। কিন্তু যে সমস্ত জামাকাপড়ে ইতিমধ্যেই পরিবেশের ক্ষতিকারক এই রাসায়নিকগুলি ব্যবহার হয়েছে তাদের পুনরুদ্ধার (Recycle) ও পুনর্ব্যবহার (Reuse) করাও তো জরুরি। কিন্তু তার উপায় কী?

দেখা যাচ্ছে, অনেক পোশাকেই সুতির সাথে মেশানো হয় পলিয়েস্টার বা পলি ইথিলিন টেরেফথ্যালেট। কখনও বা সুতির সাথে  মেশানো হয়, নায়লনও। যা কি-না পলিয়েস্টারের সাথে সমান পাল্লা দিয়ে সমুদ্রদূষণের দায়ে দোষী। পলিয়েস্টার, নায়লন, এক্রিলিক প্রভৃতি ন্যানোফাইবার (Nano-fibre) হিসেবে মিশতে থাকে সমুদ্রের জলে।

বিকল্পের খোঁজ

আর সেই অঘটনের হার কমাতেই এবার  এগিয়ে এসেছে সার্ক (Circ) নামে ভার্জিনিয়ার একটি সংস্থা। সার্ক পলিয়েস্টারের অণুগুলিকে ভেঙে ফেলার জন্যে থার্মাল হাইড্রোলাইসিস (Thermal Hydrolysis) নামের একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে চাপ এবং তাপের উপস্থিতিতে পলিয়েস্টার অণুগুলিকে ভেঙে এথিলিন গ্লাইকল (Ethylene Glycol) এবং টেরেফথ্যালিক অ্যাসিডে (Terephthelic Acid) পরিণত করা হয়। এথিলিন গ্লাইকল এবং টেরেফথ্যালিক অ্যাসিড দিয়েই তৈরি করা হয় পলিয়েস্টার। এই পদ্ধতিতে পল​য়েস্টারকে ভেঙে ফেললে এথিলিন গ্লাইকল এবং টেরেফথ্যালিক অ্যাসিডের মিশ্র তরল তৈরি হয়; যা কিনা আবার কাপড় তৈরির কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ক্ষতির খতিয়ান

বর্তমানে সুতির জামাকাপড়ের ব্যবহার যথেষ্ট কম। আমরা এখন যা পোশাক পরি, তার অধিকাংশই হয় সুতোর সঙ্গে প্লাস্টিক বা পলিমার মিশিয়ে তৈরি, নয়তো কেবল প্লাস্টিক বা পলিমার জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি। কেবল মাত্র এই জাতীয় পোশাক ধুলেই  নির্গত হয় প্রায় এক মিলিয়ন টনের অর্ধেক মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা প্রায় তিন বিলয়ন পলিয়েস্টার শার্টের সমান। আর এই মাইক্রোপ্লাস্টিক আণুবীক্ষণিক এককোশী জীব থেকে শুরু করে, খাদ্যস্তরের উপরের সারিতে থাকা বৃহৎ প্রাণীর শরীরেও পৌঁছে যায়, খাদ্যশৃঙ্খলের (Food Chain) নিয়মেই। আর সেখান থেকে খুব বেশি সময় লাগে না, আপনার, আমার কিংবা আমাদের বাড়ির শিশুটির শরীরে পৌঁছতে।

এবার বুঝি সময় হল আমাদের নড়েচড়ে বসার, অন্তত এই ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে। প্রশ্ন হল বহুজাতিক সংস্থাগুলি কবে পদক্ষেপ নেবে, কবেই বা আমরা প্রশ্ন করব সংস্থাগুলিকে যারা বিপুল ভাবে প্লাস্টিকজাত দ্রব্য কাপড়ে মেশায়। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে, যেখানে দূষণের হার পৃথিবীর অন্যা বহু দেশের তুলনায় অনেক বেশি। সুন্দর পোশাকের আড়ালে যে ঘাতক শক্তি আছে, তা নিয়ে ভাবার সময় বোধহয় এসে গিয়েছে।

More Articles