থাইভূমি থেকে বঙ্গভূমি: YaBa ঝিমুনি বড়ির প্রাণঘাতী অনুপ্রবেশ

Yaba: ২০০০ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশের কক্সবাজারের নেশাড়ুদের হাতে পৌঁছে গেছিল যে গোলাপি রঙের ট্যাবলেট সেটি দু'দশক পেরিয়ে দু'টি দেশের লক্ষ লক্ষ মাদকসেবীর পছন্দ তালিকায় একেবারে উপরের দিকে।

ঝিম ধরা আমেজ। ক্লান্তি ছড়িয়ে পড়ে। হালকা অবসাদ হতে থাকে। মূলত এটাই প্রধান আকর্ষণ ঝিমুনি বড়ির। পোশাকি নাম YaBa (ইয়াবা)। গোলাপি বা হলদে রঙের এই বড়ি সুদূর থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ হয়ে উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে যেমন চোরাপথে ঢুকছে, তেমনই আসছে পশ্চিমবঙ্গে। থাইভূমি থেকে বঙ্গভূমিতে ছড়িয়ে পড়া ইয়াবা মাদকের ব্যবসার বহর বিরাট। ইয়াবার যাত্রাপথের কাহিনি বলার আগে এই মাদক বড়ি আসলে কী বস্তু তা জানা যাক। একুশ বছর আগের কথা। ২০০০ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশের বিশ্ববিখ্যাত সৈকত এলাকা কক্সবাজারের নেশাড়ুদের হাতে পৌঁছে গেছিল যে গোলাপি রঙের ট্যাবলেট সেটি দু'দশক পেরিয়ে দু'টি দেশের লক্ষ লক্ষ মাদকসেবীর পছন্দ তালিকায় একেবারে উপরের দিকে। হেরোইন, হাসহিস, চরস, ব্রাউন সুগারের পাশে দিব্বি স্থান করে নিয়েছে ইয়াবা। গত কুড়ি বছরে ইয়াবার জনপ্রিয়তা রেটিং অন্যান্য মাদকের তুলনায় বেশি।

থাইভূমি থেকে বঙ্গভূমি: YaBa নামে ঝিমুনি বড়ির প্রাণঘাতী অনুপ্রবেশ

চিত্রঋণ : Google

দু'দশক আগে ইয়াবা গোপন পথে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ (পূর্বতন আরাকান) থেকে পাহাড়ি ও সমুদ্র পথে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ঢুকেছিল। চট্টগ্রামের পুলিশের নজরে আসে এই গোলাপি বড়ির ব্যাপক ব্যবহার। বাংলাদেশের রসায়ন ও ওষুধ বিশেষজ্ঞরা এই বড়ি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্রে ইয়াবাসেবীদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ইয়াবা এমন এক ধরণের উত্তেজক বড়ি যা সেবন করলে-

রাতের পর রাত জেগে থাকা যায়।

যৌন উদ্দীপনা বেড়ে যায়।

হেরোইন ও ফেনসিডিল খেলে শরীর ঝিম মেরে থাকে।

তখন ইয়াবা সেবনকারী বিচরণ করে কল্পনার রাজ্যে । (তথ্য সূত্র বিবিসি বাংলা)

বলাই বাহুল্য ইয়াবা উত্তেজনার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় উঠে এসেছে, ইয়াবা খেলে শরীরে উত্তেজনার ফলে ঠিক ঘুম হয় না। কিন্তু ঝিম ধরা লেগে থাকে। এটা বাড়তে থাকলে মানে ইয়াবার সেবন মাত্রাতিরিক্ত হলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়েছে, ইয়াবা   ট্যাবলেট হলেও এটি গিলে খাওয়ার নিয়ম নেই। অ্যালুমিনিয়ামের  ফয়েলের উপর ইয়াবা ট্যাবলেট রেখে নিচের দিক থেকে তাপ দিয়ে ট্যাবলেট গলাতে হবে। ধোঁয়া বের হল সেটা একটি নলের মাধ্যমে মুখ দিয়ে গ্রহণ করা হয়। সেই ধোঁয়া সরাসরি স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছে প্রভাব ফেলতে শুরু করে।

দু দশক আগে ঠিক এমনি করেই বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী মায়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্তে ইয়াবা হাতে হাতে ঘুরতে শুরু করে। বেশকিছু চোরাচালান ধরাও পড়ে। বিস্তারিত তদন্তে জানা যায় মায়ানমার নয়, ইয়াবা বড়ির আসছে থাইল্যান্ড থেকে।

মায়ানমার ও থাইল্যান্ড প্রতিবেশি দেশ। থাইভূমির উত্তর অংশ ও মায়ানমারে (বার্মা) দক্ষিণ অংশের স্থলভাগের সীমান্ত মানবপাচারের কারণে কুখ্যাত। তেমনই চোরাচালানকারীদের কাছে দুই দেশের সমুদ্র উপকূল এলাকা বিশেষ পরিচিত। মানবপাচারের সঙ্গে চোরাই আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক পাচারের ঘাঁটি এই সব এলাকা। 

থাইল্যান্ডে ইয়াবা মাদকের বহু পুরনো ব্যবহার ও কারবার। একসময় ইয়াবা থাই জনগণের বড় অংশের পকেটে থাকত। এমনকি পেট্রল পাম্পে মিলত এই মাদক। কিছু তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, খুচরোর বিনিময়ে ইয়াবা দেওয়া অলিখিত নিয়ম হয়ে যায়। ইয়াবার মারাত্মক প্রভাবে ট্রাক, লরি চালকরা এমনকি ট্যাক্সি, স্কুটার চালকরা দুর্ঘটনা ঘটাতে থাকে। ১৯৭০ সালে এই মাদক নিষিদ্ধ করে দেয় থাইল্যান্ড সরকার।

নিষিদ্ধ বস্তুর আকর্ষণ বেশি। ইয়াবার কদর আরও বাড়তে থাকে। তবে ইয়াবার খোলাখুলি ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় এই বড়ি মায়ানমারে ঢুকতে লাগল চোরাপথে। মায়ানমার জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ইয়াবা। দেশটির কোকাং আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে ইয়াবার উৎপাদন শুরু হয়। মায়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবার পরবর্তী গন্তব্য হয় প্রতিবেশি বাংলাদেশ।

মায়ানমারের সীমান্তে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম।  উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা। দিগন্ত বিস্তৃত দুর্গম বনাঞ্চল ও পাহাড়ের সারি পেরিয়ে ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা রাজ্য। আর দক্ষিণে নিচের দিকে বঙ্গোপসাগরের তটরেখা বরাবর বাংলাদেশের টেকনাফ, কক্সবাজারের মতো বিশ্ববিখ্যাত সৈকত এলাকা। আন্তর্জাতিক পর্যটনের কেন্দ্র। এসব এলাকা দিয়ে সীমান্ত চোরাচালানের অন্যতম বস্তু হয়ে গেল ইয়াবা।

নব্বই দশকের শেষ থেকে ইয়াবার চালান বাড়তে থাকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগে। ২০০০ সাল থেকে রমরমা কারবার শুরু হয়। ইয়াবার নেশা চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে, সেখানকার বাসিন্দাদের হাত ঘুরে, আন্তর্জাতিক পর্যটকদের পকেটস্থ হয়ে বাংলাদেশের সর্বত্র যেমন ছড়ায়, তেমনই ঢুকে যেতে থাকে ত্রিপুরা, মিজেরাম হয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যগুলিতে। উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র আন্দোলনকরা গোষ্ঠীগুলির কাছে আয়ের অন্যতম মাধ্যম হয় ইয়াবা পাচার।

উত্তর পূর্ব ভারতের বৃহত্তর অংশ অসম হয়ে ঘুরপথে পশ্চিমবঙ্গের দিকে আসতে ইয়াবার লাগে আরও কয়েকটি বছর। ততদিনে বাংলাদেশের সর্বত্র ইয়াবা জেঁকে বসেছে। ইয়াবা পাচারকারী ধরা পড়ছে অহরহ। লক্ষ লক্ষ টাকার মাদক সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করছে বাংলাদেশের পুলিশ। মায়ানমার সীমান্ত ইয়াবা চোরাকারবারিদের সঙ্গে গুলি বিনিময় হয়।সাময়িক বন্ধ হয় চোরাচালান। ফের শুরু হয়।

ইয়াবা মাদক পাচারের একপর্বে জড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম বিভাগের সরকারি উচ্চপদস্থ একাংশ আমলা, প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশ। তদন্তে উঠে আসতে থাকে যে ব্যক্তির রোজগারহীন, তারই আলিশান মহল তৈরি হয়েছে। এ যেন আলাদীনের প্রদীপ দৈত্যের ছোঁয়া লেগেছে। সবই ইয়াবা কৃপা।

ইয়াবার নেশায় বাংলাদেশ যুব সমাজ মত্ত হচ্ছে। এই জাতীয় সংকটে চিন্তিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কড়া ভূমিকা নেন। চট্টগ্রাম বিভাগে ব্যাপক ইয়াবা বিরোধী অভিযান শুরু হয়। একের পর এক চোরাচালান ঘাঁটি তছনছ করা হয়। ততদিনে উত্তর পূর্ব ভারতে ছড়িয়েছে ইয়াবা। রঙ পাল্টেছে। গোলাপি বড়ি হয়েছে হলুদ ও সাদা রঙের।

বাংলাদেশে ইয়াবার মারাত্মক প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের দিকে আসতে শুরু করেছে। উত্তর পূর্ব ভারত থেকে ইয়াবার চালান পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ধরা পড়ছে। কিছুক্ষেত্রে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া জেলাতে সরাসরি ঢুকছে এই মাদক।

ইয়াবা নেশা মারাত্মক। থাইভূমি থেকে বঙ্গভূমি যাত্রাপথে রুপোলি দুনিয়ায় ইয়াবার কদর অত্যাধিক বেড়েছে। ঝিম ধরা নেশা, ঝিমুনি বড়ির নেশা ঘিরে নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গকে। আরেকটা কথা, ইয়াবা ছিল হিটলারের বিশেষ পছন্দের। তার নির্দেশে নাৎসি বাহিনির উপর প্রয়োগ করা হতো এই বড়ি।


সৌজন্য:

  • Yaba smuggled in through newer, easier routes: Daily Star Bangladesh
  • Security agencies fear 'crazy' yaba may find ground in India: The Week

 

More Articles