ওয়ান অ্যান্ড ফ্রি– ক্রীড়াক্ষেত্রে জাতীয়সঙ্গীত, অস্বীকার এবং বিতর্কের নেপথ্যে

“When Lieutenant James Cook first set foot on indigenous land ... he said ‘oh, let’s put a flag up somewhere, because these people are illiterate, they’ve got no fences’. They didn’t understand that we didn’t need fences.” – অস্ট্রেলিয় ধারাওয়াল উপজাতির বৃদ্ধ বেরিল বেল্লার অনেকটা সলিলোকি ধরনেই কথাগুলো ছুড়ে দিয়েছিলেন স্মিথসোনিয়ান পত্রিকার এক সাংবাদিককে। প্রেক্ষিত? ৫ জানুয়ারি, ২০২১। কী হয়েছিল সেদিন? বলব। তার আগে, একটু স্পট জাম্প করে চলে যাই ২০১৯-এর ৫ জানুয়ারি। ঠিক দু’বছর আগে। অস্ট্রেলিয়ার রাগবি লিগ মরশুম স্টেট অফ অরিজিন শুরু হচ্ছে সেদিন। সানকর্প স্টেডিয়ামে নিউ সাউথ ওয়েলস এবং কুইন্সল্যান্ড চেম্বার্স দলের খেলা। হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে দু’দলের ৩৪ জন। জাতীয় সঙ্গীত। পূর্বপরিকল্পনামতো ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে থাকলেন কডি ওয়াকার, জোস অ্যাডো-কার এবং উইল চেম্বার্স। পাশে পেলেন নিজের দলের পেইন হাস ও ল্যাট্রেল মিচেলকে এবং কুইন্সল্যান্ডের জোস পাপালি, ডেন গাগাই, ডিলান নাপা, ক্যালিন পোঙ্গা, জো ওফাহেঙ্গু এবং ডেভিড ফিফিতাদের।

কারণ? কী সমস্যা ছিল ১৮৭৮ সালে পিটার ডডস ম্যাকরনিক রচিত ‘আডভান্স অস্ট্রেলিয়া ফেয়ার’ গানটিতে, যা ১৯৮৪ পর্যন্ত চলা চিরাচরিত ব্রিটিশ ‘গড সেভ দ্য কুইন’কে বদলে দ্বীপরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়? উত্তরে গান শুরুর ছত্রটি পড়ে নিতে হবে – ‘Australians all let us rejoice/For we are young and free/ We’ve golden soil and wealth for toil/ Our home is girt by sea’। ১৭৮৮ সালে প্রথম ব্রিটিশ অভিযাত্রী দলটি যখন দ্বীপরাষ্ট্রে পা রেখেছিল, বলা হয়েছিল ‘terra nullius’ বা ‘nobody’s land’। সেই ঘটনাটিই ‘ইয়ং অ্যান্ড ফ্রি’-এর দ্যোতক হলে তা অত্যন্ত হাস্যকর অস্ট্রেলিয়ার আদি বাসিন্দাদের কাছে। ১৭৮৮ সালে ওইসময় গ্রহের ৪০০টি প্রান্ত থেকে সাড়ে সাত লক্ষ আদিবাসী তখনই অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করতেন, যাঁদের অধিকাংশেরই ইতিহাস ৬৫ হাজার বছরের। খুব স্বাভাবিক রাগবি লিগে জাতীয় সঙ্গীত বয়কটের মূল হোতা কডি ওয়াকারের কথাগুলো – ‘we aren’t young and free. We’re the longest living culture in the world. I guess just for those words to be in that, it just contradicts the whole anthem for us singing it ... The song doesn’t represent me or my family.’। অথবা সমানভাবেই প্রাসঙ্গিক এই ঐতিহাসিক বয়কটের অভ্যর্থনায় কুইন্সল্যান্ডের কিংবদন্তি জোনাথন থার্সটনের বক্তব্য – ‘Australia needs to be educated about its history. We have come a long way from where we were but we have a long way to go.’।

চিরাচরিত এক বৈষম্যের কথাও তুলে ধরে বিতর্কিত ওই ‘ইয়ং অ্যান্ড ফ্রি’ কথাগুলি। বহিরাগত অস্ট্রেলিয়দের তুলনায় আদি অস্ট্রেলিয়দের গড় জীবনকাল কুড়ি বছর করে কম, এবং দারিদ্ররেখার নিচে আদি বাসিন্দাদের একটা বিরাট অংশ। খুব স্বাভাবিকভাবেই ১৭৮৮-র ২৬ জানুয়ারি যখন বাকি দ্বীপরাষ্ট্র ‘অস্ট্রেলিয়া ডে’ পালন করতে আনন্দে মাতোয়ারা, আদি বাসিন্দারা সেই দিনটিকেই কলঙ্কিত ‘ইনভেশন ডে’ হিসেবে দেখে। পতাকায়, ব্যানারে দখল করে সিডনি, ক্যানবেরা, ব্রিসবেন। কোথাও দেশদ্রোহীর তকমা লাগে না। বিতর্কিত হলেও স্বাস্থ্যকর এক তর্ক-বিতর্কে বিষয়টিকে দেখেন সমগ্র দ্বীপবাসী। এই ঐতিহাসিক বিতর্কের শেষটুকুতে যাওয়ার আগে অন্য একটা দিকে চোখ বুলিয়ে নিই। একটু নন-লিনিয়ার প্লটে ঢুকে যাই, প্রিয় পাঠক ...

বিখ্যাত একটি আত্মজীবনীর ইংরিজি সংস্করণ ‘গানিং ফর গ্রেটনেসঃ মাই লাইফ’ থেকে তুলে ধরছি কিছু কথা – "After careful consideration I choose to play for Germans, I did my job well. And I feel comfortable and at home in the country of my birth. But I feel comfortable in Turkey too. And I’ve also had great times in Madrid and London. The media often tries to force you to tie yourself down to one thing. Along the lines of: ‘Come on, tell us. What are you? German? Or Turkish? Where do you prefer to be? Germany or Turkey? You have to choose one. Come on, commit yourself. You can’t be both. There’s only black and white. There’s only Turkish or German."

ঠিক ধরেছেন। লিখছেন মেসুট ওজিল। সেই ওজিল, যাঁর ফুটবল দক্ষতার সঙ্গেও তৈরি হয়েছে এক অন্য মানবিক দিক। ব্রাজিলে ২০১৪-র স্মরনীয় বিশ্বকাপ জয়ের পর ট্রফি জয়ের পুরো অর্থটাই ওজিল দিয়ে দেন ২৩টি ব্রাজিলিয় শিশুর অপারেশনের জন্য। ২৩টি শিশু, অর্থাৎ জার্মান দলের ২৩ জনের প্রতীকী হিসেবে। ওজিল খেলা শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত গান না। পরিবর্তে তিনি  কোরানের বিশেষ কিছু অংশ নিয়ে নিজের মনেই অজান্তে ঠোঁট নাড়ান। ভরসা পান। অথচ তাও প্রবল সমালচিত। যা আরও বেড়ে গেছিল ২০১৮ বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর। হ্যাঁ, কিংবদন্তী বেকেনবাওয়ারের থেকেও পাওয়া গেছিল শ্লেষ, নাম না করে চূড়ান্ত অপমান – ‘… a rebuild with hungry, hot players is needed. The singing of the national anthem also plays a role. Who sings before the game frees himself more than chewing gum.’। কষ্ট। জ্বালা। ওজিল ট্রফি জয়ের আনন্দ ভুলে গিয়েছিলেন। বাধ্য হয়েই জার্মানি ছেড়ে যেতে হয়েছিল ওজিলকে। যোগ দিয়েছিলেন তুরস্কের ক্লাব ফেনেরব্যাকে। তুলনামূলক প্রচারের অনেকটা বাইরে। অপমানিত ওজিলের আত্মজীবনীর একটি অংশ আলাদা করে ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল, অধ্যায়টির নাম দিয়েছিলেন ‘A bone of contention between Germany and Turkey’। খুব কষ্টে লেখা যার শেষটুকু ছিল – ‘You can definitely belong to two cultures. And you can certainly be proud of two cultures. A heart can beat Turkish and German at the same time. You can think like a German and feel Turkish. That’s how integration works. With mutual respect, like a great football club.’

ফুটবল এবং তার সঙ্গে যুক্ত রাজনীতি নিয়ে পড়াশুনো করে এসেছেন এমন অনেকেই জানবেন, শুধু মেসুট ওজিল নয়, বোয়েতাং বা খেদিরাদের বিরুদ্ধেও কুখ্যাত ‘নন-জার্মান’ তকমার জন্য জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে বারবার। খুব প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে সমসাময়িক ফরাসি স্ট্রাইকার করিম বেঞ্জিমার নাম। ফরাসি জাতীয় সঙ্গীত ‘লা মার্সেই’ না গাওয়ার জন্য বারবার সমালচিত হয়েছেন বেঞ্জিমা, যা মূলত তাঁর আলজেরিয়ান অরিজিনের জন্যেই। বেঞ্জিমা কিন্তু নির্বিকার ছিলেন। কখনও পাল্টা বক্তব্যে সপাটে থাপ্পড়ও কষিয়েছেন সমালোচকদের – ‘No one is going to force me to sing the Marseillaise. I don’t see the problem with not singing the Marseillaise. … There are even supporters who don’t sing it. I am not going to score a hat-trick just because I sang the Marseillaise.’ বেঞ্জিমার কথায় বারবার উঠে লা মার্সেই গাওয়ার ব্যাপারে বরাবর উদাসীন থুর বা কিংবদন্তি জিদানের নাম। অবশ্য এখানে জিদানের ড্রিম টিমের দলগত সাফল্য জাতীয় সঙ্গীত সংক্রান্ত বিতর্ককে অনেকটাই ঢেকে দিয়েছিল সন্দেহ নেই।

ফুটবলে জাতীয় সঙ্গীত প্রকাশ্যে না গেয়ে প্রতিবাদে হাঁটার ঘটনায় আরেকজনের নাম না বললে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফরাসি কলোনি নিউ ক্যালেডোনিয়া-জাত ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ান ক্যারেমবিউ। আটানব্বইয়ের বিশ্বজয়ী ফরাসি ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য রিয়েল মাদ্রিদ-তারকা এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার সরাসরি লা মার্সেই গাইতে অস্বীকার করেন। কারণ হিসেবে দেখান – ‘My family, like many Kanak families, underwent horrible experiences. I can’t sing the French National Anthem because I know the history of my people.’ এই প্রসঙ্গে চলে আসে লেখক দিদিয়ের দেনিঙ্কস-এর ‘Cannibal’ (১৯৯৮) নামক এক নন-ফিকশন বইয়ের কথা। ১৯৩১ সালে প্যারিস কলোনিয়াল একজিবিশনে গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন ফরাসি কলোনির বাসিন্দাদের ধরে এনে একজিবিশনের টুরিস্টদের মনোরঞ্জন করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে একটি হিউম্যান জু-র ভেতর গরাদে আটকে থাকা মুখ অনেকটা ক্যারেবিউ-এর মতো দেখতে হওয়ায় লেখক দিদিয়ের দেনিঙ্কস স্বয়ং ক্যারেমবিউকেই প্রশ্ন করেন এই বিষয়ে। জানা যায়, মুখটি বাস্তবিকই ছিল ফরাসি তারকার প্রপিতামহ উইলি ক্যারেমবিউয়ের। হ্যাঁ, একেই বলে সাম্রাজ্যবাদ। হিউম্যান জু। যার প্রেক্ষিতেই ক্যারেমবিউয়ের সেই কথাগুলো – ‘… because I know the history of my people.’

সবশেষে ফিরে আসি ‘অ্যাডভান্স অস্ট্রেলিয়া ফেয়ার’ প্রসঙ্গেই। যে কথাটি বলা হয়নি। ঐতিহাসিক স্টেট অফ অরিজিন এবং খেলার বাইরেও আরও অনেক বিতর্কের ফলে শেষমেশ জয় এসেছিল কডি ওয়াকারের মতো লক্ষ লক্ষ অস্ট্রেলিয় অ্যাবরিজিনদের। ২০২১-এর ৫ জানুয়ারি অস্ট্রেলীয় পার্লামেন্ট থেকে বিতর্কিত ওই ‘ইয়ং অ্যান্ড ফ্রি’ বদলে করা হয় ‘ওয়ান অ্যান্ড ফ্রি’। চিরপরিচিত বৈষম্য এখনও অনেকটাই রয়ে গেলেও ক্রীড়াক্ষেত্রে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে অস্বীকার করার ঘটনা দ্বীপরাষ্ট্রে তারপর থেকে আর হয়নি। ওয়াকার, অ্যাডো-কার বা উইলি চেম্বার্সরা অনেকটা আশা বুকে নিয়ে এখন বুক চিতিয়ে ঠোঁট মেলান –
‘Australians all let us rejoice
For we are one and free
We’ve golden soil and wealth for toil
Our home is girt by sea.’

তথ্যসূত্র

  • https://dailycannon.com/2018/08/mesut-ozil-explains-why-he-doesnt-sing-national-anthem/
  • https://www.newindianexpress.com/sport/football/fifa-u-17-world-cup-2017/2017/oct/12/karembeu-france--new-caledonia--a-complex-relationship-1672627.html
  • https://www.smithsonianmag.com/smart-news/australia-changes-national-anthem-nod-indigenous-people-180976673/
  • https://www.theguardian.com/sport/2019/jun/05/players-boycott-australian-national-anthem-before-state-of-origin-opener

More Articles