হাড়ভাঙা খাটুনি, আধখানা ঘুমকে সাথে নিয়ে স্বপ্ন সফলের লড়াই ডিজনিল্যান্ডের স্রষ্টার

সুসেন: কোন কাজটা কোন সময়ে কাকে দিয়ে করালে সব থেকে ভাল হবে, সেটা বোঝার দক্ষতা ছিল অসাধারণ। সুযোগ্য কর্মীর খোঁজ পেলে যত দূর হোক না কেন আপ্রান প্রচেষ্টায় নিয়ে আসতেন নিজের সংস্থায়। যে সহকর্মী ইঞ্জিনিয়াররা ওঁর ভাবনাকে রূপ দেওয়ার কাজে লেগেছিলেন, তাঁদের উনি বলতেন ‘ইম্যাজিনিয়ার’ (Imaginner)। মানে, যাঁরা শুধু ইঞ্জিনিয়ার নন, যাঁরা কল্পনা করতে জানেন, যাঁরা দূরদর্শী। দাদা রয় ডিজনিও ছিলেন অসামান্য দক্ষ ম্যানেজার। সব কর্মীই ছিলেন ওঁর স্বপ্নের শরিক। এই যে সবাই মিলে একটা দারুণ সুন্দর স্বপ্ন দেখা আর পরে সে স্বপ্নটাকে সত্যি করতে কাজে নামা, এটাও শেখানো ওয়াল্ট এলিয়াস ডিজনির।

জন্ম ১৯০১ সালের ৫ ডিসেম্বর আমেরিকার শিকাগো শহরে এক অত্যন্ত সাধারণ গেরস্ত-ঘরে। একটা থিতু শৈশবও ছিল না, এ পাড়া, ও শহরে বার বার বাড়ি বদলের জেরে। কিন্তু তার মধ্যেই আঁকায় হাত পাকানো, ছোট্ট রেল স্টেশনে গিয়ে ট্রেন দেখা, কমেডি-শো আর সেলুলয়েডের ছবির প্রেমে পড়া। স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারের অভাব মেটাতে বড় ভাই রয় ডিজনির সাথে শুরু করেন পত্রিকা বিলির কাজ। স্কুল থেকে ফিরে আবারও কাগজ বিক্রির কাজ করতে হত। টানা ছয় বছর এই ক্লান্তিকর কাজ করে যান তিনি। ক্লান্তির জন্য কখনো কখনো ক্লাসেই ঘুমিয়ে পড়তেন। কিন্তু আঁকাআঁকির প্রতি তার ভালোবাসা কমেনি কখনওই। আর্ট ক্লাসে চমৎকার সব স্কেচ করে অবাক করে দিতেন শিক্ষকদের। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নটাকে তিলে তিলে বড় করতে থাকেন চর্চার মাধ্যমে। কাগজ বিক্রির পাশাপাশি কার্টুন এঁকে পেপারেও ছাপাতেন মাঝেমাঝে। কিছু বাড়তি আয়ও হয়ে যেত। ভোর ৪ টা কখনও বা ৩.৩০-তে উঠে বেরিয়ে পড়তেন পত্রিকা বিক্রি করতে। কাজ শেষে ছোট একটা ঘুমের পর আবার রওনা হতেন স্কুলে।

হাড়ভাঙা খাটুনি, আধখানা ঘুমকে সাথে নিয়ে স্বপ্ন সফলের লড়াই ডিজনিল্যান্ডের স্রষ্টার

চিত্রঋণ : Google

ওয়াল্ট ডিজনিকে গোটা বিশ্ব চেনে প্রতিভায় সমুজ্জল এক জন অ্যানিমেটর, মিকি মাউস-এর স্রষ্টা আর প্রায় দু’ডজন অস্কার জিতে নেওয়া পরিচালক-প্রযোজক হিসেবে। আরও এক ধাপ এগোলে, ডিজনিল্যান্ড-এর মত অসাধারণ ‘থিম পার্ক’-এর রূপকার বা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির প্রাণপুরুষ হিসেবে। সম্পূর্ণ অন্য একটা পরিবেশ থেকে অসাধারণ সংগ্রানের মধ্যে দিয়ে ওঁর ওই রকম তাক-লাগানো উঠে আসাটা আমার কাছে দারুণ শিক্ষাপ্রদ। সৃষ্টিশীল মন তো কত জনেরই থাকে। ঠিক ঠিক ভাবে, ঠিক উপকরণ দিয়ে, ঠিক লোককে ঠিক সময়ে কাছে টেনে একটা পরিকল্পনাকে, একটা কালজয়ী ভাবনাকে রূপ দিতে পারেন ক’জন? ওই জায়গাটাতেই ডিজনি আশা দেন, প্রেরণা জোগান। মনে করেন চলচ্চিত্র সম্পাদনার পেশায় দীর্ঘদিন যুক্ত মনীশ বসু।

বাকিটা ব্য্যক্তিগত-র মত জাতীয় পুরস্কার পাওয়া চলচ্ছিত্রের পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের কথায়, ছোটবেলায় অনেকেই তো গান, নাচ, ছবি, অভিনয় কত শিল্পই শেখার চেষ্টা করি। কিন্তু বড় হয়ে কাজ বাছি অন্য, জীবনটাও কেমন বাঁধা গতে পড়ে যায়। ডিজনি কিন্তু তা করেননি। ছোট থেকে যে যে জিনিসগুলো ভালবেসেছেন, তাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়েছেন নিজের স্বপ্নে, নিজের পেশায়। ভালবাসার সঙ্গে ভিশন যুক্ত হলে তবে না সেটি অমর সৃষ্টি হয়ে ওঠে! ডিজনিল্যান্ড, তো তা-ই, মাস্টারপিস!

চলার পথে বাধাবিঘ্নও ছিল বিস্তর। বাবা-মা’র উদ্বেগ, কাজ খোঁজার, রোজগারের চাপ মাথায়। কখনও কাগজে ক্যারিকেচার বা কমিক্স আঁকছেন তো আবার হয়তো অন্য কোনও কাজ করছেন। ১৬ বছর বয়সী কিশোর ওয়াল্ট ভর্তি হন হাই স্কুলে। দক্ষতার জোরে হয়ে যান স্কুলের নিউজপেপারের জুনিয়র আর্ট এডিটর। দিনে স্কুল আর রাতে শিকাগো একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের আর্ট ক্লাসে চলতো প্রশিক্ষণ। আর্ট ক্লাসের খরচ যোগাতে কাজ নেন বাবার ফ্যাক্টোরিতে কাঁচের জার ধোয়ার। কিন্তু মনযোগের অভাবে হাইস্কুলে পড়ার সুযোগ হারান ডিজনি। ১৮ বছর বয়সী ডিজনি চাকরির তাগিদে যোগ দেন ক্যানসাস সিটির প্রেসম্যান-রুবিন স্টুডিওয় কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে। পরিচয় হয় সহকর্মী আব আইওয়ার্কসের সাথে, বড় ভাই রয়ের মতো আইওয়ার্কসকেও পাশে পেয়েছিলেন ডিজনি তার জীবনের নানা বাঁকে। পরের বছর নিজেদের উদ্যোগ শুরু করলেও প্রচেষ্টা সফল না হওয়ায় আবার চাকরি নিলেন দুজনে।

এরপর সিটি ফিল্মে কাজ করার সময় ডিজনি একটি অব্যবহৃত ক্যামেরা দিয়ে শুরু করলেন নতুন আইডিয়ার পরীক্ষা, স্টপ অ্যাকশন ফিল্ম। তার আঁকা চিত্রগুলো দিয়ে একের পর এক ফ্রেম সাজিয়ে তৈরি করার চেষ্টা করলেন অ্যানিমেশন। অক্লান্ত পরিশ্রমে সাফল্য আসার পর আইওয়ার্কসকে নিয়ে আবার নতুন উদ্যোগের শুরু। ২২ বছর বয়সী ওয়াল্ট হলিউডে মার্গারেট উইংক্লার নামে এক কার্টুন ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে চুক্তি তৈরি করে কিছু অ্যানিমেটর এবং একটি বাচ্চা মেয়েকে, নিয়ে বানালেন লাইভ অ্যাকশন ফিল্ম “অ্যালিস ইন কার্টুনল্যান্ড”। পরের বছরই তৈরি করলেন অসওয়াল্ড দ্য লাকি র‍্যাবিট  সিরিজ। রাতারাতি জনপ্রিয় হল এই সিরিজ। কিন্তু ধাক্কা খেলেন চরম বিশ্বাসঘাতকতায়। নিউইয়র্কে গিয়ে জানতে পারলেন, ডিস্ট্রিবিউটর মার্গারেট কার্টুন চরিত্রগুলোর স্বত্বাধিকার চুরি করে নিজের নামে করে নিয়েছেন।

হাড়ভাঙা খাটুনি, আধখানা ঘুমকে সাথে নিয়ে স্বপ্ন সফলের লড়াই ডিজনিল্যান্ডের স্রষ্টার

চিত্রঋণ : Google

হলিউডে ফিরে আবার নতুন লড়াই। আইওয়ার্কসকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি হল মিকি মাউস। মিকি নামটি স্ত্রী লিলিয়ানের দেওয়া। তখন সদ্য শব্দগ্রহণ চালু হচ্ছে। তাই লিপ সিংক প্রযুক্তির মাধ্যমে ওয়াল্টের কন্ঠেই রেকর্ড হলো মিকির ভয়েস। আগের অভিজ্ঞতায় এবার স্বত্বাধিকারের দিকে বিশেষ নজর দিলেন ওয়াল্ট। আর এক সঙ্গী প্যাট পাওয়ারের দক্ষতায় আর আইওয়ার্কস-ডিজনির অ্যানিমেটরদের জাদুর ছোঁয়ায় তৈরি হল স্টিমবোট উইলি । অসওয়াল্ডের থেকেও জনপ্রিয় হল এই অ্যানিমেশন ফিল্ম । পরের বছর  যোগ করা হল গুফি, ডোনাল্ড ডাকের মতো জনপ্রিয় কয়েকটি চরিত্রকে। সাফল্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেমনি জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, তেমনি লাভও আসতে থাকে সবদিক থেকে। টেকনিকালার আসার পর ১৯৩২ সালে প্রথম রঙিন অ্যানিমেশন ফ্লাওয়ারাস এন্ড ট্রিজ অ্যাকাডেমিক অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়।

ডিজনি কখনোই থেমে থাকেননি। ১৯৩৪ সালে স্বল্পদৈর্ঘ্য থেকে পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। অসাধারণ কিছু আর্টিস্টের সাথে একটা দারূণ টিমের সমন্বয়ে ১৯৩৭ সালে প্রকাশ পায় ক্লাসিক রূপকথার উপর ভিত্তি করে তৈরি স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস।  চলচ্চিত্রটি বানাতে খরচ হয়ে হয়েছিল ১.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেসময়ে টাকার অংকে এটা বিশাল পরিমাণ। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বক্স অফিস মাতিয়ে আয় হয় ৪১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মায়ের মর্মান্তিক মৃত্যুতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও আবার ঘুরে দাঁড়ান। একে একে তৈরি হয় ফ্যান্টাসিয়া (১৯৪০), ডাম্বো (১৯৪১), বাম্বি (১৯৪২) এর মতো জনপ্রিয় কিছু ফিচার ফিল্ম।

৫০ এর দশকের শুরু থেকে ডিজনি একটি বিনোদনমূলক পার্ক তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। অতীতের স্মৃতি, রূপকথার জগৎ সব মিলিয়ে ছোটবড় সকলের জন্য আনন্দঘন এক পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৫৫ সালে চালু হয় ডিজনিল্যান্ড। দ্বিতীয় ডিজনি পার্কটির নির্মাণকাজ চলাকালীন তাঁর মৃত্যু হয়। এক জন উদ্যোগপতির প্রয়াস শুধু ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির গণ্ডিতে আটকে থাকে না। সেই প্রয়াসটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাস্তাও তাঁকে তৈরি করতে হয়, ‘উদ্যোগ’টাকে করে তুলতে হয় ‘প্রতিষ্ঠান’। ডিজনি এখানেই প্রেরণা, কেননা তাঁর প্রতিষ্ঠান তিনি চলে যাওয়ার পরও কলেবরেও বাড়ছে। একটা যুগান্তকারী আইডিয়াকে নিয়ে একমুখী একরোখা এগিয়ে যাওয়াটা সব প্রতিষ্ঠান পারে না। ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি পেরেছে। তাই না সারা বিশ্বে সবাই ওয়াল্ট ডিজনিকে এক নামে চেনে ন। এভাবেই উপসংহার টানলেন জাতীয় পুরস্কার জয়ী পরিচালক।

তথ্যসূত্র - www.britanica.com আনন্দবাজার পত্রিকা -02.03.2014 thewaltdisneycompany.com

 

More Articles