পুরভোটে জেন ওয়াই-কে তুলে আনছে বামেরা, চাণক্যনীতি নাকি ব্যর্থতারই নামান্তর

পশ্চিমবঙ্গে বকেয়া পুরভোট হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতর ভোট ঘিরে প্রস্তুতি ধীরে ধীরে জমতে শুরু করেছে। যে কোনো  ভোটেই শাসক দল সাংগঠনিক দিক থেকে সবসময় একটু এগিয়ে থাকে। গত বছরের বিধানসভা ভোটের মতোই, আগামী পৌরসভা ভোটে সংগঠনের অবস্থা যেমনই থাকুক না কেন, দল যেহেতু রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আছে ,তাই তৃণমূল কংগ্রেস ঘর গুছিয়ে, ভোটের কাজে বামপন্থী দলগুলো বা বিজেপি-কংগ্রেসের থেকে অনেকটাই এগিয়ে আছে। তবে বামপন্থী দলগুলো গত লোকসভা ,বিধানসভা ভোট থেকেই নবীন প্রজন্মের মানুষদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। সেই স্ট্র্যাটেজিতেই এবারেও শান দিচ্ছে তারা।

নতুন প্রজন্মের মানুষেরা নির্বাচনী সংগ্রাম থেকে শুরু করে, রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলিতে  আরো বেশি বেশি করে অংশগ্রহণ করলে, সামগ্রিক ভাবে রাজনৈতিক পটভূমি যে অত্যন্ত স্বাস্থবান হবে ,তা আর  বলার অপেক্ষা রাখে না ।একটা সময় কালে বৃদ্ধ, অসুস্থ, প্রায় পঙ্গু মানুষ, তাঁদের ভোটের ময়দানে নামিয়ে, যে কোনো উপায়ে গড় রক্ষা করার প্রবণতা ডান -বাম সব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র ছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে বামফ্রন্টভুক্ত বাম দলগুলোর মধ্যে সিপিআই (এম) বেশ অনেকদিন ধরেই প্রবীণ  রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নির্বাচনী সংগ্রামের আসর থেকে সরিয়ে এনে, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে, তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিল।

আটের দশকের শেষ দিকেই আমরা দেখেছিলাম, কৃষ্ণপদ ঘোষের মতো পোড়খাওয়া শ্রমিক নেতাকে ভোট রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে এনে, তুলনায় অনেক নবীন প্রজন্মের যুবনেতা মানব মুখার্জিকে তাঁর বেলেঘাটা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করেছিল সি পি আই(এম)। একই কথা প্রযোজ্য নদীয়ার প্রবীণ  অমৃতেন্দু  মুখোপাধ্যায় বা বর্ধমানের প্রবাদপ্রতিম নেতা বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী, সৈয়দ মনসুর হাবিবউল্লাহ , হাওড়ার নিরুপমা চ্যাটার্জীর, দক্ষিণ  চব্বিশ পরগনার প্রভাস রায় প্রমুখদের ক্ষেত্রে।

আরও পড়ুন-ভারতের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অধিনায়করা এখন কে কোথায়?

সেই তুলনায় আমরা দেখেছি, বামফ্রন্ট ভুক্ত  সিপিআই(এম) ব্যতীত অন্য রাজনৈতিক দলগুলির ভেতর কিন্তু নির্বাচনী ময়দানে, তাঁদের প্রবীণ নেতাদের সরিয়ে এনে, নবীন প্রজন্মকে স্থান দেয়ার প্রবণতা প্রায় ছিলই না। ফরওয়ার্ড ব্লক ভক্তিভুষণ মন্ডল ,নির্মল বসু, কমল গুহর মতো প্রবীণ নেতাদের সংসদীয় রাজনীতির থেকে অবসর দিয়ে, সেই জায়গায় নতুন প্রজন্মের মানুষদের তুলে আনার ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা এবং সাহস কখনোই দেখাতে পারেনি সেই দল।

আরএসপি ও দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত প্রবীণ  মানুষদের অনেক কাল ভোট  ময়দানে রেখে দিয়ে, নতুন প্রজন্মের নেতাদের ,কর্মীদের নির্বাচনী সংগ্রামে উঠে আসবার সুযোগ কখনো করে দেয়নি। সি পি আই(এমে)-এর সাংগঠনিক পরিকাঠামোর কারণে তাঁরা জ্যোতি বসু থেকে বিনয় চৌধুরী, প্রশান্ত সুর অমৃতেন্দু মুখার্জী, প্রভাস রায়, কৃষ্ণপদ ঘোষ, সৈয়দ মনসুর হাবিবউল্লাহ, মহম্মদ আমীন প্রমুখ শীর্ষস্তরের নেতাদের ভোট রাজনীতি থেকে সরিয়ে এনে, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যবহারের যে সাহস দেখিয়েছিলেন, তার ফলে কিন্তু তাঁদের দলে কখনো কোনো রকম বিদ্রোহ সেই সময়ে তৈরি হয়নি।

আরও পড়ুন-মোদির নিউ ইন্ডিয়া বনাম রাহুল গান্ধী, ম্যাচের ফলাফল?

অপরপক্ষে কমল গুহকে একবার টিকিট না দেওয়ার ফলে, তিনি কী ভাবে বিদ্রোহ করেছিলেন ,দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে সমাজবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক তৈরি করেছিলেন ,সে সব ইতিহাস আমরা জানি। বেঙ্গল ল্যাম্প বিতর্ক না হলে আরএসপির যতীন চক্রবর্তী আমৃত্যু ভোটের ময়দানে থেকে যেতেন কিনা  তা ঘিরে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ভেতরে নানারকম আলাপ-আলোচনা আছে। বয়সে নবীন, কর্মদক্ষতায় সজীব ডাক্তার ওমর আলিকে কার্যত কোণঠাসা করে দিয়ে, রাজ্য সম্পাদকের মতো সম্মানীয় পদ ছেড়ে  ভোট রাজনীতিতে লড়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন সিপিআই-এর নন্দগোপাল ভট্টাচার্য ।২০১১ সালের  নির্বাচনের সময় কালে তাঁর স্বাস্থ্য নেহাত একেবারে বেহাল হয়ে পড়েছিল, তা না হলে তিনিও সেবারেও প্রার্থী হতে ছাড়তেন না বলেই ওয়াকিবহাল মহলের বিশ্বাস।

এই জায়গা থেকে বামপন্থীরা গত লোকসভা, বিধানসভা ভোটে যেভাবে নবীন প্রজন্মের নেতা কর্মীদের প্রার্থী করেছেন, সেক্ষেত্রে সিপিআই (এম)  তাঁদের  কিছু না করলেও অন্য বামপন্থী দলগুলোর কাছে সেটা একটা উল্লেখ করার মতই ঘটনা ছিল। সিপিআই(এম) অবশ্য লোকসভা, বিধানসভা ভোটের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝেই পরীক্ষামূলক ভাবনা চিন্তা করেছেন, নবীন প্রজন্মের মানুষদের তুলে এনেছেন। সেভাবেই কিন্তু সাংগঠনিক রাজনীতির বাইরে সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে মহম্মদ সেলিম, শমীক লাহিড়ী, সুজন চক্রবর্তী,  অলকেশ দাস প্রমুখ ব্যক্তিত্বেরা উঠে এসেছেন । সংসদের বা বিধানসভার ভিতরে-বাইরে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।

এই নবীন  প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রবীনদের জায়গায় তুলে আনা, বর্তমান সময়ে যে প্রবণতা বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সেটা কিন্তু খুব একটা মুখের কথা নয়। লোকসভা, বিধানসভা ভোটের ক্ষেত্রে প্রার্থীর রাজনৈতিক ক্যারিশমার যেমন একটা ব্যাপার থাকে, স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষেত্রে সেই রাজনৈতিক ক্যারিশ্মার থেকেও  যেটা জোরদারভাবে কার্যকরী থাকে, সেটা হল, সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের নির্বাচনী ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে সংযোগের বিষয়।

এই ক্ষেত্রটি শাসকদল, চিরকাল প্রশাসন নিজের হাতে থাকার ফলে, কখনো এইসবের  খুব একটা পরোয়া করে না। কিন্তু যাঁরা শাসন ক্ষমতার বাইরে রয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে, এলাকার পরিচিত রাজনীতিকদের বাইরে, অপরিচিত মানুষদের ভোটের ময়দানে নিয়ে আসা খুব একটা মুখের কথা নয়। এই উদ্যোগটা অত্যন্ত সাধু উদ্যোগ সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু সেই সাধু উদ্যোগ ঘিরেও কয়েকটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। রাজনৈতিক ঘরানার দিক থেকে বামপন্থী দলের সঙ্গে অবামপন্থী ও ডানপন্থী দলগুলির সংস্কৃতিগত একটা বড় রকমের ফারাক আছে।

বামপন্থী দলে হঠাৎ করে কেউ এসে ,সরাসরি নেতা হয়ে যেতে পারেন না। প্রার্থী হওয়া তো দূরের কথা ।ভরা বাজারে কখনও কখনও আমরা সেলিব্রেটি  বা ফিল্ম  বা ক্রীড়াজগৎ থেকে উঠে আসা মানুষদের ভোটে দাঁড় করিয়ে, নেতা বা নেত্রী তৈরি করে দেওয়ার একটা অদ্ভুত প্রবণতা দেখেছি। জ্যোতির্ময় সিকদারের মত ক্রীড়াজগতের অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তির সঙ্গে রাজনীতির কখনো কোনো রকম প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। সেই মানুষটিকে হঠাৎ করে লোকসভা ভোটে বামপন্থীরা দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি জিতেছিলেন। আবার বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, রাজনৈতিক শিবির বদল করতে  জ্যোতির্ময় শিকদারের এতটুকু সময় লাগেনি।

এমন উদাহরণ অনেক আছে  সেই প্রেক্ষিতেই অপরীক্ষিত এবং রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ মানুষদের, কেবলমাত্র নবীন প্রজন্মের মানুষ হবার দৌলতে, ভোট রাজনীতিতে নিয়ে এলে, সেটা বামপন্থীদের বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক সংকটের ভেতরে ,তাঁদের পক্ষে কতটা হিতকরী হতে পারে,  এ নিয়ে  একটা সংশয় কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। অবাম রাজনৈতিক দলগুলির মতোই, বামপন্থী দলগুলোর ক্ষেত্রে বেশ কিছুদিন ধরে দলীয় অফিসে বা রাজনৈতিক সভায়  ফ্ল্যাগ হাতে করে দলে যোগদানের প্রবণতা আমরা সামাজিক গণমাধ্যমে দেখছি। সিপিআই, সিপিআই(এম)-এর মতো বামপন্থী দলগুলিতে, কংগ্রেস- বিজেপি- তৃণমূলের মত যোগ দেওয়া যায় ,যোগ দিলেই 'কমরেড' উপাধি পাওয়া যায়, নেতা হয়ে যাওয়া যায়, এটা কিন্তু আমরা আগে কখনো দেখিনি। গত কয়েক বছরে এই প্রবণতা সিপিআই (এম)-এর  ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

সেই প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, নবাগতদের ভোট ময়দানে একদম সরাসরি প্রার্থী করে দেওয়ার বিষয়টি। কমিউনিস্ট পার্টি তে এভাবে হঠাৎ করে এসে কেউ নির্বাচনী সংগ্রামে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, এটা কিন্তু আগে কখনো দেখা যেত না। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ পাওয়ার ক্ষেত্রেও যে ত্রিস্তরীয় পদ্ধতি আছে, তারই একটা প্রতিচ্ছবি কিন্ত প্রার্থী করবার বিষয়টির মধ্যেও দেখতে পাওয়া গিয়েছে। চটকদারি জগত থেকে, মধ্যবিত্ত সমাজে খুব উচ্চ প্রতিষ্ঠিত  পরিমণ্ডল থেকে আসা লোকেদের  মাঝেমধ্যে যে কখনো পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি প্রার্থী করেনি এমনটা নয়। জ্যোতির্ময় শিকদারের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী শংকর সেনের  নাম এই  ক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয়।

জ্যোতির্ময়ী যেমন বামপন্থীরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বামপন্থী শিবির ত্যাগ করেছেন শঙ্করবাবুর ক্ষেত্রে  কিন্তু বিষয়টা তেমন নয়। বামপন্থীরা ক্ষমতার মধ্যগগনে থাকার সময়ই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে থেকে সরে এসেছিলেন শঙ্কর সেন। তবে জ্যোতির্ময়ের মত কখনোই শংকর সেন বিপক্ষ রাজনৈতিক শিবিরে নিজের নাম লেখান নি  বা রাজনীতি থেকে সরে এসে পূর্বতন সহকর্মীদের সম্পর্কে কোনো রকম বিষোদগার করেননি।

আমরা দেখেছি উত্তর চব্বিশ  পরগনার নোয়াপাড়ায় একটা সময় হঠাৎ করে ডাক্তার কুশধ্বজ ঘোষ কে প্রার্থী করল সিপিআই(এম)। ২০০৬ সালে সিপিআই(এম)-এর  ভরা বাজারে তিনি  জিতেও গেলেন । ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলনের যে ঐতিহ্য এবং ধারাবাহিকতা,তার সঙ্গে এই কুশধ্বজবাবুর কোনোদিন, কোনো রকম ন্যূনতম সংযোগ ছিল না ।বিধায়ক হয়েও ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের যে নানা সমস্যা, বিশেষ করে বন্ধ কল-কারখানা সমস্যা , তাঁর কথা তিনি  বিধানসভার ভেতরে বা বাইরে একটি বার ও উচ্চারণ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।

একদা সমাজের মধ্যবিত্ত স্তর থেকে উঠে আসা ডাক্তার শৈলেন দাসের  চিকিৎসক হিসেবে ,সংগীতশিল্পী হিসেবে যে সামাজিক কর্মকাণ্ড ছিল ,তেমন কোনো পর্যায়ের সঙ্গেও কিন্তু কুশধ্বজের কখনো ন্যূনতম সম্পর্ক আমরা দেখতে পাইনি। ২০০৬ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর, তৃণমূল কংগ্রেসের বিধানসভা ভবনে ভাঙচুরের ঘটনায় তাঁর আহত হওয়ার ঘটনার বাইরে, ওই পাঁচ  বছরের সময়কালে ,আর কখনো কোনো রকম রাজনৈতিক কার্যক্রমে আমরা কুশধ্বজ ঘোষ ঘোষ কে দেখতে পাইনি। বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, সন্নিহিত এলাকায়  বামপন্থীদের সঙ্গে নতুন শাসকদের যে সংঘাত ঘটেছে, সেই সময়কালে একটিবারের জন্য আমরা আক্রান্ত কোন বামপন্থী নেতা, কর্মীর পাশে প্রাক্তন বিধায়ক কুশধ্বজ ঘোষকে দেখতে পাইনি ।

একই কথা বলতে হয় সেই ২০০৬  সালে পঁচাত্তর হাজার ভোটে জেতা বীজপুরের  বিধায়ক সরকার  নির্ঝরিনী চক্রবর্তী সম্পর্কেও। বামপন্থীরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নির্ঝরিনী দেবীকে একটি দিনের জন্য কোন আক্রান্ত বামপন্থী নেতা, কর্মীদের বাড়ির পাশে দেখা গেছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। এই যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষ, যাঁদের সাথে কখনো প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংযোগ ই ছিল না, তাঁদের  পোড়-খাওয়া রাজনৈতিক কর্মীদের বদলে ভোট রাজনীতিতে নিয়ে এসে ,মধ্যবিত্তের মনজয়ের চেষ্টা ,এমনটা কিন্তু পার্টিতে অতীতেকালে রীতিনীতিতে ছিল না। বিধানচন্দ্র রায়ের মতো উচ্চ অভিজাত শিক্ষিত মানুষের বিরুদ্ধে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি প্রার্থী করেছিলেন মহম্মদ ইসমাইলের  মতো একজন পোড়খাওয়া শ্রমিক নেতাকে। কলকাতা শহরে বিভিন্ন সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আক্রান্ত মানুষদের পাশে শ্রমিক নেতা হিসেবে মহম্মদ ইসমাইলের  উপস্থিতি যে কোনো রাজনীতিকদের কাছে একটা ঈর্ষণীয় বিষয়। ট্রাম শ্রমিকদের নেতা হিসেবে বাংলার রাজনীতিতে এক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব মহম্মদ ইসমাইল।

ইসমাইল সাহেবের মতো পোড়খাওয়া শ্রমিক-কৃষক মেহনতি জনতার মধ্যে থেকে মানুষদের ,একটা রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় ভেতর দিয়ে তুলে এনে, তাঁদের প্রার্থী করতো কমিউনিস্ট পার্টি ।সেই জায়গায় আজকে কেবলমাত্র নবীন প্রজন্মের মানুষদের  ঠাঁই করে দিতে,বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে  যাঁদের, তাঁরা  বেশিরভাগই উঠে এসেছেন, শিক্ষিত, উচ্চ বামধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলের ভেতর দিয়ে। বাজার অর্থনীতির নানা ধরনের চাপান-উতোরের  মধ্যে দিয়েই নিজেদের যাপন চিত্রকে যাঁরা প্রবাহিত করতে অভ্যস্ত। এই ধরনের মানুষদের প্রার্থী করা হচ্ছে বামপন্থী দলগুলোর পক্ষ থেকে।

গণভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করার পরিবর্তে, সামাজিক গণমাধ্যম, ফেসবুক-টুইটারে দৌলতে নেতা হয়ে ওঠার দিকে এই তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশের আকর্ষণ সবথেকে বেশি  বাজার অর্থনীতির হাজারো  হাতছানিকে এইসব অতি অল্প বয়সী নেতা-নেত্রীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অতিক্রম করতে পারেন না। ফলে নিজের বাড়ির ছাদে বা ব্যালকনিতে বুকে পোস্টার সেঁটে  ফেসবুকে লাইভ করাকেই তাঁদের বেশিরভাগ অংশই, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটা পূজনীয় অধ্যায় বলে মনে করে থাকেন।

রাজনৈতিক গতিপ্রবাহের উল্লেখযোগ্য ধারা হিসেবে তারা নিজের আত্মপ্রচারকেই তাঁরা রাজনীতির একমাত্র মাপকাঠি মনে  করেন । আমার চেনা বৃত্তের ভেতর এমন অনেককে কেবলমাত্র নতুন প্রজন্মের মানুষ হিসেবেই আসন্ন পৌরসভায় বামপন্থীদের পক্ষ থেকে প্রার্থী হতে দেখলাম, যাঁরা মদ্যপান জনিত ব্যক্তি জীবনের ঘটনাক্রম কে ঘিরে সামাজিক গণমাধ্যমে রীতিমতো বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়াকে নিজেদের ক্যারিশমার একটা অঙ্গ হিসেবেই মনে করছেন।

আবার এমন একজনকে এই নির্বাচনে প্রার্থী হতে দেখেছি , যাঁর বিরুদ্ধে দলীয় কার্যালয়ে ভিতরে, দলের কম্পিউটার ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি দেখার অভিযোগ উঠেছে। তাঁদের দলের রাজ্য স্তরের শীর্ষব্যক্তিত্বরা সেটা নিয়ে তদন্ত করেছেন এবং অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর সাময়িক ভাবে দল থেকে সাসপেন্ড হয়েছেন সেই 'তরুণ তুর্কি', অথচ সাসপেনশন উঠে যাওয়ার পর তারুণ্যের  দোহাই দিয়ে সেই ব্যক্তিটিকে প্রার্থী পর্যন্ত করা হয়েছে।

এই ধরনের মানুষকে প্রার্থী করার পিছনে গোষ্ঠী রাজনীতির অনেক ধরনের খেলা থাকে।  নতুন প্রজন্মের বামপন্থী কর্মীরা কোভিডের  তিনটি পর্যায়ে রেড ভলেন্টিয়ার হিসেবে জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে লড়াই করেছেন, নিজেদের পরিবার -পরিজন, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে অস্বীকার করে,আক্রান্ত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, অসুস্থদের  অক্সিজেন জোগাড় করে দিয়েছেন,  প্রয়োজনে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন, ওষুধ পৌঁছে দিয়েছেন, খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন, মৃত্যু ঘটলে  সৎকারে পর্যন্ত সমস্ত ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছেন। সেই রেড ভলেন্টিয়ারের মধ্যে থেকে যেসব নামকে প্রার্থী করা হচ্ছে,  তাতে তাঁদের গোটা দলটার যে লড়াই, তাঁদের যে  আত্মত্যাগ, তাঁদের যে কর্মনিষ্ঠা, কর্তব্যবোধ, দেশের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সেগুলো কি মুড়িমিছরি একদর করে ফেলা হচ্ছে না? ওই তরুণ প্রজন্মের সত্যিকারের যে লড়াই , তার প্রতি চরম অসম্মান অমর্যাদা প্রকাশ করা হচ্ছে না? রাজনৈতিক কার্যক্রমে ভিতর দিয়ে, সামাজিক কার্যক্রমের  ভেতর দিয়ে, সমস্ত ধরনের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মূলক মানসিকতার বিরুদ্ধে, জানকবুল লড়াই করে যে ছেলেপুলেরা, নিজেদের রাজনৈতিক ভাবনা, মতাদর্শ, মানবিক বোধকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন, তাঁদের গোটা ব্যাপারগুলোকে আম তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে এক করে দেখা হচ্ছে না?

বামপন্থীদের কি এখন কেবলমাত্র ভোটে জেতাকেই  তাঁদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য বলে মনে করছেন? তাদের যে রাজনৈতিক মূল্যবোধ, মতাদর্শের প্রতি তাঁদের যে ভাবনা চিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের জন্য তাঁদের যে লড়াই ,সেই গোটা প্রেক্ষিকে  মানুষের কাছে তুলে ধরা ,তাঁদের কাছে প্রধান কর্মপদ্ধতি অঙ্গ? নাকি জমকালো প্রার্থীদের ভোটের রাজনীতির ময়দানে প্রার্থী করে, শ্রমিক-কৃষক- মেহনতি জনতার বদলে , বামপন্থীরা নিজেদের মধ্যবিত্তদের জন্য সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট হিসেবে পরিচয়টাকেই তীব্র করে তুলতে চাইছে? আর এই পথটাকেই ক্ষমতার রাজনীতির কাছে চলে আসার শর্টকাট পথ বলে মনে করতে শুরু করেছেন?

More Articles