আন্তর্জাতিক বাজারে দর পড়ছে, তবু কেন লাগামছাড়া পেট্রল?

নয়াদিল্লি: ফের দাম বাড়ল পেট্রল এবং ডিজেলের (Fuel Price Hike)। এ দিন ফের লিটারে ৪০ পয়সা দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে এই মুহূর্তে কলকাতায় লিটার প্রতি পেট্রলের দাম পড়ছে ১১৩টাকা ৪৫ পয়সা। পেট্রল এবং ডিজিলের এই মূল্যবৃদ্ধি এখনও পর্যন্ত সর্বকালীন রেকর্ড। তবে গত দু’সপ্তাহ ধরে যে ভাবে একনাগাড়ে পেট্রল এবং ডিজেলের দাম বেড়ে চলেছে, তাতে প্রতিদিন নিত্য-নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে, আর তা কোথায় গিয়ে থামবে বলতে পারছেন না কেউই। 

পেট্রল-ডিজেলের এই আকাশছোঁয়া দামের নেপথ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধিকেই (Crude oil Price) মূলত দায়ী করা হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে (Russia Ukraine War) তেলের জোগান এবং সরবরাহে প্রভাবে ফেলছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু বৃহস্পতিবারই নিজেদের সঞ্চিত তেল আন্তর্জাতিক বাজারে ছাড়ার ঘোষণা করেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আগামী ছ’মাস দিনে ১০ লক্ষ ব্যারেল তেল বাজারে ছাড়ার কথা জানান তিনি। এর পরই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ৭ শতাংশ নীচে নেমে যায়। 

বাইডেনের ঘোষণার পর গত দু’বছরে এই প্রথম আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম সর্বনিম্নে এসে ঠেকেছে। শুক্রবার বাজার বন্ধের সময় ব্রেন্ট ক্রুডস ফিউচারস-এর ব্যারেল প্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ১৭০.৯১ ডলার। জুন ফিউচারস-এর ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ১০৫.১৬ ডলারে এসে ঠেকে। ইউএস ওয়েস্ট ডেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট অপরিশোধিত তেলের দাম এসে ঠেকে ১০০.২৮ ডলার প্রতি ব্যারেলে। এক সপ্তাহ আগে আন্তর্জাতিক বাজারে এই দাম ১২০ ডলারের আশেপাশে ছিল।

অন্য দিকে, দেশে চাহিদার জোগান দিতে ৮৫ শতাংশ তেলই বিদেশ থেকে আমদানি করে ভারত। তবে সম্প্রতি মোটা টাকা ছাড়ে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার চুক্তি সেরেছে ভারত। তার আওতায় ইতিমধ্যেই অপরিশোধিত তেল কিনতে শুরু হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার ব্যবসায়ী মহলের একটি অনুষ্ঠানে সে কথা নিজেই জানান অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ব জুড়ে মূল্য বৃদ্ধি, এ সবের মধ্যে জাতীয় স্বার্থের কথা নাথায় রেখেই তেল মজুত করে রাখা হচ্ছে বলে জানান নির্মলা। আগামী দু’তিন দিনের জন্য তেল মজুত রয়েছে বলে জানান তিনি। শুক্রবার গোটা দেশেও তেলের দাম অপরিবর্তিত ছিল। কিন্তু শনিবার সকাল হতেই ফের দাম বৃদ্ধি শুরু হয়।


লাগাতার পেট্রল, ডিজেলের এই মূল্যবৃদ্ধির দায় যদিও নিতে নারাজ কেন্দ্র। তাদের দাবি তেলের মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে গোয়া, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মণিপুর—এই পাঁচ রাজ্যে ভোটের আগে ৪ নভেম্বর থেকে টানা ১৩৭ দিন তেলের দাম অপরিবর্তিত রাখা সম্ভব হল কোন উপায়ে, বিশেষ করে সেই সময় আন্ত্রজাতিক বাজারে তেলের দাম যখন ঊর্ধ্বমুখী ছিল। প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি।

শেয়ার বাজারের ওঠাপড়া, ব্যবসার পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিচার-বিশ্লেষণকারী সংস্থা মুডিজ ইনভেস্টর সার্ভিসেস জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্ধমুখী হলেও, নির্বাচনের আগে কয়েক মাস ভারতে তেলের দাম অপরিবর্তিত থেকেছে। তাতে সামগ্রিক ভাবে রাষ্ট্রীয় তেল সংস্থাগুলির ২২৫ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। তার জন্য ভোট মেটার পর থেকেই কেন্দ্রের উপর চাপ বাড়াচ্ছিল তেল সংস্থাগুলি। লিটারে ডিজেলের দাম ১৩ থেকে ২৪ টাকা পর্যন্ত এবং পেট্রলের দাম ১০ থেকে ২২ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর সুপারিশ করছিল তাবড় সংস্থা। সেই অনুযায়ীই তেলের দাম বাড়ছে। তেল সংস্থাগুলিকে ক্ষতি পুষিয়ে দিতেই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বলে মত বিশেজ্ঞদের।

তেল সংস্থাগুলি দাম বাড়ালেও, সরকারের তরফে করছাড় দিলে সাধারণ মানুষ রেহাই পান বলেও মত বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু সেই নিয়েও কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে দড়ি টানাটানি চলছে। পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে যদি হিসেব করা যায়, সে ক্ষেত্রে লিটার প্রতি তেলের দাম যদি ১০০ টাকা হয়, তা থেকে করবাবদ ৩৩ টাকার মতো যায় কেন্দ্রীয় সরকারের ঝুলিতে। ১৯ টাকার কিছু বেশি জমা পড়ে রাজ্যের কোষাগারে। পেট্রলের উপর মোট করের ৬৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় রাজকোষে জমা পড়ে। ৩৭ শতাংশ যায় রাজ্যের কাছে। গত বছর প্রতি লিটারে পেট্রল-ডিজেলের উপর ১ টাকা করছাড় দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু কেন্দ্রের তরফে কোনও ছাড় মেলেনি। তা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলছে। ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সংসদে নির্মলা জানান, শেষ তিন অর্থ বছরে পেট্রল-ডিজেলের করবাবদ ৮.০২ লক্ষ কোটি টাকা আয় করেছে কেন্দ্র। 

অথচ তেলের বিক্রি কোভিড পূর্বের অবস্থায় ফিরে গিয়েছে বলে শুক্রবারই পরিসংখ্যান সামনে এসেছে। তেলের দাম বৃদ্ধির আঁচ পেয়ে মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহেইখুচরো বিক্রেতা এবং সাধারণ মানুষ তেল কিনে মজুত করতে শুরু করে দেন বলে জানা গিয়েছে। ২২ মার্চ থেকে দাম বাড়তে শুরু করলেও তেলের বিক্রিতে তেমন প্রভাব পড়েনি। বরং ৯০ শতাংশ বাজার যাদের দখলে, সেই রাষ্ট্রীয় খুচরো বিক্রেতারা শুধুমাত্র মার্চ মাসেই প্রায় ২৭ লক্ষ টন পেট্রল বিক্রি করেছে, যা গত বছর মার্চ মাসের তুলনায় ৮.৭ শতাংশ বেশি এবং ২০১৯-এর মার্চের তুলনায় ১৪.২ শতাংশ বেশি। 

আবার রাষ্ট্রীয় সংস্থা আবে খুচরো বিক্রেতাদের বাদ দিলেও, সামগ্রিক ভাবে গত বছর মার্চের তুলনায় এ বছর পেট্রলের বিক্রি বেড়েছে ৩৮.৬ শতাংশ। দেশে সর্বাধিক ব্যবহৃত ডিজেল বিক্রি হয়েছে প্রায় ৭০ লক্ষ টন, ২০১৯-এর মার্চের তুলনায় যা ৫ শতাংশ বেশি। প্রতি মাসের নিরিখে হিসেব করলে, পেট্রলের বিক্রি ১৭.৩ শতাংশ এবং ডিজেলের বিক্রি ২২.৩ শতাংশ করে বেড়েছে। অর্থাৎ শুধু লকডাউন পূর্ব অবস্থায় ফিরেই যায়নি তেল বিক্রি, তার চেয়ে বর্তমানে ব্যবসা আরও বেড়েছে।  

More Articles