দুধ চিতই, চষির পায়েস, রসবড়া, কেবলই পার্বণের জলপান?

পৌষের বেলা যেমন চট করে ফুরিয়ে আসে, এ মাসের দিনরাত্তিরও তেমনই। মাঠের কাজ, ঘরের কাজ সারতে সারতেই মানুষ ভাবে, এই বুঝি সংক্রান্তি এসে পড়ল। ম্যাসিনে ধান ঝাড়া শেষ হলেই কি আর কাজ ফুরোয়! সোমত্ত ছেলে বুড়োও একেকদিন তাই সারাবেলা আঝাড়া খড় পিটিয়ে পিটিয়ে ধান বের করে। এক মনে কাজ করতে থাকা ছেলেকে তখন ভারী লক্ষ্মীমন্ত মনে হতে পারে। তার শ্রম তার নিষ্ঠা তখন নরম রোদ্দুরে মিশে যেতে থাকে। মিশে যাওয়া সেই নরম রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে মানুষ কেবলই ভাবে, এই বুঝি মাস ফুরালো। এই বুঝি ঘরে ঘরে কুটুম এল বাঁধনার নেমন্তন্ন করতে। এই আমাদের আদিবাসী পাড়ায় ঘরে ঘরে এখন বাখর কেনার ধুম কত! এ তো দোকানদারির সস্তা মৌতাত নয়! গেরস্থালি ওমের হাত যশে এদিক সেদিক থেকে আসা কুটুমদের বুঁদ করে দিতে হবে, তবে না!

শীতের দিনে চাল মজতে সময় লাগে বেশি। চান সেরে ভিজে চুল ঝেড়ে নিতে নিতে ঘরে ঘরে বউ মানুষেরা তাই হাতে সময় নিয়ে হাড়িয়ার জাঁক দেয়। বসে যাওয়া গালে চুট্টায় টান দিতে দিতে সুন্দরী গোগো ভাবে, পাড়ু ধানের হাড়িয়ার কথা। আহা! সে ধানের চাষ আর নেই। সে ধান কোথায় হারালো, কোন পথে, তার হদিশ জানে কি কেউ? জানে না, জানবেও না। এখন কেবলই দশের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবার ব্যাকুলতা। তবু তো পৌষের সন্ধ্যায় ওই দূরে পাড়ায় পাড়ায় মেটে উনোনে ধুকির দোকান খুলে বসে রহিমা বিবিরা। তুমি চাইলেই কি আর মিষ্টি ধুকি পাবে? নোনতা ধুকিই এখন বেশি। ঘরে ঘরে ঝোলা গুড়ে আর ঝাল তরকারির ঝোলে চুবিয়ে চুবিয়ে কেমন ছেলে বুড়ো খাচ্ছে দেখো। গ্যাসের আলোর নীচে এমন কত কত ধোঁয়া ওড়ানো পিঠের সওদা প্রতি প্রতি দিন পৌষের সন্ধ্যা আলো করে দিচ্ছে সে খবর রাখে কে?

এই ধরুন, গাঁয়ে গঞ্জে আপনি চাইলেই কি আর শালপাতার বাটিতে ফুলকপির সিঙারা পাবেন? আগুন পোহানো ছেলে এখন উনোনের পাশটিতে বসে আসকে পিঠে খাচ্ছে মন ডুবিয়ে। সে ছেলেকে আপনি এক চক্কর সাইকেল চালিয়ে খান দুই কুসুম বীজ ছড়ানো আলুর চপ এনে দিতে বলেন তো সে রাজি। সে এখন কেমন করে শহরের গলিপথে হারিয়ে যাবে বলুন! খাবারেরও তো ভূগোল থাকে। থাকতেই হয় যে। খেঁজুর কাঁটায় নক্সা তুলে তুলে নিপুণ হাতে গড়ে নেওয়া, নকশি পিঠে আপনি চাইলেই বা পাচ্ছেন কোথায়? এমন করেই পাওয়া আর না পাওয়ায় পৌষের পাকঘর পৌষের হেঁশেল সেজে ওঠে। কত যে তার রূপ কত যে তার কথা সে বলে শেষ করা যায় না। আসকে পিঠে থেকে সেদ্ধ পুলি, মুগ পাকন থেকে সরুচাকলি তার কি শেষ আছে ! নবান্ন পেরোনো কৃষি উৎসবের প্রলম্বিত সুর তাই যেন কোন ওস্তাদের হাতে ঘরে ঘরে বাজতে থাকে সম্ভ্রান্ত আলাপের মতো। কে বলে, কেবল সুরই মানুষকে নিয়ে যেতে পারে কথা ফুরানো ইন্দ্রিয়াতীতের পারে? কত প্রজন্মের শিক্ষানবিশি আর মানুষের স্বাদ আর সাধ্যের কথাকার ওই মকর সংক্রান্তিতে এসে থিতু হয়েছে বলো! সে কি ঘর আর গুরুভেদে বিপ্রলম্ভ আলাপের মতো নয়!

পৌষের হিমে রাতের শিশিরের জমে স্থির হয়ে থাকে যে দুধ চিতই, চষির পায়েস, রসবড়া, তারা কি কেবলই পার্বণের জলপান? নাকি, মানুষের স্মৃতি আর সত্তায় অনর্গল বাজতে থাকা কোনো বাগ্রেশ্রী’র তানকে সে ফিরে ফিরে বাজাতে চায় কোন সে ফেলে ফেলে আসা জীবনের আশ্রয়ে? ঘরে ঘরে রাত জাগা পিঠে গড়ার সম্মেলনকে তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা বলে মনে হয়। মানুষের শ্রম আর শিল্পের মেহনতি আবেগের উত্তাপ কেবলই আকার পেতে চায় পৌষের লাল্টুক্টুকে চুলায়। তার আসকে পিঠের সরা, তার ভিজে হাতে চালগুড়ি চেলে নেওয়ার ভঙ্গিতে বার বার জেগে উঠতে চায় আস্ত একখানা দেশ। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার স্বপ্ন দেখে যারা তারা কি কখনও পৌষের সন্ধ্যায় উনোনের পাশে বসে পিঠে গড়ে? গড়ে না বোধহয়। গড়তে জানলে তারা টের পেত, হিং দেওয়া ছোলার ডাল- গরম কচুরি আর ফুলকপির সিঙারার বাইরেও আস্ত একখানা পৌষের মাস গড়াগড়ি খায় সংক্রান্তির কথা ভেবে ভেবে। সে ভাবনায় মিশে থাকে পার্বণের খুশি। পিঠে থেকে ভাত, ভাত থেকে পানীয়, পানীয় থেকে চেলে রুটি – এমন করে সময়ের মধ্যে সময়কে খুঁজে পাবার কী আশ্চর্য আয়োজন, না?

এই সিরিজের অন্য় লেখা পড়ুন-সে রান্না মানুষকে নিয়ে গিয়েছে জন্মান্তরের পারে…

ওই দূরে দূরে খুব নীচু জমি বরাবর নরসিংহ জটার ক্ষেত। জলে ডুবেও টিকে থাকার কী আশ্চর্য ক্ষমতা ওর। কারা যে এসব ধানের এমন নাম রেখেছিলেন কে জানে! তারা সিংহ দেখেননি বটে, তবু তো তারা দশাবতার চরিতের কথা জানতেন! তারা কি ওই শক্তিশালী ধানের শিসে হিরিণ্যকশিপুর সোনালি কেশর প্রত্যক্ষ করেছিলেন? কী জানি! এমন পৌষের দিনে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে একটানা পিঠা খেতে খেতে যখন মুখ মেরে যায়! ডাগর ডোগর মেয়ে তখন বলে, কাঁটা বেগুনের চচ্চড়ি দিয়ে ভাত দে তো মা! তার মা, সানকিতে বেড়ে দেন নরসিংহ জটার ভাত। মেয়ে বসে বসে এক মনে খায়। খাওয়া হলে মেয়ে এবার মোষদুটো চড়াতে নিয়ে যাবে। ওই দূরে নদীর ধারে ধারে নরম ঘাসে ওরা চড়বে সারা সারা বেলা। নদীর ধারে ধারে হলুদ হলুদ ফুল হয়েছে সর্ষে ক্ষেত ভরে। আমাদের ডাগোর ডোগর মেয়ে দেখবে সেসব। দেখতে দেখতে ও ভাববে, বাঁধনায় এবারে মাথার উপর উঁচু করে চুল বেঁধে ফুল জড়াবে এই এমন করে। চুড়ো করে বাঁধা চুলে গোলাপি কাগজ ফুলে এখন ওকে দেখে মনে হচ্ছে ঠিক যেন ফ্রিদা কালহো। এই মকর সংক্রান্তির রোদ্দুরে হেঁটে চলেছে ওই আমাদের ডাগর ডোগর মেয়ে। ওর কর্মমুখরতায় কেমন থিতু হয়ে আছে শ্রমের হর্ষ! ও যেন ঠিক ওই নরসিংহ জটার ক্ষেত পেরোনো সোনালি রোদ্দুরের মতো, কোন সে রুশ উপকথার উত্তাপ পেরিয়ে ও কেবলই মানুষকে নিয়ে যেতে চাইছে সোনালি বালির নদীতে। সেই যেখানে কত কত ধান চালের গন্ধ কেবলই ভেসে যেতে চাইছে মানুষের গল্প বলবে বলেই। সে গল্প বলতে বলতেই দক্ষিণায়ন ফুরোবে এবার। মানুষের অবশ্যি তাতে কিছু এসে যায় না, ওই যে সে চলেছে সর্ষেক্ষেত পেরিয়ে ওই দূরে, আরো দূরে।

More Articles