জাহাজে টাটার সহযাত্রী, ভারতের বিজ্ঞান গবেষণার রূপরেখা বদলে দিয়েছিলেন স্বামীজি

বড় একটা টেবিল। প্রচুর খাবার রাখা হয়েছে রীতি অনুসারে। সম্মানীয় অতিথিরা সকলেই রয়েছেন। তিনজন বিদেশির মাঝে বসে রয়েছেন এক ভারতীয় পার্শী ভদ্রলোক। একটা মাংসের টুকরো মুখে পুরে আয়েশ করে চিবাতে চিবাতে বার্ডউড বললেন, “বুঝলেন মিঃ টাটা, টাকাটা আপনি র‍্যামসেকেই দিন। তাছাড়া তো আর উপায় দেখছি না।” জর্জ বার্ডউড তখন শিক্ষাবিভাগের হর্তাকর্তা। জামশেদজী টাটার দিকে কিছুটা বিদ্রুপ ছুঁড়ে দিয়ে সাহেব ঘুরলেন নিবেদিতার দিকে। মুখে তখনও মাংসের টুকরোটা পুরোপুরি চিবানো হয়নি। ভরা মুখের ফাঁক দিয়ে অতি কষ্টে যে শব্দগুলো নিবেদিতার দিকে ছুঁড়লেন তা এইরকম, “আরে ভারতে ইংরেজ শাসন তো আর ভারতবাসীর উন্নতির জন্য নয়, বরং ইংল্যাণ্ডের সুবিধার্থেই। আর ভারতের লোকেরা নিরামিশাষী, কিছু না পেলে রেগে গিয়ে যে কিছু করে বসবে, সে সম্ভাবনাই নেই। তাতে আরো সুবিধা।”

এই বৈঠকের কথা নিবেদিতা, জগদীশচন্দ্র বসু ও অবলা বসুকে লেখা এক চিঠিতে জানাচ্ছেন ১৯০০ সালে। তখনও সশস্ত্র সংগ্রাম আমরা দেখছি না জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে। নিবেদিতা তখন উঠেপড়ে লেগেছেন টাটার পরিকল্পনাকে সফল করে তুলতে। বিশেষত যদি সত্যিই এই পোস্ট গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ ইন্সটিটিউট স্থাপিত হয়, তবে জগদীশ বসুর মতো যোগ্যতর লোক রয়েছে। অধ্যাপক হিসেবে তাঁকেও সঙ্গে নেওয়া যাবে। কয়েকটা অশিক্ষিত সাহেব তখন জগদীশচন্দ্রের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে। এই সমস্ত ভেবেই এই ভোজনের আয়োজন। অথচ কথাটা পেড়ে ওঠা যাচ্ছে না বার্ডউডের হাবেভাবে। নানা আবোলতাবোল কথার মধ্যে জোর চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত নিবেদিতা প্রস্তাবটা করেই ফেললেন। একে সম্পূর্ণ ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তার উপর সেখানে ভারতীয় অধ্যাপক নিয়োগের প্রসঙ্গ উঠতেই হাওয়া ঘুরে গেল।

ইংল্যাণ্ডের শুভাকাঙ্ক্ষী বার্ডউডের দায়িত্ববোধ হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে। উদার বিশ্বমানবিকতায় একপ্রকার আক্রান্ত হয়েই বললেন, “বিজ্ঞান তো আর ভারতীয় নয়, ওটি হল গিয়ে আন্তর্জাতিক একটা বিষয়। সুতরাং গোটা বিশ্বের দরজা সেখানে খোলা রাখতেই হবে। আর টাটা যদি টাকাটা সরকারকে না দেন, তাহলে তো কিছুই বলা যাচ্ছে না।” আরও খানিকটা রসালো মাংসের টুকরো তুলে নিলেন সাহেব। নিবেদিতার চোয়াল শক্ত হল। “আর তাছাড়া” তখনও চালিয়ে যাচ্ছেন বার্ডউড “মাদ্রাজ, বোম্বাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো ঠুঁটো! কলকাতার কথা না হয় বাদই দিলাম, ওদিকে তো চোখ তুলে তাকানো যায় না।”

নিবেদিতার চোখে ঝিলিক খেলে গেল, “তাহলেই বুঝুন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো সরকারই চালাচ্ছেন, তবে এই হালের দায় কাদের? কোন ভরসায় অতগুলো টাকা মি. টাটা সরকারের হাতে তুলে দেবেন বলুন তো?” বাইরের বল খেলে ফেলেছেন বুঝে প্রমাদ গুণলেন সাহেব, তর্ক করলেন গত ৫০ পঞ্চাশ বছরে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাকি শিল্প, সাহিত্যে বা বিজ্ঞানে কোনও উল্লেখযোগ্য নাম বেরোয়নি। পাঠক জেনে আশ্চর্য হবেন, আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস তখন ইংল্যাণ্ডে। অথচ কথাগুলো বার্ডউড বলে গেলেন নির্বিকার ভাবে। নিবেদিতা তাকে মনে করিয়ে দিলেন, অথচ রয়াল সোসাইটি ইতিহাসে এই প্রথমবার ক্রিসমাসের ছুটির সম্পূর্ণ সময়ের জন্য ফিজিক্সের এক ভারতীয় অধ্যাপককে স্বাগত জানিয়েছিল। বহুযুক্তিতেও লাভ হল না কিছু। সাহেব তার সাহেবি গোঁ ধরে বসে থাকলেন। তবে স্বামীজির অন্যতম শিষ্যা নিবেদিতাকে হতোদ্যম করার শক্তি তার ছিল না।

আরও পড়ুন-‘শেষে সব আকাশে মিলায়’: বিবেক-অনুধ্যান

উপরোক্ত ঘটনার বীজ কিন্তু বোনা হচ্ছিল বছর সাতেক আগে। বিবেকানন্দ তখন অখ্যাত এক সন্ন্যাসী মাত্র। পরিচয়পত্র নেই। সেইভাবেই চলেছেন আমেরিকা। শিকাগোর ধর্মসভায় যোগ দিতে। ২৫শে জুলাই সন্ধ্যায় সে জাহাজ ইয়াকোহোমা থেকে ভ্যাঙ্কুবরে পৌঁছয়। সমকালীন সংবাদপত্রে জানা যাচ্ছে, ‘এমপ্রেস অব ইন্ডিয়া’ জাহাজের যাত্রীদের মধ্যে “মিঃ এস বিবস্‌কানন্দ্র” এবং জামশেদজী টাটাও রয়েছেন। তবে টাটার সঙ্গে স্বামীজির মোলাকাত সম্ভবত তার আগেই। সে আলাপ জাপানের দেশলাই কারখানা দেখতে গিয়েও হতে পারে, আবার ওরিয়েন্ট হোটেল রেস্টুরেন্টে থাক্র সময়েও হতে পারে। সেই পরিচয়ই আরও গভীর হয় এই সমুদ্র যাত্রায়।

সেকালে আবহাওয়া খুব ভালো থাকলে দিন বারো সময় লাগত জাপান থেকে ভ্যাঙ্কুবর যাত্রায়। জাহাজের ডেকে নানা বিষয়ে গল্প করতে করতে জামশেদজীকে স্বামীজি বললেন, “জাপান থেকে দেশলাই নিয়ে গিয়ে দেশে বিক্রয় করে জাপানকে টাকা দিচ্ছ কেন? তুমি তো সামান্য দস্তুরী পাও মাত্র। এর চেয়ে দেশে দেশলাইয়ের কারখানা করলে তোমারও লাভ হবে, দশটা লোকেরও প্রতিপালন হবে এবং দেশের টাকা দেশে থাকবে।” টাটা সে মুহূর্তে এসব উপদেশ খুব একটা গা করেননি। বছর তিরিশের এক অখ্যাত সাধু, সে আবার উপদেশ দিচ্ছে টাটার মতো বিখ্যাত ঝানু ব্যবসায়ীকে— অসুবিধার কথা বলে বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমেরিকার বক্তৃতার ব্যাপক ঢেউ এল সাগর পেরিয়ে স্বদেশে। লোকের মুখে মুখে তখন স্বামীজির নাম ফিরছে। এই ঝড় নজর এড়াল না টাটার। এর বহুদিন পরে ১৯০১ নাগাদ নিবেদিতাকে এক চিঠিতে টাটা জানাবেন, স্বামীজি জাপানে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে বুদ্ধের সাদৃশ্যে অনেকেই নাকি চমকে উঠত।

সেই ঝড় পেরিয়ে গিয়েছে বেশ কিছুদিন হল। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ভারতবাসীর নিরন্ন মুখে খাবারের দানা তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন স্বামীজি। চলছে মঠের কাজও। ১৮৯৮ সালে আরেকটা খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। এইবার কেন্দ্রবিন্দু জামশেদজী টাটা। স্নাতকোত্তর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য তিনি তিরিশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি উপযুক্তভাবে গঠিত একটা কমিটির হাতে দিতে চাইলেন। এর থেকে বার্ষিক আয় হবে সওয়া লক্ষ টাকা। এবং এই গবেষণাগার হবে সম্পূর্ণরূপে ভারতীয়। জার্মান সেমিনারিয়া, ফ্রেঞ্চ কনফারেন্স, আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডের গবেষণার ক্লাসগুলির পদ্ধতি অনুসরণ করবে এই প্রতিষ্ঠান। ভারতের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও এর কোনও বিরোধ হবে না, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা যেখানে শেষ, সেখানেই শুরু করবে এই প্রতিষ্ঠান। উনিশ শতকের শেষ দিকে তিরিশ লক্ষ টাকার অঙ্কটা সহজেই অনুমেয়। আর প্রস্তাবটা এমন সময় এল যখন ভারতে শিক্ষাসংকোচের জন্য সরকারী উদ্যোগ চলছে। ব্যাপারটা ব্রিটিশ সরকার খুব ভালো ভাবে নিল না। দেশি পুঁজির বিকাশ সম্বন্ধে এমনিতেই তারা সতর্ক। এর মধ্যে লোকপ্রিয়তা বেড়ে গেলে প্রতাপ বাড়বে সেই পুঁজির। এমনকি সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকেও এগোতে পারে ভারত। কাজেই সরকারি তরফ থেকে এই প্রস্তাব বাতিল করার চেষ্টা জোরদার হয়ে উঠল।

তদানীন্তন 'বেঙ্গলী' পত্রিকা জানাচ্ছে, লর্ড কার্জন সহানুভূতিশীল সন্দেহ প্রকাশ করেছেন প্রস্তাবটি সম্পর্কে। যথেষ্ট সংখ্যক ছাত্র কি পাওয়া যাবে? কয়েকটা ফাঁকা বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে মোটা মাইনের অধ্যাপকদের মাথা কাটা যাবে না? এই ছিল বলার ভঙ্গি। তিনি বলছেন, এখন তো ভারতীয়রা এমনিই চাকরি পাচ্ছে না, তা এই প্রতিষ্ঠান থেকে দিগগজ হয়ে যাঁরা বেরোবেন, তাঁরা চাকরি পাবেন কোথায়? মি. জাস্টিস ক্যান্ডি বুদ্ধি দিচ্ছেন যে এখন শুরু হোক যেমন তেমন করে, পরে পরিকল্পনা বাড়ানো যাবে। বেঙ্গলীতেই পাওয়া যাচ্ছে এই সময়ে মহীশূরের দেওয়ান কিন্তু তাঁর রাজ্যের পক্ষ থেকে সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করছেন এই প্রকল্পে। কিন্তু ভাইসরয় টলছেন না। উপরন্তু মহীশূর সরকারকে পরামর্শ দিয়ে প্রতিশ্রুতি বাৎসরিক এক লক্ষ টাকা থেকে নামিয়ে আনছেন তিরিশ হাজার টাকায়। উল্টোদিকে মন্তব্য করছেন টাটার দেওয়া টাকা যথেষ্ট নয়, এই ধরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গেলে আরো অর্থের প্রয়োজন। র‍্যামসের রিপোর্টেও সেই একই কথা ঘুরে ফিরে এল।

টাটা প্রমাদ গুনলেন। শোনা গেল টাটা প্রস্তাব প্রত্যহার করে নেওয়ার কথা ভাবছেন। 

এদিকে স্বদেশ ভ্রমণের সময় দেশের দুর্দশা অভাব অনটন খুব কাছ থেকে দেখেছেন স্বামীজি। দেখেছেন আর যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন। মানুষের এই সীমাহীন দুর্গতি মোচনের উপায় ভেবেছেন। কাজেই অর্থনৈতিক দুর্গতির বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য শিল্পায়নের পদ্ধতির গুরুত্ব শিখে এদেশের মাটিতে স্বতন্ত্র ইন্দাস্ট্রি গঠনের কথা বারবার উঠে এসেছে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে। আমেরিকার ভাষণেও দেখা যাচ্ছে তিনি সন্ন্যাসীদের সংগঠিত করে শিল্প-জ্ঞানে শিক্ষিত করে তুলতে চাইছেন। তাতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে। লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ উঠে আসছে তাঁর দৃঢ় সঘোষ কণ্ঠস্বরে। বলছেন, আমেরিকানরা ভারতে ধর্মশিক্ষাদানের জন্য মিশনারি না পাঠিয়ে জনগণকে শিল্পশিক্ষা দিতে পারবে এমন লোক পাঠালেই ভালো। এর বহুদিন পরে যখন ভারতে সত্যিই সন্ন্যাসী-সংঘ গঠন করতে সমর্থ হলেন, তখনও এই চিন্তাভাবনা তাঁর ছিল। রামকৃষ্ণ মিশনের কর্মাদর্শের যে খসড়া তিনি তৈরি করলেন, তার দুটি ধারা ছিল—

“এখন উদ্দেশ্য এই যে, এই মঠটিকে ধীরে ধীরে একটি সর্বাঙ্গসুন্দর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করিতে হইবে। তাহার মধ্যে দার্শনিক চর্চা ও ধর্মচর্চার সঙ্গে সঙ্গে একটি পূর্ণ টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট করিতে হইবে। এইটি প্রথম কর্তব্য, পরে অন্য অব্যব ক্রমে-ক্রমে যুক্ত হইবে।"

“মধ্যভারতে হাজারিবাগ প্রভৃতি জেলার নিকট উর্বর, সজল, স্বাস্থ্যকর অনেক ভূমি এখনও অনায়াসে পাওয়া যাইতে পারে। ঐ প্রদেশে এক বৃহৎ ভূমিখণ্ড লইয়া তাহার উপর একটি বৃহৎ শিল্প-বিদ্যালয় ও ধীরে ধীরে কারখানা ইত্যাদি খুলিতে হইবে। অন্নাগমের নূতন পথ যেমনই আবিস্কৃত হইতে থাকিবে, লোক তেমনই উক্ত উপনিবেশে আসিতে থাকিবে।”

জামশেদপুরে টাটার কারখানা স্বামীজির এই ইচ্ছেপূরণ করেছিল। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে মধ্যভারতের এই ভৌগোলিক সমৃদ্ধির কথা সন্ন্যাসী জানলেন কীভাবে? টাটা যখন আকরিক লোহার খোঁজ করছিলেন, তখন একটি সার্ভে ম্যাপ তাঁর নজর কাড়ে। এই ম্যাপটি করেছিলেন প্রমথনাথ বসু। মধ্যপ্রদেশের দুরগ্‌ অঞ্চলে প্রচুর আকরিক লোহার সন্ধান দেন প্রমথ। তাঁরই সাহায্যে ময়ূরভঞ্জ অঞ্চলে নতুন খনির সন্ধান পান টাটা। সেখানেই টাটা কারখানা গড়ে ওঠে। এই প্রমথনাথ বসুর সঙ্গে স্বামীজির সম্ভবত পরিচয় ছিল। কারণ ১৮৯৪ নাগাদ তিনি ‘ইন্ডিয়ান সিভিলাইজেশন আন্ডার ব্রিটিশ রুল’ নামে একটা বই লিখে ফেলেছেন যাতে রামকৃষ্ণ আন্দোলনের বিস্তৃত উল্লেখ ছিল। সেই সময়েই দুজনের আলাপ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। বিশুদ্ধ বিজ্ঞানচর্চায় প্রচণ্ড উৎসাহ ছিল স্বামীজির। কারণ বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের অগ্রগতি না ঘটলে এগোবে না কারিগরি বিদ্যাও। লক্ষ লক্ষ মানুষের খিদের সমস্যার কোনও মীমাংসা হবে না তাতে। নিবেদিতার  মিসেসে হ্যামণ্ডকে লেখা চিঠিতে দেখা যাচ্ছে মঠের খরচপত্র চালানোর জন্য স্বামীজি শিল্পদ্রব্য তৈরির কথা বলছেন, বিদ্যালয়ের মেয়েদের জন্য জ্যাম তৈরির কথা বলছেন। ‘থ্রুপ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউশন’ সম্বন্ধেও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল।

 

সরকারি বিরোধিতার চোটে টাটা বুঝলেন মানুষের সমর্থন ছাড়া তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। বিশেষত বিবেকানন্দের শিল্পভাবনা তাঁর অজ্ঞাত ছিল না। তাই ১৮৯৮ সালের ২৩শে নভেম্ভর, স্বামীজির সমর্থন চেয়ে তাঁর সেই বিখ্যাত চিঠি। চিঠিতে টাটা স্বীকার করেছেন সেই জাপান থেকে চিকাগোর পথে স্বামীজির উপদেশ তাঁকে প্রভাবিত করেছে। অকুণ্ঠ ভাবে ধর্ম ও বিজ্ঞানের পাশাপাশি অগ্রগতির লড়াইয়ে স্বামীজিকে সেনাপতির আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছেন টাটা। জনসাধারণকে উদ্দীপিত করার জন্যে একটি পুস্তিকা প্রচারের পরামর্শও দিয়েছেন। ব্যয়ভার সমস্ত উনিই বহন করবেন। সেই প্যামফ্লেটে সরাসরি টাটার প্রস্তাবের সমর্থন প্রচার কখনও বিবেকানন্দ করেছিলেন কিনা জানা যায় না। কিন্তু প্রবুদ্ধ ভারতের এপ্রিল ১৮৯৯ সংখ্যায় তাঁর নির্দেশে অথবা তাঁর দ্বারাই হয়তো যে লেখা বেরিয়েছিল, উচ্চকিত আবেগের সঙ্গে তা টাটার প্রস্তাব সমর্থন করে। সেখানে বলা হয় পোস্ট গ্রাজুয়েট ইউনিভার্সিটি গঠনের প্রস্তাব অত্যন্ত ‘সময়োচিত’ এবং ‘সুদূরপ্রসারী ফলপ্রদ’। “যদি ভারতকে বাঁচতে ও উন্নতি করতে হয়, যদি পৃথিবীর মহান জাতিসমূহের মধ্যে ভারতীয় জাতিকে স্থানলাভ করতে হয়, তাহলে প্রথমেই খাদ্যসমস্যার সমাধান করতে হবে আর এই তীব্র প্রতিযোগিতার দিনে ঐ সমস্যার সমাধান একমাত্র হতে পারে–মানবজাতির দুই প্রধান অন্নদাতা–কৃষি ও বাণীজ্যের অন্ধিসন্ধিতে আধুনিক বিজ্ঞানের অনুপ্রবেশের দ্বারা।”

এমনকী সরকারের সমালোচনা করে তাতে পরিষ্কার জানানো হচ্ছে, “কারো-কারো কাছে পরিকল্পনাটি কল্পনাবিলাসে পূর্ণ, কারণ এর জন্য বিপুল অর্থ প্রয়োজন, অন্তত ৭৪ লক্ষ টাকা। এই আশঙ্কার উপযুক্ত উত্তর : যদি একজন মানুষ, যিনি আবার দেশের সর্বাধিক ধনী ব্যক্তি নন, একলা ৩০ লক্ষ টাকা দিতে পারেন, তাহলে অবশিষ্ট দেশ কি বাকি অর্থ জোটাতে পারে না? ওহেন চিন্তা করা কি বিসদৃশ ব্যাপার হবে না–যখন আমরা এই পরিকল্পনার বিশাল গুরুত্বের কথা জানি।” আবার সমগ্র ভারতের কাছে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার আবেদন রেখেছে সম্পাদকীয়টি।

সাকুল্যে আরও বার দুয়েক এই পরিকল্পনার বিষয়ে লেখে 'প্রবুদ্ধ ভারত'। ১৯০১ সালের মার্চ সংখ্যায় ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিরক্ষা বিষয়ে মন্তব্য করা হয়–টাটা-পরিকল্পনাকে সমর্থন করলেই ও কাজ সর্বোত্তমভাবে করা হবে। এবং পরের বছর মার্চ সংখ্যায় সরকার কোন আকারে পরিকল্পনাটি গ্রহণ করছেন তার খবর ছিল। ব্যাঙ্গালোরে প্রতিষ্ঠিত হবে, ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ’-এর পরিবর্তে নাম হবে ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স’; এতে তিনটি ধারার শিক্ষা ও গবেষণা চলবে, রসায়ণ, ফলিত পদার্থবিদ্যা এবং জীববিদ্যা, প্রতিটি বিভাগে তিনজন প্রফেসার ও তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর থাকবে—ইত্যাদি নানা খবর সেখানে ছিল।

১৯০২ সালে স্বামীজি মারা গেলেন। তার বছর দুয়েক পরে টাটা। বহুলোকের নিরন্তর প্রচেষ্টায় স্বপ্ন তাঁদের সত্যি হয়েছিল। তারপর ভারত স্বাধীন হয়েছে। আজ কেটে গেল প্রায় পৌনে শতাব্দীকাল। একদা এক অখ্যাত সাধুর কিছু পরিকল্পনা যে স্বপনের বীজ বুনেছিল চিকাগোর পথে যাওয়া জাহাজের ডেকে তারই ফুল ফল ছড়িয়ে পড়েছে আজ ভারত ছাড়িয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। শুধু খেলাঘরের আয়োজকদ্বয় এ পরিণতি দেখে যেতে পারলেন না। এই আক্ষেপটুকু বুকে রেখে এক সমুদ্র নোনা জল রোজ নিভু নিভু বিকেলের কোলে লাল থেকে গাঢ় লাল হয়ে আসে ক্রমে।

 

ছবিঋণ–উইকিমিডিয়া ও ট্যুইটার

তথ্যঋণ-

“An Institute for the Nation: Vivekananda and Nivedita’s Role in the IISc’s Making.” n.d. The Wire. 

“How Swami Vivekananda’s Meeting with Jamsetji Tata Changed India’s Scientific Vision.” n.d. Get Bengal.

“Meeting Aboard The Empress of India | Tata Group.” 

“What Connects Vivekananda and Jamsetji Tata? A Sea Voyage That Changed India!” 2018. The Better India. January 12, 2018.

 বিবেকানন ও সমকালীন ভারতবর্ষ (পঞ্চম খণ্ড), শঙ্করীপ্রসাদ বসু, মণ্ডল বুক হাউস

More Articles