তাঁর থেকে লটারির টিকিট কিনে লাখপতি হয়েছে অনেকে, কিন্তু নিজে কেমন আছেন বিশ্বনাথবাবু?

অটো স্ট্যান্ডে একটা বড় গাছের গায়ে লটকে আছে গত বছরের কালীপুজোর একটা হোর্ডিং। শ্মশানকালী থিম হয়েছিল এক ক্লাবে, সামনেই, তারই বিজ্ঞাপন।

 

সোদপুরের নাটাগড়ে আমার মামাবাড়ি। দিদিমা যখন মারা গেলেন, তখন আমি অনেক ছোট। সেই সময় বাবা-মা-আমি-দিদি আর ভাই— মামাবাড়িতে গিয়ে অনেকদিন ছিলাম। অনেকদিন স্কুলে যেতে হয়নি। খুব আনন্দ হয়েছিল। তখন আমি মামাবাড়ির সামনের রাস্তায় বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় চলে গিয়ে হারিয়ে গেছিলাম একদিন। ভয় পেয়েছিলাম খুব। খুব কান্নাকাটি করে নিজে নিজেই খুঁজে খুঁজে আবার মামাবাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। কাউকে বলিনি। তখন থেকেই আমার মধ্যে দুটো ব্যাপার একেবারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। প্রথমটা হলো, আমি এই বয়সে এখনও, সেই থেকে স্বপ্ন দেখি, আমি হারিয়ে গেছি। কিছুতেই বাড়ি ফেরার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। একদম অচেনা একটা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। পথ খুঁজছি। পাচ্ছি না। কত কত পুরনো ভাঙা বাড়ি, সরু সরু গলি, অচেনা মানুষের মুখে চেয়ে চেয়ে আমি পাগলের মতো ছোটাছুটি করছি। চিৎকার করে বলতে চাইছি, আমি বাড়ি যাব… পারছি না বলতে। দিশাহীনভাবে কেবল ছুটে চলেছি।

 

দ্বিতীয় ব্যাপারটা হলো, সেই থেকে আমি একটা অদ্ভুত খেলা আবিষ্কার করেছি। খুবই ইন্টারেস্টিং। কী সেটা?

 

ধরুন, আমি চেন্নাইয়ের কোনও রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে একটা গলিতে ঢুকে গেলাম, তারপর বেরলাম একেবারে লখনউয়ের হজরতগঞ্জে। সেখানে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম গোধুলিয়া, বেনারস। গঙ্গার ধারে খানিকক্ষণ বসে আবার উঠে সোজা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম এই রাস্তায়। এখান থেকে আবার চলে গেলাম মামাবাড়ির সেই হারানো রাস্তায়। খানিকক্ষণ এদিকওদিক ঘুরে আবার চলে এলাম এখানেই। এখন যে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। এই রাস্তার ভালো নাম এনএন দত্ত রোড। নরেন্দ্রনাথ দত্ত রোড। বিবেকানন্দ নন। রাস্তার ডাকনাম কালীবাড়ি ব্রিজ। কলকাতা-৪০। আদিগঙ্গার ওপর ব্রিজ। সামনেই কালী মন্দির। বাসস্টপ গাছতলা, নেতাজী নগর। এখানে একটা খুব বড় ফ্ল্যাট হচ্ছে। চারদিকে অনেক ঘুরে ঘুরে সোজা এই ফ্ল্যাটের সামনেই হাজির হয়েছি। এইরকম বড় বড় ফ্ল্যাটকে চলতি ভাষায় বলা হয় প্রোজেক্ট। অবশ্য এই ভাষা কেবল নির্মাণের সঙ্গে যুক্তরাই ব্যবহার করে। সাধারণ জনগণ এটাতে অতটা সড়গড় নয়। ফ্ল্যাটের সর্বনিম্ন দাম ১ কোটি টাকা। এই মর্মে প্রোজেক্টের গায়ে একটা খুব বড় হোর্ডিং লাগানো রয়েছে। তাতে লেখা—

Luxury 3 BHK Flats
Starting at ₹1 crore.

 

আরও পড়ুন: শহরে পুতিনের বোমা আর পুরুতমশাইয়ের নৈবেদ্যর ফুল

 

 

কলোনির উপকণ্ঠে ফ্ল্যাটের দাম শুরু এক কোটি টাকা থেকে! হোর্ডিংটা আবার ভালো করে দেখলাম। বাপ রে! কলোনিরও তাহলে কর্পোরেটাইজেশন হলো! খুব ভালো, খুব ভালো! আর ক'দিন পর এখানে অষ্টপ্রহর নামসংকীর্তন হবে। এখানেই, কালীবাড়ির পাশে হরিসভা।

 

আমি ওই হোর্ডিংয়ের দিকে চেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কখন যেন সেই মুম্বইয়ের হাজি আলির দরগায় চলে গেলাম, তারপর রানির নেকলেস দেখলাম। তারপর বান্দ্রার বাড়িগুলো দেখলাম। ওখানে একটা বাড়ির উল্টোদিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। আরও অনেক লোক। ওই বাড়িতে থাকেন শাহরুখ খান। তিনি এখনই বাইরে বেরবেন। গেট খুলে যাবে। আমি আর বাকি লোকগুলো যেন আলিবাবা। সবাই মিলে অনবরত বলে চলেছি, চিচিং ফাঁক….
ওই যে গেট খুলে গেল।
ওই যে গাড়ি চলে গেল।
সবাই দাবি করল, সবাই তাঁকে দেখেছে। সবাই দাবি করল, তিনি তার দিকে তাকিয়েই হাত নাড়িয়েছেন। আমিও ভাবলাম, আমাকে কি দেখতে পেয়েছেন?

 

এখানেও ক'জন ঢুকে গেল প্রোজেক্টের গেট খুলে। খোলা গেটের ফাঁক দিয়ে একঝলক ভিতরে দেখলাম, ইট-পাটকেল-সিমেন্টের স্তূপ। অনেক গাছও দেখলাম। খুবই প্রশস্ত ভেতরটা। সারি সারি বাড়ি। ওগুলো ফ্ল্যাট। অনেক লোক ব্যস্ত হয়ে এদিকওদিক করছে। এইটুকুইমাত্র দেখতে দেখতেই গেটটা বন্ধ হয়ে গেল। কাঁধে বাঁক নিয়ে এক দইয়ালা চলে গেল আমার পাশ দিয়ে। সে, 'ডাকঘর' নাটকের মতো সুর করে না হোক, দই চাই দই বলেই হেঁকে চলে গেল। প্যান্ট, টি-শার্ট আর মাস্ক পরা আধুনিক, শহুরে দইয়ালা। চলে গেল এনএসসি বোস রোডের দিকে।

 

গাছতলা বাস স্ট্যান্ডে খুব বড় একটা অশ্বত্থ গাছ আছে। ওই গাছের তলায় ইটের ছোট্ট শনি মন্দির বাস রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার ওপারে, শনি মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে কর্পোরেশনের হেলথ সেন্টার। ওটা যাঁর বাড়ি ছিল, তিনি কর্পোরেশনকে বাড়িটা দান করেন। অনেক কাল আগের কথা। তাঁর মৃত্যুর পর, স্মৃতি রক্ষার্থে কর্পোরেশন এই রাস্তার নাম রাখে, এনএন দত্ত রোড।

 

গাছতলার শনি মন্দির থেকে কালীবাড়ি ব্রিজ পর্যন্ত এই রাস্তা, আমার সাড়ে তিনশো পা। আমি তিনবার গুনতে গুনতে হেঁটেছি। ভুল হয়নি।

 

গাছতলার ডানদিকে গড়িয়া। বাঁদিকে টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো। শনি মন্দিরের পাশেই রিকশা স্ট্যান্ড। এখান থেকে ব্রিজের দিকে কয়েক পা হাঁটলেই অটোরিকশা স্ট্যান্ড। অটোগুলো ব্রিজের ওপর দিয়ে যাতায়াত করে। ব্রিজের ওপারটা হলো কলকাতা-৭০। ব্রিজ থেকে নামলেই ডানদিকে হরিসভা। তারপর কালীবাড়ি।

 

প্রোজেক্টের উল্টোদিকে, ব্রিজের মুখে বাঁদিকে, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি তিন চাকার বিশেষ ধরনের সাইকেল রিকশায় লটারির টিকিট সাজিয়ে বিক্রি করতে আসেন এক বৃদ্ধ। প্রতিদিন আসেন। আমি এই রাস্তায় ওঁকে দেখছি অনেক দিন হলো। আজকে কথা বলতে গেলাম।

 

ভদ্রলোকের নাম বিশ্বনাথ ব্যানার্জি। ৪৪ নম্বর রুটের বাস চালাতেন। বাগুইআটি-হাওড়া। পাঁচ বছর আগে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে বাঁদিকটা অসাড় হয়ে যায়। সেই থেকে হাঁটাচলা করতে পারেন না। পরিস্কার করে কথা বলতে পারেন না। তাঁর অসুস্থতার পর-পরই স্ত্রীও মারা গেলেন। দুই ছেলে আছে। তারা বিশ্বনাথবাবুর সঙ্গে থাকে না। তাঁর নিজের বলতে এখন এই রিকশা গাড়ি। কালীবাড়ি ব্রিজের কাছে রোজ সকালে চলে আসেন লটারির টিকিট নিয়ে। এক সহৃদয় ব্যক্তি লটারির টিকিট কিনে দেন। টিকিট বিক্রি হোক না হোক, প্রতিদিন ২০০ টাকা করে দেন বিশ্বনাথবাবুকে।

 

অনেক কষ্ট করে, অনেকটা সময় নিয়ে এই কথাটুকু বলতে পারলেন তিনি। তারপর চুপ করে গেলেন। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলেন। আর ডান হাতটা দিয়ে কপালে মৃদু মৃদু আঘাত করতে লাগলেন। আমিও চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ খানিকক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। ফাল্গুন মাসের রোদ্দুরও আমার গায়ে একটা গাছের ছায়া ফেলে আমার সঙ্গেই হাজির থাকল। একজন ক্রেতাও এল না। বিশ্বনাথবাবু ডান হাতের তর্জনী দিয়ে লটারির টিকিট ইঙ্গিত করে অস্পষ্ট ভাবে বললেন, আজকে বাজার ভালো না।

 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কখনও লটারির টিকিট কিনেছেন?

 

প্রবল বেগে মাথা নাড়তে লাগলেন তিনি। আমি বললাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে। শান্ত হোন। এক গোছা টিকিট হাতে তুলে বললেন, জুয়া খেলা এটা। আমি খেলি না।

 

আমি বললাম, আপনার টিকিটে কেউ লটারি পেয়েছে?

 

বললেন, দু'লাখ একবার। সাড়ে চার লাখ একবার। নব্বুই হাজার একবার। আরও আছে।

 

আমি বললাম, এত লোক তো পেয়েছে, আপনিও একটা নিজের জন্য রাখতে পারেন।

 

বললেন, না। আপনি কাটুন টিকিট।

 

আমি বললাম, আমি লটারি খেলি না।

 

বললেন, আমিও না।

 

আমি বললাম, বেশ।

 

তারপর আঙুল উঁচিয়ে এক কোটি টাকার ফ্ল্যাটের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, ওই যে দেখেছেন, এক কোটি টাকা একেকটা। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন বললেন। বুঝতে পারলাম না একবর্ণও।


তর্জনী উঁচিয়ে এক বলার চেষ্টা করলেন। আমি বললাম, এক কোটি টাকা। মাথাটা দু'দিকে নাড়িয়ে হোর্ডিংটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।


১৪২৯ বাংলা বছরের বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকার ২৩ পৃষ্ঠায় একজন 'তন্ত্র ভৈরব' জ্যোতিষী বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছেন, 'সাঁওতালী পুতুলতন্ত্রে অভিনয় জগৎ ও লটারি প্রাপ্তি'। এই বিজ্ঞাপনের কথা বললাম ওঁকে। বললাম,সিনেমা-সিরিয়ালে চান্স পেতে আর লটারির প্রাইজ পেতে জ্যোতিষীর কাছে যেতে হয় এখন। এইরকম ব্যবস্থাও হয়েছে। বুঝলেন বিশ্বনাথবাবু!

 

শুনলেন সবটা। কিছু বললেন না।

 

আমিও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছু বলার মতো খুঁজে পেলাম না। এরই মধ্যে একজন সাইকেল থামিয়ে নেমে, লটারির টিকিট দেখতে শুরু করলেন। আমি হাঁটা দিলাম। বিশ্বনাথবাবু আমাকে হাতের ইশারায় দাঁড়াতে বললেন। দাঁড়িয়ে গেলাম। আমাকে কাছে আসতে বললেন। এগিয়ে গেলাম ওঁর কাছে। ডান হাতের তিনটে আঙুল দেখিয়ে বললেন, একজন ডাক্তার ওই ফ্ল্যাট তিনটে বুক করেছে। বাঙালি ডাক্তার। তিন কোটি। বলে, অদ্ভুতভাবে হাসলেন। এবং কেন কে জানে, দুহাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করলেন আমাক। আমিও প্রতিনমস্কার জানালাম।

 

কালীবাড়ি ব্রিজ টপকে ওপারেই আমার যাওয়ার কথা, কিন্তু আমি আবার গাছতলার দিকেই চললাম। কেন জানি না। আবার আমি একা। সূর্য এখন মাথার ওপর।

 

হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, আমাকে নমস্কার করলেন কেন বিশ্বনাথবাবু? তিনিও কি আমাকে বিদ্রুপ করলেন? আমার অভাব আছে ঠিকই, কিন্তু ওঁর অবস্থা তো আমার থেকেও খারাপ। অনেক খারাপ। তাও আমাকে বিদ্রুপ করলেন! না কি? সত্যিই কি তাই? বিদ্রুপ করলেন কি? আর আমার থেকেও খারাপ অবস্থা কি? সব তালগোল পাকিয়ে গেল। কিন্তু ওঁকে যে কাঁদতে দেখলাম, কেন? এবার কি আমার কাঁদার পালা?

 

বিশ্বনাথবাবু কাঁদলেন-হাসলেন এবং নমস্কার করলেন— কেন? আমার হাঁটা থেমে গেল। নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সামনে একটা ফলের দোকানে নানা রঙের ফল সাজানো। সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিকটা সময় পর হঠাৎ যেন, সব রং দোকানের সব ফল ছেড়ে উড়ে চলে গেল। মুহূর্তে আমি দেখলাম, দোকানে সাজানো সব ফল কেমন বিবর্ণ হয়ে গেল। কেমন যেন বহু পুরনো ফোটোগ্রাফের মতো হয়ে গেল। যেন প্রাচীন একটা স্টিল লাইফ। আবছা হয়ে গেছে। আমার আবার অস্থির অস্থির লাগা শুরু হবে এখনই। ওহ্! অসহ্য।

 

এই রাস্তার পাশে, কালীবাড়ি ব্রিজের ওপার থেকে গাছতলা পর্যন্ত এগারো জনের লটারির টিকিট বিক্রির টেবিল আছে, বিশ্বনাথবাবুকে ছাড়াই। সবার টেবিলেই কালীঘাটের কালী বা তারাপীঠের তারার ছবি আছে। এইরকম ছবি মুরগি কাটার দোকানেও থাকে। কেন? লটারির টিকিট, মুরগির মাংস আর তারা এবং কালী— এদের মধ্যে কি কোনও সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছে কারবারিরা? কে জানে?

 

অটো স্ট্যান্ডে একটা বড় গাছের গায়ে লটকে আছে গত বছরের কালীপুজোর একটা হোর্ডিং। শ্মশানকালী থিম হয়েছিল এক ক্লাবে, সামনেই, তারই বিজ্ঞাপন। শ্মশানকালীর একটা বড় ছবি আছে ওই হোর্ডিংয়ে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে কালী। হঠাৎ আমার মনে হলো, আমাকে দেখছে। আমার দিকেই চেয়ে আছে। ভয় লাগানো দৃষ্টি। অকম্পিত চোখের পাতা। ভয়ংকর জিভটা দাঁতে কামড়ে যেন চরাচরের সবকিছু একেবারে স্তব্ধ করে দিয়েছে। সব বাচালতা, সব প্রগলভতা এক নিমেষে থেমে গেছে। সেই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ থেকে এই কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত পর্যন্ত সমস্ত হম্বিতম্বি এক মুহূর্তে যেন শুনশান হয়ে গেছে। আমি যেন আর নড়তে পারছি না। ওই দৃষ্টি আটক করেছে আমাকে। মাথাটা দপদপ করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। হাত পা কাঁপছে। শরীরটা পলকা হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। আমি যেন ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছি। কোথায় যেন ভেসে যাচ্ছে আমার শরীরটা। যেন উড়ে যাচ্ছে। আমি আর আমাকে ধরে রাখতে পারছি না। চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি যেন অচৈতন্য হয়ে যাব এবার।

 

মা গো…

 

সব শক্তি দিয়ে, প্রচণ্ড জোরে চোখ দু'টো-কে খুলে কালীর দিকে চেয়ে, শরীরটাকে দু'দিকে ঝাঁকিয়ে নিলাম বেশ কয়েকবার। হাত পা দু'টো ঝাড়লাম খানিকক্ষণ। সারাটা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। একটা চায়ের দোকানে গিয়ে জল খেয়ে, গাছের তলায়, ছায়ায় দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ফাল্গুন মাসের রোদ্দুর‌ও আমার সঙ্গে ঐক্যে অটুট রইল। রাস্তার পাশে একটা বাগানের রেলিংয়ের গায়ে একটু সিমেন্টের বেঞ্চমতো করা আছে। সেখানে বসলাম। মাথাটা পিছনের দিকে হেলিয়ে দিলাম। চোখটা এবার আমিই বন্ধ করলাম। বসে রইলাম। ধীরে ধীরে আশপাশের লোকজন, চলাচল, শব্দ— সব কিছু ঝাপসা হতে শুরু করল। তারপর স্লো মোশন হয়ে গেল। আমায় আর কেউ স্পর্শ করতে পারবে না এখন। এই অবস্থায় আমি সর্বক্ষণ থাকতে চাই। কিন্তু বেশিক্ষণ এমন থাকে না। আমাকে আবার কে যেন একটা লাথি মেরে আমার অভাবের মধ্যে এনে ফেলে।

 

কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। খিদে পেয়েছে খুব। একটা অটোতে উঠে বসলাম। আরও তিনজন হলে ছাড়বে। এখান থেকে কালীতলা জয়শ্রী সংঘ পর্যন্ত দশ টাকা ভাড়া। ওখানেই যাব। কালীবাড়ি ব্রিজ টপকে ওপারে গিয়ে ডান হাতে খানিকটা এগিয়ে বাঁ দিকে সোজা জয়শ্রী। আমার মনে পড়েছে একটা কথা।

 

অটো স্ট্যান্ডের উল্টোদিকে স্পেনসর-এর দোকান। ওখানে একটা দৃশ্য ধ্রুবক—

 

কেউ না কেউ ট্রলিতে করে পাহাড়-পর্বত-জঙ্গল-নদী কিনে গর্বিত ভঙ্গিতে বাচ্চা নিয়ে, দোকানের বাইরে বেরিয়ে ড্রাইভারকে ফোনে ডাকছে।

 

সকলেই এই বেচাকেনার হাটে এমন গম্ভীর মুখ করে থাকে, যেন মনে হয়, ওয়াটসন আর ক্রিক ডিএনএ-র স্ট্রাকচার কেমন তা সেমিনার হলে বলতে যাচ্ছেন।

 

অটো ছেড়েছে।

 

আমার গন্তব্য কালীতলা। জয়শ্রী।

More Articles