৩৩ বছর ধরে প্রতিদিন ৪০০ মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা, ১০০০ জনকে খাবার! 'ভগবান'কে চিনুন!

Delhi Veerji Ka Dera: কমলজিৎ সিং জানান, প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল সাতটার মধ্যে শীষগঞ্জ গুরুদ্বারার সামনে জড়ো হয়ে যান ডাক্তার এবং ভলেন্টিয়াররা।

সেবাই পরম ধর্ম। বাক্যটা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বইতে বা ধর্মগ্রন্থে পড়েছেন অনেকেই। এই উক্তিটিকে পড়ে শুধু নীতিকথা হিসেবে মেনে নিয়েছে অধিকাংশ মানুষই। কিন্তু দেশের বিভিন্ন কোণায় এমন কিছু মানুষের রয়েছেন যাঁরা এই সামান্য কথাটিকেই নিজেদের জীবনের মূল মন্ত্র করে ফেলেছেন। আজ পরিচয় করাব এমন দুই ভাইয়ের সঙ্গে যাঁরা বিগত সাত বছর ধরে প্রতিদিন ৪০০-র বেশি মানুষকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছেন। যদি সকাল-সকাল দিল্লির অন্যতম জনবহুল এলাকা চাঁদনী চকে হাঁটতে বেরোন, দেখবেন রাস্তার একদিকে লম্বা লাইন লেগে রয়েছে মানুষদের। অধিকাংশ মানুষই সমাজের দিন আনা-দিন খাওয়া শ্রেণির। সেই অগুনতি মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন বিনামূল্যে চিকিৎসার আশায়। কিন্তু এই লাইন মোটেও দিল্লি সরকারের ‘মহল্লা ক্লিনিক’-এর নয়।

দিল্লি সরকারের অন্যতম আলোচিত প্রকল্প বা কাজ হল ‘মহল্লা ক্লিনিক’, অর্থাৎ পাড়ায় পাড়ায় নিঃখরচার ক্লিনিক। সেই ক্লিনিক ভালো মানের চিকিৎসা প্রদান করলেও একই সময়ে বিশাল সংখ্যক মানুষকে পরিষেবা দিতে অক্ষম। এই সমস্যার সমাধান নিয়েই হাজির হয়েছে ‘বীরজি কা ডেরা’। একদল ডাক্তার এবং একদল স্বেচ্ছাসেবক বা ভলেন্টিয়ার প্রতিদিন জড়ো হন চাঁদনী চকের ‘বীরজি কা ডেরা’-য়। এঁদের মূল মন্ত্র হল ডেরায় আসা যেকোনও সাধারণ মানুষকে উত্তম মানের চিকিৎসা প্রদান করা। ১৯৮৯ সালে এই সফর শুরু করেন ‘বীরজি কা ডেরা’র ত্রিলোচন সিং। বর্তমানে তাঁর দুই ছেলে ব্রিগেডিয়ার প্রেমজিৎ সিং পানেসর এবং কমলজিৎ সিং নিপুণভাবে এই সংস্থাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। প্রতিদিন প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ জন মানুষের চিকিৎসা করিয়ে চলেছেন এই ভ্রাতৃদ্বয়। দলে রয়েছেন বেশ কয়েকজন ডাক্তার এবং ভলেন্টিয়ার যাঁরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। পেশায় প্রেমজিৎ সিং ছিলেন প্রাক্তন সেনা এবং কমলজিৎ সিং একজন সফল ব্যবসায়ী। বাবার মহৎ উদ্দেশ্যের মর্যাদা রাখতে বদ্ধপরিকর দুই ভাই।

আরও পড়ুন- অভাবনীয় বৃদ্ধি সম্পত্তির! উইপ্রো, নেসলে, ওএনজিসির থেকেও ধনী তিরুপতি মন্দির

কীভাবে ত্রিলোচন সিং হয়ে উঠলেন বীরজি?

ত্রিলোচন সিংয়ের জন্ম মায়ানমারে। পরবর্তীকালে বড় হয়ে বাবা মা-র সঙ্গে তিনি দিল্লি চলে আসেন। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ত্রিলোচন সিং গুরুদ্বারার প্রতি বরাবরই অপার টান অনুভব করতেন। অবসর সময়ে প্রায়ই এখানে এসে বসে থাকতেন তিনি। সেই সময় এখানকার আশেপাশের গরিব দুঃস্থ মানুষদের দুরবস্থা দেখে মন কেঁদে ওঠে তাঁর। তাই ঠিক করেন চাকরি থেকে অবসরের পর এই গরিব মানুষদের জন্য কিছু করবেন। ১৯৮৯ সালে রিটায়ারমেন্টের পর একই রকম সেবাবৃত্তি মনোভাবযুক্ত কিছু মানুষের সঙ্গে ত্রিলোচন সিং দিল্লির শীষগঞ্জ গুরুদ্বারার কাছে একটি ক্যাম্প মতোন খোলেন গরিব মানুষদের সহায়তার জন্য। কোনও গরিব মানুষকে অসুস্থ বা ঘায়েল দেখলে তাঁর সুশ্রুষা করে সুস্থ করে তুলতেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।

ত্রিলোচন সিং বীরজি

কমলজিৎ সিং জানান, সেই থেকেই বিনা পয়সায় মানুষের চিকিৎসা করা শুরু। সাধারণত সকল প্রকার ফার্স্ট-এইড এবং জ্বর, সর্দি-কাশি, ভিটামিনের মতো দরকারি ওষুধ এখানে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। এহেন মানুষের এত ভালো কর্মে প্রভাবিত হয়ে সাধারণ মানুষ তাকে নাম দেন বীরজি। পঞ্জাবি ভাষায় ‘বীরজি’ শব্দের অর্থ বড় ভাই। এবং পরবর্তীকালে ‘বীরজি’ ত্রিলোচন সিংয়ের নামেই তাঁর সংগঠনের নাম হয়ে যায় ‘বীরজি কা ডেরা’। ২০১০ সালে ত্রিলোচন সিংয়ের প্রয়াণের পর তাঁর এই সংগঠন ‘বীরজি কা ডেরা’ এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তাঁর দুই সুপুত্র প্রেমজিৎ সিং এবং কমলজিৎ সিং।

আরও পড়ুন- বাঙালির পাত অসম্পূর্ণ পোস্ত ছাড়া! এই শস্যের সঙ্গে জড়িয়ে পলাশির যুদ্ধের ইতিহাসও

বর্তমানে কী কী কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এই সংগঠন?

বিগত ৩৩ বছর ধরে নিজেদের কর্তব্যে অবিচল ‘বীরজি কা ডেরা’। বর্তমানে এই সংস্থার অন্যতম কর্তা কমলজিৎ সিং জানান, প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল সাতটার মধ্যে শীষগঞ্জ গুরুদ্বারার সামনে জড়ো হয়ে যান ডাক্তার এবং ভলেন্টিয়াররা। তিনি বলেন, “আমাদের টিমে উপস্থিত সকল ভলেন্টিয়ারদের মধ্যে মুখ্যভাবে যে ভাবনাটি কাজ করে সেটি হল সেবা। আমাদের লক্ষ্য যে কোনও মূল্যে মানুষের সেবা করে যাওয়া।” শুধু শীষগঞ্জ গুরুদ্বারা নয়, দেশের রাজধানীর আরও বিভিন্ন অংশে ধীরে ধীরে নিজেদের ডেরা খুলছেন তাঁরা। লক্ষ্য একটাই, বিনামূল্যে মানুষকে পরিষেবা দেওয়া। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সংস্থাটির একটি নিজস্ব ৬৫ বেডের হাসপাতাল রয়েছে। যদি একটু বেশিই গুরুতর কোনও সমস্যা বা রোগ হয় তাহলে তাঁরা সেই মানুষটির সুশ্রুষা নিজস্ব হাসপাতালেই করেন। এছাড়াও এই সংস্থার সঙ্গে দিল্লি এবং দীনদয়াল উপাধ্যায় হাসপাতালের টাই-আপ রয়েছে। এমার্জেন্সি কেসে এই হাসপাতালেই বেডের ব্যবস্থা করে দেন তাঁরা।

তবে শুধু চিকিৎসাই নয়, প্রতিদিন দু’বেলা গরিব দুঃস্থদের মধ্যে খাবারও বিতরণ করেন তাঁরা। দিল্লির ২৫ টি জায়গায় এঁদের নিজস্ব লঙ্গরখানা রয়েছে। সেখানে কয়েক হাজার মানুষ প্রতিদিন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে খেতে পারেন। বিনামূল্যের খাবার বলে মোটেও হেলাফেলা করা জিনিস নয় কিন্তু! একদম ঘি দেওয়া ডাল, মাখন মাখানো রুটি বা কুলচা, পনিরের তরকারি এবং দেরাদুন চালের ভাত থাকে মেনুতে। সরকারি সাহায্য না নিয়েও মানুষের খাবার এবং ওষুধের ব্যবস্থা এঁরা করেন কোত্থেকে? কমলজিৎ সিং জানান, বীরজি কা ডেরার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আড়াইশোর বেশি পরিবার। এছাড়াও এমন অনেক মানুষ যুক্ত রয়েছেন যারা কখনও না কখনও উপকৃত হয়েছেন বীরজি কা ডেরা থেকে। এত মানুষের তরফ থেকে প্রাপ্ত অনুদান, মাসিক রেশন এবং ওষুধের মাধ্যমেই আজও স্বমহিমায় চলছে বীরজি কা ডেরা।

More Articles