ভাতের খিদে কি মানুষের মেরি বিস্কুটে মেটে?

একেকদিন আর রান্নাঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না। রান্নাঘর অবশ্য না বললেও চলে। কাঠের জ্বাল ঠেলে ঠেলে রান্না, তাও আবার উঠোনের একপাশটিতে। এই গরমে মানুষ পারে! সুখলতা তাই মুখের ওপর বলে দিয়েছে। বলে দিয়েছে, ওর দ্বারা কাঠের জ্বাল ঠেলা আর হবে না, সে তোমরা যা পারো করে নাও! সংসারে এমন কত হয়! কত মানুষ কত কাজ পায়ে ঠেলে চলে যায়! তা সংসার কি তাতে চলে না? দিব্যি চলে। সংসারের নিয়মই এই। এই যেমন সুখলতা আবার নিত্যদনের মতো জ্বাল ঠেলে ঠেলে রান্না করছে, এরকমই। স্বাভাবিক। মেয়েলোকের এসব কথা আবার কেউ গেরাজঝি করে নাকি! তবে সুখলতার ব্যাপার যদিও খানিক আলাদা। শওরের মেয়ে গাঁয়ে এলে যেমন হয় আর কী। তাও তো কত বচ্ছর হয়ে গেল! এখন বাটনা বাটা বলো, মুড়ি ভাজা বলো- সবই ওর হাতে বসে গেছে। এই শেকড় গজিয়ে যাওয়ার মধ্যে সুখলতার আনন্দ কতখানি, বলা মুশকিল যদিও। মানুষকে বাধ্য হয়ে কত কী-ই তো করতে হয়! তা বলে ভাত রাঁধা আর কে না শিখে আসে! শিখে আসাটাই তো শ্বশুরঘরের দস্তুর। তবে মিথ্যে বলব না বাপু, সুখলতা এখন সবই পারে। শুধু মাঝে মধ্যে গরম খানিক বাড়লে এদিকসেদিক থেকে মুখঝামটা ভেসে আসে। সে আসুক, ওটুকু সওয়া যায়। অন্তত রান্নাঘরে ঢুকে গতর নাড়ানোর চেয়ে ও ভালো।

ওই তো দাওয়ার পাশটিতে বসে বসে সুখলতা একমনে ডেঙ্গোডাঁটা কাটছে। এবারে ডাঁটাশাক হয়েওছে বাগানভরে। সকাল সকাল কাস্তে হাতে নিজেই কেটে এনেছে বড় বড় ডাল। এ-বাড়ির সকলেই কী যে ভালোবাসে মাখোমাখো করে ডেঙ্গোডাঁটার চচ্চড়ি। একটু বেশি করে না বানালে তাই হয় না। ডাঁটাই জড়ো করেছে এই অ্যাত্তো! এর ওপরে আবার কুমড়ো পড়বে, ঝিঙে পড়বে, পটল পড়লে, আলু তো আছেই। সব মিলে তা ধরো ওই বড় কড়াইয়ের এক কড়াই তো হবেই! তাও তুমি দিয়ে কুলোতে পারবে না। এই ডাঁটা খাওয়া সুখলতা এ-বাড়িতে এসে শিখেছে। এখন ওরও বেশ লাগে। অনেকক্ষণ ধরে চিবোতে চিবোতে মনে মনে বেশ একে-তাকে গাল পাড়া যায়। এই এখন যেমন এদের বাড়ির গুষ্টিশুদ্ধ লোকের মুণ্ডপাত করতে করতে কুটনো কাটছে সুখলতা। এসব না করলে কাজে ওর এনার্জি আসে না ঠিক। এর মধ্যে এ একবার চা চাইবে, ও একবার জল চাইবে! তা তমাদের কি ভগবান চার হাত-পা দিয়ে পাঠায়নি নাকি! চা-জলটাও চেয়ে খেতে হয় বাপু! ভাগ্যি আকাশে খানিক মেঘের পলি পড়েছে, নইলে এতক্ষণে সুখলতার গলা ওই শিউলি গাছের ওপার থেকে শোনা যেত।

রান্না বসিয়ে জ্বাল খানিক ঠেলে দেয় সুখো। নাহ্, এ নামখানা খোয়া গেছে কবেই। সুখই নেই সুখোর জীবনে, তার আবার নাম নিয়ে মাথাব্যথা। জোরে জোরে খুন্তি নাড়তে নাড়তে মনে মনে তাই একখান গান ধরে সুখো। তেমন কিছু না, বাংলা ছবির গান। গান গাইতে গাইতে আলু-কাঁচকলা কেটে নেয় ও। চচ্চড়ি নামিয়েই মাছের ঝোলখানা বসিয়ে দেবে। এরকম গরমের দিনে কাঁচাকলার ঝোল খেয়ে যে কী আরাম! সুখোর বর অবশ্য খেতে বসেই ভুরু কোঁচকাবে। তা কুঁচকাগগে যাক, সবার মন জোগাতে গেলে জীবন চলবে না সুখোর।

আরও পড়ুন: কাবাবের গন্ধ নয়, ইফতারের সন্ধে নামে মুড়ি-চপ-বেগুনিতে

উনোনের তাপে ওর ডানহাতখানা গরম হয়ে উঠছে। সুখো তবু উনোনের পাশেই শিল পেতে মশলা বাটছে। জিরে-ধনে আর শুকনো লঙ্কার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাড়ির উঠোনে। এমন গন্ধে সুখোর ছেলেবেলা থমকে আছে। তাই তো সুখো বাটনা বেটে মাছের ঝোল রাঁধে! টগবগ করে ঝোল ফুটছে ওই। ভাত এক ফুট দিয়ে নামানো আছে। আরেকবার বসিয়ে দেবে। ভাতের ভেতর থেকে ডালসেদ্ধর কৌটোখানা বের করে নেয় ও। জল ঢেলে ঢেলে ঠান্ডা করছে খানিক। ডালে বাগাড় দেওয়া হলে উচ্ছেপাতার বড়া করবে। ব্যস! পাতলা ডালে এক ফালি লেবু ডলে নিয়ে উচ্ছেপাতার বড়া দিয়ে খেতে কী যে আরাম! সকাল সকাল নেহাত মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। আর ক'খান বেশি পাতা তুলে আনলেই হত ভন্টাদের বাড়ির ওপাশ থেকে। তা মাথা গরম হবে নাই-ই বা কেন! না বাপু, অক্ষয় তৃতীয়ায় সরষে বেটে কাসুন্দি করতে পারবে না সুখলতা। সে তোমরা যা পারবে করে নাও! শ্বশুরের এই ইতিহাসের পাতা থেকে রান্না খুঁজে খুঁজে বের করার স্বভাব মোটে পছন্দ নয় সুখোর। সে তোমরা যা খুশি ভাবতে পারো! এই গাঁয়েও তো দিব্যি কাসুন্দি কিনতে পাওয়া যায়, তা যাও না, কিনে খাও না! বাড়িতে একখান বউ আছে বলেই কি তাকে সব করতে হবে! শাশুড়ি মা সগ্‌গে গিয়ে বেঁচেছেন। এতই যদি খাওয়ার সাধ নিজেরাই তো খানিক খানিক শিখে নিলে পারো। সেকথা কি আর বলতে ছেড়েছে সুখো! সেই এক কথা, এসব কি আর পুরুষমানুষের কাজ! শুনলে পিত্তি জ্বলে যায় সুখোর। তা মেয়েমানুষের কাজ কি কেবল বোশেখের দিনে কাঠের জ্বাল ঠেলা!

এসব ভাবতে ভাবতে এই আমাদের সুখলতা আরও দু’মগ ঠান্ডা জল ঢালে মাথায়। জল ঢালতেই খিদেটা এবারে চনমনিয়ে ওঠে ওর। এখন এই খিদে চেপে সেই শেষবেলায় খেতে হবে ভেবেই আবার মাথায় আগুন জ্বলে ওর। চুল আঁচড়ে চারটে মেরি বিস্কুট খেয়ে নেয় তাই। ভাতের খিদে কি মানুষের মেরি বিস্কুটে মেটে! সুখো তাই এক গেলাস জল খেয়ে নেয় এবারে। জল-টল খেয়ে সুখো ভাত বাড়তে বসে। ভাতের থালা সাজাতে সাজাতে ওর ঘুম নামে এবারে। নাহ্‌, শরীরটা জ্বালালে দেখছি!

শ্বশুরমশাই ভারি যত্ন করে ডাঁটাচচ্চড়ি খাচ্ছেন। এখন খানিক খারাপই লাগছে ওর, বুড়ো মানুষটাকে অমন করে না বললেই হত! কাসুন্দি বানানো তেমন করে শেখা হয়নি, একথা তো আর বলা যায় না! সুখো তাই আরেক হাতা ভাত তুলে দিতে দিতে বলে, বিকেলে খানিক সরষে এনে দেবেন বাবা? সুখোর শ্বশুরমশাই একথার কী উত্তর দেবেন ভেবে পান না বুঝি। সুখো তাই স্পষ্ট করেই বলে, ভাবছি কাসুন্দি বানাব। ওপার থেকে খানিক হতাশা ভেসে আসে বোধহয়। অক্ষয় তৃতীয়াই পেরিয়ে গেল! এখন আর কী! জানেনই তো সুখোর মাথায় খানিক ব্যারাম, সুখো তাই বলে বসে, এর আর দিন-অদিন কী! অক্ষয় তৃতীয়া তো মনে! তাই না বাবা! নাও তোমরা এমন পাগল মেয়ের অনাছিষ্টি কথার কী বিহিত করবে করো!

More Articles